হারুন-আর-রশিদ
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। কেন এ দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হতাশার পথে বাঁক নিলো তার বিস্তারিত কিছু তথ্য তুলে ধরা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় : ১. ঐকমত্যে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতির সরকারব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে বাতিল ঘোষণা। ২. মুন্সীগঞ্জে বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর নির্মাণের তুঘলকি পরিকল্পনা। ৩. ড. ইউনূস ইস্যু তৈরি; তথা গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার বিতর্তিক কার্যক্রম দেশজুড়ে। ৪. মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং গুম, হত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, হামলা, মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড। ৫. পিলখানার বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডÑ উচ্চপর্যায়ের ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তা নিহত। মুক্তিযুদ্ধেও এইপর্যায়ের এত সেনাকর্মকর্তার প্রাণহানি ঘটেনি। ৬. বিশ্বব্যাংক কর্র্তপক্ষ পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল। ৭. কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে মোটা অঙ্কের দুর্নীতি। ৮. নজিরবিহীন শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিÑ যার কারণে নিঃস্ব হয়ে পড়েন ৩৪ লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারী। লুট হল ৯৪ হাজার কোটি টাকা। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অদ্যাবধি ব্যবস্থা গ্রহণ না করা। ৯. এই সরকারের পৌনে চার বছরে ১৬ জন সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ড। এটা অন্য কোনো আমলে ঘটেনি। ১০. বাজার সিন্ডিকেট করে পণ্য মূল্যস্ফীতির অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ। ১১. রেলের ৭০ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্য। রেলমন্ত্রীর এপিএসের গাড়ি থেকে এই টাকা উদ্ধার। ১২. বর্তমান আমলে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ছয়বার। গত ৪২ বছরে একটি সরকারের আমলে এটাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় রেকর্ড। ১৩. সোনালী ব্যাংক থেকে ৩৬০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে অখ্যাত কোম্পানি হলমার্কের কেলেঙ্কারির ঘটনা। নেপথ্যের রাঘব বোয়ালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে এখনো। ১৪. ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে অকার্যকর রাজধানী শহরÑ এই ‘খেতাব’ অর্জন। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট পত্রিকায়। ১৫. ঢাকা বিশ্বের ৩১তম দূষিত নগরী (১৯৪ রাষ্ট্রের মধ্যে) এবং বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছেÑ এই ‘খেতাব’ (এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয় বিদেশী পত্রিকায়) অর্জন। ১৬. ডেসটিনি গ্রুপের অর্থ কেলেঙ্কারি। প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা জনগণ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে এমএলএম কোম্পানিটি। এমএলএম নীতিমালা বাক্সবন্দী। এভাবে লুটপাটের সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার। এসব কোম্পানির কর্মচারীরা সাত মাস ধরে বেতনভাতা পাচ্ছেন না। ১৭. মহাজোট সরকারের পৌনে চার বছরে প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির বিরুদ্ধে উত্থাপিত বড় দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগেও দুদক কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদই যেন দুদকের সব চেয়ে বড় কাজ। ১৮. ছাত্রলীগের চরম তাণ্ডবে বিপন্ন সারা দেশ। ৪৪ মাসে নিরীহ ১৯ জন ছাত্র খুন। আহত চার হাজার। শিক্ষাঙ্গনে সংঘর্ষের ঘটনা তিন শতাধিক। একের পর এক কলেজ-ভার্সিটি বন্ধ। দীর্ঘ সেশনজটের কবলে পড়াশোনায় চরম ব্যাঘাত। ১৯. সংসদকে পরিণত করা হয়েছে একদলীয় ফোরামে। বিরোধী দলের উপস্থিতি নেই। মহাজোটের চার-পাঁচজন সদস্য ছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব। তাঁদের মুখ বন্ধ করার জন্য মন্ত্রিত্ব উপহার সরকারের শেষ বেলায়। ২০. মন্ত্রিসভায় নতুন দুইজন সদস্য বিতর্কিত। সুপ্রিম কোর্টে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সংসদ সদস্যপদ বাতিল ঘোষণা হলেও তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আরেক মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু প্রকল্পে মহাদুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ। ২১. সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ পৌনে চার বছরে দুই শতাধিক বাংলাদেশীকে খুন করেছে। ২২. ট্রানজিটের নামে ভারতকে করিডোর দিয়ে দেশকে অর্থনৈতিক উপনিবেশ বানানোর পাঁয়তারা। ২৩. এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় মাদক চালান ধরা পড়েছে। সরকারি দলের এমপির এপিএসের গুদাম থেকে ১০ কোটি টাকার ইয়াবা উদ্ধার চট্টগ্রামে (জাতীয় দৈনিক ১৯/৫/১২)। ২৪. ঝালকাঠির নিরীহ কলেজছাত্র লিমনকে পঙ্গু করে দিয়ে উল্টো তার পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে মানবতাকে পঙ্গু করার পাঁয়তারা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে সোচ্চার। ২৫. টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের সুশীল সমাজ উদ্বিগ্ন হলেও আমাদের মন্ত্রীরা নির্বিকার। তারা বলেছেন, এ বাঁধ হলে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না! ২৬. এ বছর ১৩টি ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে মুনাফা কমেছে আটটির (জাতীয় দৈনিক ২/৮/১২)। ২৭. চিকিৎসাব্যবস্থার মান দেখে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল ভার্সিটির ভিসির উক্তি মনে পড়ে, ডাক্তাররা মানবতাবোধ হারিয়ে ফেলেছেন। জাতীয় চরিত্র নষ্ট হয়ে গেলে যা হয়, তাই ঘটেছে দেশে (জাতীয় দৈনিক ৪-৯-১২)। ২৮. ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে না ২২ বছর। ছাত্ররা গণতন্ত্র শিখবে কিভাবে? (২১-৭-১২ জাতীয় দৈনিকের সংবাদ)। ২৯. নগর পরিকল্পনাবিদদের গবেষণা তথ্যে প্রকাশÑ প্রতি ঘণ্টায় যানজটের কারণে ৭২ হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট। (জাতীয় দৈনিক ২৭/৭/১২)। ৩০. ডিশ কালচারে বাংলা ভাষার অপমৃত্যু ঘটবে, হিন্দি ভাষার উত্থান ঘটবে কলকাতার মতো। বলিউড ছবির আগ্রাসন আরো এগিয়ে যাবে। হিন্দি ভাষায় ডাবিং করে জাপানি ‘ডোরেমন’ কার্টুন সিরিয়ালটি দেখানো হচ্ছে। স্যাটেলাইট সংক্রান্ত নীতিমালা নেই। (জাতীয় দৈনিক ১৮/৮/১২)। ৩১. ১১ জন মন্ত্রী ও ৪৮ এমপিকে সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ। ঢাকায় জমি আছে এমন ১১ জন এমপিও প্লট পেয়েছেন। ছয়জন এমপি নিয়েছেন দুটি করে। এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন (জাতীয় দৈনিক ১২-৮-১২)। ৩২. ২০০৭ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ঢাকায় আট হাজারের বেশি বেওয়ারিশ লাশ দাফন। জাতীয় দৈনিক ২৯-৮-১২)
মনীষী বার্টান্ড রাসেল বলেছিলেনÑ ‘কোনো বড় ধরনের বিপর্যয় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উত্তরণে সুশাসনের রাষ্ট্রে পাঁচ বছরই যথেষ্ট। কিন্তু একটি দেশ যদি অবক্ষয়ের অতলান্তে তলিয়ে যায় তাহলে এক শতাব্দীতেও সেখান থেকে জাতিকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়।’ বাংলাদেশের বর্তমান চালচিত্র দেখে অনেকটা সে রকমই মনে হচ্ছে। আমরা সামাজিকভাবেই চরিত্র হারিয়ে ফেলেছি বিধায় সর্বস্তরে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে।
উল্লিখিত ৩২টি ঘটনার মধ্য দিয়ে জাতীয় চরিত্রের অবনতির চিত্রটি দিবালোকের মতো ফুটে উঠছে। দর্পণে চেহারা দেখলে যেমন নিজেকে উপলব্ধি করা যায়, তেমনি দেশের চেহারা দেখলে আমাদের সামষ্টিক চরিত্র সচেতন মানুষমাত্রই উপলব্ধি করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে বলব, আপনি ইতিহাসের পাতা ওল্টালে ভালো করবেন। আমাদের দেশে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় আসে, বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে গিয়ে যেসব কর্মকাণ্ড করে, তাতে নিজেদের পরিণাম কখনো ভালো হয় না। এই উপলব্ধি রাষ্ট্রযন্ত্রের চালিকাশক্তির মধ্যে এলে তাতে নিজেদের জন্য যেমন মঙ্গল, তেমনি রাষ্ট্রের জন্যও।
লেখক : গ্রন্থকার, কলামিস্ট
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন