মঙ্গলবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১২

সহজ কথা,মুখ বন্ধ করার চেষ্টা



বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আবার হুমকির মুখে পড়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের এই অসহিষ্ণুতা দলটির ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়েছে। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে নানারূপে ও মাত্রায় এর পুনরাবৃত্তি হয়। কিছু দিন থেকে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা মিডিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলছেন। মধ্যরাতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে যে আলোচনা ও সমালোচনা হয় তাতে তারা বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সিঁদ কাটার জন্য চোরেরা যেমন মধ্যরাতে বের হয় তেমনি টকশোতে যারা অংশ নিতে যান তারা ক্ষমতাসীন দলের গলা কাটতে যান। এরপর প্রধানমন্ত্রী তার অনুষ্ঠানে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে টেলিভিশন চ্যানেল অবশ্য নিষিদ্ধ করার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় বিএনপির এক নেতার মালিকানাধীন একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দীর্ঘ দিন অনুষ্ঠানে ঢুকতে দেয়া হয়নি। পরে অদৃশ্য আপসরফার মাধ্যমে অনুমতি দেয়া হয়। আরো একটি টেলিভিশন চ্যানেল সরকার গঠনের পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান কাভার করা বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢোকার অনুমতি পায়নি। তবে এবার একটি বা দু’টি নয় সব বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে এ নিয়ে বেশ হইচই হচ্ছে।
আবার যারা টেলিভিশনে টকশোতে কথা বলছেন তারা বিরোধী দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এমনো নন। এদের অনেকে এক সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং সরকারের প্রতি তারা বেশি সহানুভূতিশীল।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে যেকোনো বিষয় নিয়ে সামান্যতম নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে কথা বললে সরকারের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। দেশের সাম্প্রতিক আলোচিত ঘটনা যেমন ইলিয়াস আলী গুম, সাগর-রুনি হত্যা, রেল কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বৌদ্ধ বসতিতে আগুন দেয়ার মতো বিষয়ে আলোচনায় সরকারের পক্ষে কিভাবে আলোচকেরা কথা বলবেন? এসব ঘটনাকে নিশ্চয়ই সরকারের সাফল্য হিসেবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। এর পরও সরকারের কর্মকাণ্ডে জোরদার সাফাই গাইবেন এমন সরকার সমর্থক আলোচকেরা আর টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হতে চাইছেন না। এমনকি সংবাদপত্রে সরকারের পক্ষে লেখালেখিও তারা কমিয়ে দিয়েছেন। আবার এ ধরনের লেখক-আলোচকের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে।
এ অবস্থায় টকশোর আলোচনা সরকারের বিবেচনায় তাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ টেলিভিশন চ্যানেল সরকার সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও দু-একটি অনুষ্ঠানের আলোচনা সরকার সহ্য করতে পারছে না। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে অনেকটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এবারই প্রথম নয়, এর আগেও টকশোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চিন্তাভাবনা হয়েছে। কারা টকশোতে আসতে পারবেন কারা পারবেন না তার অলিখিত নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল ঝুঁকি বিবেচনা করে বেশ কিছু দিন টকশো প্রচার বন্ধ রেখেছিল।
টকশোর সমালোচনা কিংবা প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান কাভার করার এই বিধিনিষেধের চেয়েও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ওপর আরো বড় ধরনের আঘাত এসেছে। কিন্তু সেসব আর আলোচনায় আসে না। এর মধ্যে দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, চ্যানেল ওয়ান বন্ধ হয়ে গেছে। টকশো নিয়ে যখন আলোচনা চলছে তখন আবার আমার দেশের সাংবাদিকদের পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দুই বছর আগে গ্রেফতারের সময় পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে যে মামলা হয়েছিল সেই মামলায় জামিনে থাকা সাংবাদিকদের জামিন বাতিল করে এই রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।
একটি খবর প্রকাশকে কেন্দ্র করে ২০১০ সালের জুন মাসে আমার দেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। গ্রেফতার করা হয়েছিল সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। দেশের আনাচে-কানাচে তার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছিল। জেলবন্দী অবস্থায় দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ধরনের হয়রানি ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে তখন দেশের সাংবাদিকসমাজের যে ধরনের সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত ছিল তা হয়নি। এর প্রধান কারণ আমার দেশ ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা করেছিল বলে তারা জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেনি। আজকে যে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে না এগুলোর প্রায় সবই ঘোরতর সরকার সমর্থক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদেরও একই পরিণতি বরণ করতে হচ্ছে। তখন এই টেলিভিশন চ্যানেলগুলো গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে কোনো জোরালো অবস্থান নেয়নি বরং অনেকে পরোক্ষভাবে সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। অনেক সাংবাদিক নেতা ও সম্পাদক আদালতের ভাষায় মাহমুদুর রহমানের সম্পাদক হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে আমার দেশ তার প্রকাশনার অধিকার ফিরে পেয়েছে। আইনের বাইরে গিয়ে মাহমুদুর রহমানকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। শুধু সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেল নয়, সরকার ফেসবুকের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তখন ডিজিটাল যুগের সাংবাদিকেরাও নিশ্চুপ ছিলেন।
গণমাধ্যমের ওপর ক্ষমতাসীনদের এই  আচরণ নতুন নয়। বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। কারণ পাকিস্তানি শাসকচক্র বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের অদূরদর্শিতা, রাষ্ট্র পরিচালনায় অযোগ্যতা ও  ক্ষমতার মোহের কারণে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল তা ধূলিসাৎ হয়েছিল। একদলীয় শাসনের পথে আওয়ামী লীগ পা বাড়িয়েছিল। এ জন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পাশাপাশি সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র তখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কারারুদ্ধ হয়েছিলেন গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক আল মাহমুদ।
বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে সে সময়ের দিকে। তখন কেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল? তখনো দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। ঘুষ, দুর্নীতি চোরাকারবারির সাথে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রতিদিন খবর প্রকাশ হচ্ছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বিরোধের জের ধরে একের পর এক খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। আবার কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ওপর বিরোধী দল সমর্থকরাও হামলা করেছে। এর ফলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর কোনোভাবেই সরকারের পক্ষে যাচ্ছিল না। মনে রাখতে হবে সে সময় এত টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না, এত সংবাদপত্র বা অনলাইন গণমাধ্যম ছিল না, মোবাইল ফোন ছিল না। দেশের শিক্ষার হারও এখনকার চেয়ে কম ছিল অর্থাৎ একটি জেলা শহরে গুটিকয়েক লোক সংবাদপত্র পড়ত। কিন্তু তার পরও সরকার সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিল।
’৭২-৭৪ সময়ে দেশের যে পরিস্থিতি ছিল এখনো দেশে সে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সে সময়ের মতো অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, ব্যাংক থেকে লুটপাটের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, হত্যা, গুমের মতো ঘটনা ঘটছে। সে সময় এসব অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধে সরকার সমর্থক বিশাল বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় নিশ্চুপ ছিলেন। তারা সরকারের সমালোচনা করেননি বা সরকারকে সুপরামর্শ দেননি। বরং কিভাবে সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের সুবিধা নেয়া যায় তা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এখনো এই বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চুপ আছেন। যে দু-একজন কথা বলছেন তাদের চোর-ছ্যাচ্চোরের সাথে তুলনা করা হলেও এরা প্রতিবাদ পর্যন্ত করার সাহস দেখাচ্ছে না।
’৭২-৭৪ সালের সেই সময়ের কথা এখন আর আলোচনা হয় না। সংবাদপত্র দলনের সেই ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। আজকের তরুণ সাংবাদিকেরা সে সময়ের কথা আর মনে করতে চান না। এই তরুণ সাংবাদিকদের বড় একটি অংশ ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক বিশ্বাস লালন করেন। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিশ্বাস আর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা একসাথে চলে না। ফলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে তাদের সোচ্চার হতে হবে। না হলে গৃহপালিত গণমাধ্যমের ভূমিকায় তাদের অবতীর্ণ হতে হবে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ বাকশালের চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়নি। কিন্তু এই বাকশাল ব্যবস্থা কায়েম করতে গিয়েই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। সেই চেতনার অংশ হিসেবে এখনো গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে খই ফোটে। গণমাধ্যম বন্ধ করা বা নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টার অর্থ হচ্ছে মানুষের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা। কথা বলার স্বাধীনতা হরণ করা। বর্তমান সরকার এখন কৌশলে সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads