শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১২

রাবি ছাত্রলীগের অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ প্রসঙ্গে রাজশাহী পুলিশ :


 অস্ত্র প্রদর্শন করলে কিছু করার নেই সশস্ত্র ধরা পড়লেই কেবল মামলা


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি শিবিরের ওপর হামলার সময় ছাত্রলীগ ক্যাডাররা হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সামনে প্রকাশ্যে ভয়ংকর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করলেও সেই অস্ত্রধারীদের কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি। ছাত্রলীগের অস্ত্রবাজির ৩ সপ্তাহ পর এখন পুলিশ বলছে, অস্ত্র প্রদর্শণ করলে কিছু করার নেই। শুধু অস্ত্রসহ ধরা পড়লেই মামলা করা যাবে। রাবি ভিসি প্রফেসর এম আবদুস সোবহান বলেছেন, ক্যাম্পাসে সব ছাত্র সংগঠনের কাছেই অস্ত্র আছে।
ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, গত ২ অক্টোবর শিবিরের বিরুদ্ধে হামলার সময় ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে অন্তত ১৩ অস্ত্র ছিল।
অস্ত্রসহ ক্যাডারদের সচিত্র ছবি প্রকাশ করা হয় গণমাধ্যমে। তবে পুলিশ তার একটি অস্ত্রও উদ্ধার করেনি। অন্যদিকে ছাত্রলীগের নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ওপর মহলের নির্দেশে শিবিরকে প্রতিহত করতে ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মজুত আরও বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে ছোট-বড় অন্তত ২২টি আগ্নেয়াস্ত্র ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দখলে। ঈদের পর আরও বেশ কয়েকটি অস্ত্র নতুন করে আনা হবে। যেকোনো মূল্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরকে প্রতিহত করতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সব অভ্যন্তরীণ ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এমনটিই সরকার ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ঈদের পরই যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটককৃত জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় শুরু হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ছাত্রশিবির সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে—এমন আশঙ্কাও করা হয়েছে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। এ জন্য রাবি ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও।
গত ২ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের মধ্যকার সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা যে অস্ত্রের প্রদর্শন করেছে এর আগে এ রকম অস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনা ক্যাম্পাসে আর কখনও ঘটেনি। ছাত্রলীগের অন্তত ১৩ নেতাকর্মীর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র (পিস্তল) ছাড়াও অন্যান্য ধারাল অস্ত্র দেখা গেছে। এসব পিস্তল দিয়ে পুলিশের সামনেই শিবিরকর্মীদের লক্ষ্য করে অন্ততপক্ষে ৫০ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয় এবং বারবার সেগুলোয় গুলি লোড করা হয়। এতে শিবিরের সেক্রেটারিসহ ৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিগুলোয় ওইদিন বিদেশি অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণও মিলেছে।
রাবিতে দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে অস্ত্রের রাজনীতি ছিল না। হঠাত্ করেই এত অস্ত্র এলো কোথা থেকে—এ প্রশ্ন যেমন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত বিষয়। পুলিশের সামনেই এত অস্ত্রের প্রদর্শনের পর তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এসব অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার করেনি।
ওইদিনের ঘটনায় অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে নগরীর মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, ‘ওইদিন অস্ত্র প্রদর্শন হয়েছে আমরাও জানি। অস্ত্র প্রদর্শণ করলে কিছু করার নেই। শুধু অস্ত্রসহ ধরা পড়লেই মামলা করা যাবে। কিন্তু অস্ত্র পাওয়া না গেলে কিংবা কারও বিরুদ্ধে মামলা না হলে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না।’ তবে তার দাবি এ জন্য পুলিশের একটি টিম কাজ করছে। এ ব্যাপারে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার এসএম মনিরুজ্জামানের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রাবি প্রক্টর অধ্যাপক চৌধুরী মুহম্মদ জাকারিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভিসির সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে বলেন তিনি শুধু ক্যাম্পাসের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন, আর সবকিছুতে ব্যবস্থা নেন ভিসি। প্রক্টর হিসেবে তার নিজস্ব ক্ষমতায় ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কোনো ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা থাকলে কী মানুষ আমাকে অপমান করতে পারে? উল্লেখ্য, সংঘর্ষের দিন অস্ত্রধারীরা প্রক্টরের কলার ধরে টানাটানি এবং তাকে মারধরও করেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর এম আবদুস সোবহান বলেন, আমরা কোনো ছাত্রকে গ্রেফতারের অধিকার রাখি না। শুধু ছাত্রত্ব বাতিল করতে পারি। ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে অস্ত্র ব্যবহারকারীদের গ্রেফতারের বিষয়ে তিনি বলেন, সবদলের কাছেই অস্ত্র আছে। ঘটনার তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মজুত গড়ছে ছাত্রলীগ : এদিকে গত ২ অক্টোবর ক্যাম্পাসে শিবিরের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মজুত আরও বাড়ানো হয়েছে। ছাত্রলীগের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, আগের ১৩টি অস্ত্রের পাশাপাশি গত তিন সপ্তাহে প্রায় ৯টি অস্ত্র যোগ করে বর্তমানে ছোট-বড় প্রায় ২২টি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন আবাসিক হলে অবস্থান করছে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। ছাত্রলীগের বর্তমান মজুতের সঙ্গে ঈদের পর আরও বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র যোগ হবে।
যে কোনো মূল্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরকে প্রতিহত করতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সব অভ্যন্তরীণ ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এমনটিই সরকার ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ঈদের পরপরই যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটক ও বিচারাধীন জামায়াত নেতাদের বিচার প্রায় শেষ পর্যায়ে এসেছে। বিচারের রায় ডিসেম্বরেই শুরু হবে। ওই রায়ে জামায়াতের কোনো নেতার ফাঁসি কিংবা বড় ধরনের শাস্তি হলে জামায়াত-শিবির সারাদেশে বেপরোয়া হয়ে উঠবে। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ছাত্রশিবির সরকার বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে এমন আশঙ্কাও করা হয়েছে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। এজন্য রাবি ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও।
অভিযোগ রয়েছে, এজন্য সম্প্রতি রাবিতে ছাত্রলীগের প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজির পরে মিডিয়াতে ব্যাপক সমালোচিত হওয়ায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ রাবি ভিসিকে ফোনে অস্ত্রবাজদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেও সেটি আমলেই নেয়া হয়নি। জানা গেছে, শিক্ষামন্ত্রীর ওই বক্তব্যে সরকারের একটি মহল নাখোশ হয়েছেন। তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরকে প্রতিহত করতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় রাবি ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে অস্ত্র মজুতের খবর অস্বীকার করা হয়েছে। রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি আহম্মেদ আলী অস্ত্র মজুতের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ছাত্রলীগ কোনো অস্ত্রবাজির দল নয়। তারা শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী।
শিবিরের সভাপতি আশরাফুল আলম ইমন বলেন, প্রশাসন ছাত্রলীগের অপকর্মের বিচার করলে ক্যাম্পাসে আজকের এ অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হতো না। তারা বরাবরই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনকে মদত দিয়ে যাচ্ছে। শিবিরকে প্রতিহত করতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশেই ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মজুত বাড়ানো হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন খান বলেন, ‘যারা মানুষ মেরে ফেলতে পারে, তারা ছাত্র হতে পারে না। এরা সন্ত্রাসী। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেবল দায় সারাভাবে তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে তামাশা দেখাবে, তা হতে পারে না।’ ছাত্রদলের আহ্বায়ক আরাফাত রেজা আশিক বলেন, ‘প্রশাসন চার ছাত্র হত্যা ও সর্বশেষ ছাত্রলীগের অস্ত্রবাজির ঘটনার কোনোটিরও সুরাহা করেনি। এ কারণে হত্যা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম মারাত্মক হারে বাড়ছে।
কোথায় কয়টি অস্ত্র : বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে ও বিভিন্ন সূত্রে নতুন অস্ত্র আসার আগে কার কার হাতে অস্ত্র ছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সমর্থক বলে পরিচিত ১৩ জনের কাছে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে সভাপতি সমর্থক পাঁচ নেতার কাছে রয়েছে ৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। তারা হলেন, বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম তৌহিদ আল হোসেন ওরফে তুহিন, মাদার বখশ হল শাখার সভাপতি যুবায়ের ইবনে তানিম, উপ-দফতর সম্পাদক আতিকুর রহমান আতিক, উপ-পাঠাগার সম্পাদক নাসিম আহমেদ সেতু ও কর্মী কৌশিক আহমেদ। এ ৫ জনই ২ অক্টোবর সংঘর্ষের সময় তাদের অস্ত্র প্রদর্শন করেছে ও গুলি ছুড়েছে। এরা সবাই বর্তমানে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন আবাসিক হলে অবস্থান করে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে। প্রতিটি আবাসিক হলের গেটে ১২ থেকে ১৫ জন পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকলেও তাদের সামনেই এসব অস্ত্রধারী প্রতিনিয়ত ঘুরাফেরা করছে। এদের মধ্যে তুহিন মাদার বখশ হলের ২৪০ নম্বর কক্ষে, তানিম ২৪৩ নম্বর কক্ষে, সেতু বঙ্গবন্ধু হলে, কৌশিক নবাব আবদুল লতিফ হলে বর্তমানে অবস্থান করছে। আতিকের অবস্থান জানা যায়নি। গতকালও তুহিন, তানিম ও কৌশিককে প্রকাশ্যে ক্যাম্পাসে ঘুরাফেরা করতে দেখা গেছে। ক্যাম্পাস সূত্রগুলো জানিয়েছে, এরা সবাই দিন-রাতে ক্যাম্পাসে চলাফেরা করার সময়ও অস্ত্র বহন করে। কখনও কখনও অনুসারীদের মাধ্যমেও বহন করে। এসব কিছু পুলিশ প্রশাসন জানার পরও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। এ নিয়ে রাজশাহীর সবমহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্র মতে, সংঘর্ষের সময় সাধারণ সম্পাদকের সমর্থক বলে পরিচিতদের মধ্যে বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি আখেরুজ্জামান তাকিম, শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক নূর জাহিদ সরকার নিয়ন, যুগ্ম সম্পাদক এবি এম আমিন, সহ-সভাপতি সুদীপ্ত সালাম ওরফে বাইট্টা সালাম, গণযোগাযোগ সম্পাদক আরিফুজ্জামান আরিফ ও কর্মী রাজিবের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলে ওই নেতারা জানান। এদের প্রত্যেকেই ২ অক্টোবরের সংঘর্ষের সময় গুলিবর্ষণ করেছেন। এরাও সবাই বর্তমানে ক্যাম্পাসে অবস্থান করছে। এদের মধ্যে তাকিম শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে, সালাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ১৩০ নম্বর কক্ষে, একই হলে নিয়ন, আরিফ ও রাজিব এবং আমিন শেরেবাংলা হলে অবস্থান করছে। এছাড়া সাধারণ সম্পাদক সমর্থক বলে পরিচিত আরও ৪ পদধারী নেতার কাছে অস্ত্র রয়েছে বলে সূত্র জানায়।
ছাত্রলীগের ভয়ঙ্কর নেতাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ: অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদের বেশিরভাগই অছাত্র, অস্ত্রবাজ, সন্ত্রাসী, দাগি খুনি, সংগঠন থেকে নানা অপরাধে বহিষ্কৃত নেতাকর্মী ও ছাত্রলীগ নামধারী বহিরাগত। অভিযোগ রয়েছে, এসবের নেপথ্যে সংগঠনের শীর্ষ সারির নেতারা থাকলেও তারা মাঠে থাকেন না। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি ছাত্রলীগেরই এক পক্ষের কর্মীদের হামলায় আরেক পক্ষের দু’জন কর্মী নিহত হলেও পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। বরং উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে এসে ওই হত্যাকারীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো ক্যাম্পাস। বহিষ্কৃত ও অছাত্র ওই নেতাকর্মীরা দলের অন্য নেতাকর্মীর সঙ্গে মিলে কখনও সরাসরি, কখনও নেপথ্যে থেকে যুক্ত হয়ে পড়েছেন ক্যাম্পাসের ভেতরে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নিয়োগ ও হলের সিট-বাণিজ্য, যৌন হয়রানি, ছিনতাই, নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ, অস্ত্রবাজি, পুলিশ, সাংবাদিক ও সাধারণ লোকজনকে মারধরসহ নানা অপকর্মে। শুধু ক্যাম্পাসের ভেতরেই নয়, ক্যাম্পাসের বাইরেও ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত তারা।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত তাকিম ও তুহিন, আরিফ, ফিরোজ সরকার, বাইট্ট্যা সালাম, সেতু, তানিম, আতিক, সেলিম, রাজিবসহ আরও কয়েকজনের নাম।
সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইন বিপুর ডানহাত হিসেবে পরিচিত বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি আখেরুজ্জামান তাকিম। বিপুর সেকেন্ড ইন কমান্ড গণ্য করা হয় তাকে। বিপুর অনুপস্থিতিতে ক্যাম্পাসে তার হয়ে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন তাকিম। তার বাড়ি সৈয়দপুর। ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে তিনি রাবিতে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। রাজনীতি করতে গিয়ে তাকিম ক্লাসে ন্যূনতম দিন উপস্থিত না থাকার কারণে প্রথমবার প্রথমবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে ব্যর্থ হন। একই কারণে পরের দুই বছরও পরীক্ষা না দিতে পারায় তাকিমের ছাত্রত্ব প্রথমবর্ষেই বাতিল হয়ে যায়। এর পরও বিপুর ছত্রচ্ছায়ায় ক্যাম্পাসে অবাধে টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি ও যৌন হয়রানির মতো অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন তাকিম। সোহেল হত্যাকাণ্ডের দিন সংঘর্ষে জড়িত থাকা ও গুলি করার অভিযোগে তাকে সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। তাকিম প্রথম থেকেই ক্যাম্পাসে বিভিন্ন হামলার নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।
তাকিমের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষিকা জিন্নাতুন নাহারকে যৌন হয়রানির মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তার ছাত্রত্ব না থাকায় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার শিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় তাকিম কখনও রামদা, কখনও পিস্তল নিয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি করেন। তিনি একাই অন্তত ১৫-২০ রাউন্ড গুলি ছুড়ে ক্যাম্পাসে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা বিচারাধীন।
সভাপতি আহম্মেদ আলীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম তৌহিদ আল হোসেন ওরফে তুহিন। ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ছাত্র তুহিনকে গত ১৫ জুলাই ছাত্রলীগকর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান সোহেল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। তুহিনের বাড়ি রাজশাহী’র বাঘায়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের চূড়ান্তবর্ষের শিক্ষার্থী। গত মঙ্গলবারের পুরো সংঘর্ষে তুহিন নেতৃত্ব দেন। ছাত্রলীগের অন্য অনেক ক্যাডারকে তুহিন বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করেন। অভিযোগ রয়েছে, তুহিন ব্যক্তিগতভাবেই অনেক অস্ত্র কিনেছেন।
তুহিন সোহেল হত্যা মামলার প্রধান আসামি। তিনি গত বছর নগরীর ভদ্রা এলাকায় সংঘটিত একটি বাড়িতে ডাকাতি মামলারও আসামি। গত মঙ্গলবার সংঘর্ষের সময় তুহিনই কখনও পিস্তল, কখনও রামদা হাতে ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ সভাপতি আহম্মেদ আলীর অনুপস্থিতিতে তুহিনই সব কিছুর নেতৃত্ব দেন বলে সংগঠনের একাধিক নেতাকর্মী নিশ্চিত করেছেন। সভাপতির আশীর্বাদপুষ্ট তুহিন ক্যাম্পাসে অত্যন্ত প্রতাপশালী ও অস্ত্রবাজ হিসেবে পরিচিত। প্রশাসনেও রয়েছে তার একচ্ছত্র প্রভাব।
সোহেল হত্যাকাণ্ড ও সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় তুহিন পুলিশের সামনেই ব্যাপক গুলি ছোড়ে। পরদিন সেই তুহিনই বাদী হয়ে ছাত্রশিবির নেতাকর্মীদের নামে মতিহার থানায় সহিংসতা সৃষ্টির অভিযোগে মামলা করেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads