মঙ্গলবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১২

রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন বন্ধ কর : আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ জরুরি



মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অসহায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নৃশংস আক্রমণ চলছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এ ধরনের আক্রমণ ও বিতাড়ন একটি চরম মানবিক বিপর্যয়। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের লক্ষ্য যদি বাংলাদেশ হয়, তাও উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ বটে। সম্প্রতি আবার রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাংলাদেশী অভিবাসী বলে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। এদিকে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসতে নিষ্ঠুরভাবে বাধা দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে সমস্যায় পড়তে চান না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ অবস্থায় মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করতে এবং তাদের অন্যায়ভাবে বিতাড়ন বন্ধে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসাই সমস্যা নিরসনের জন্য জরুরি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত সপ্তাহে শুরু হওয়া দাঙ্গায় অন্তত ৮৮ জন নিহত এবং ২৮ হাজার রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়েছে বলে জাতিসংঘের দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে। এদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতিগত দাঙ্গায় ধ্বংসযজ্ঞের স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশের পর মিয়ানমার সরকারও সহিংসতায় ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
২৯ অক্টোবর মিয়ানমারে জাতিসংঘ দফতরের প্রধানও নিহত ও গৃহহীনদের প্রসঙ্গে বলেছেন, এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কেননা, সহিংস আক্রমণে উপকূলীয় এলাকার অনেক লোক নৌকাযোগে পালিয়ে গেছে, যাদের হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র বলেছেন, রাখাইন রাজ্যের সব গ্রাম ও শহরের কিছু অংশ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সরকার রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করেছে। কিন্তু ভুক্তভোগী অনেকের অভিযোগ : দাঙ্গাকারীদের সহায়তা করেছে মিয়ানমার পুলিশ, এমনকি তারা গুলিও ছুড়েছে। উল্লেখ্য, এর আগে গত মে মাসে একজন বৌদ্ধ নারীকে কয়েকজন মুসলমান ধর্ষণ করেছে বলে পরিকল্পিত গুজব ছড়িয়ে পড়লে জাতিগত দাঙ্গা বাধে এবং মারা যান ৯০ জন। সহিংসতা থামাতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় রাখাইন রাজ্যে। এরপরেও নতুন করে দাঙ্গার কারণ কী?
বরাবরের মতো এবারও রোহিঙ্গা মুসলিম জনগণ সব হারিয়ে বাংলাদেশের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছে। হাজার হাজার নির্যাতিত ক্ষুধার্ত মানুষ ভাসছে নদীতে, সমুদ্রে। তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই।
এই দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি যে কোনো বিবেচনায় মিয়ানমারের সৃষ্ট। এজন্য সমস্যা মেটানোর দায় তাদেরই নিতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মিয়ানমার সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট মনোযোগী নয়। কেননা, রোহিঙ্গা সমস্যা নতুন কিছু নয়। এই সমস্যার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের ওপর কী মন্দ প্রভাব ফেলে, সে সম্পর্কেও মিয়ানমার সরকার অবহিত। তারপরও দফায় দফায় জাতিগত দাঙ্গার শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কেন—এর জবাব মিয়ানমার সরকারই ভালো জানে। সম্প্রতি মিয়ানমারের সেনা সমর্থিত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এই জাতিগত দাঙ্গাজনিত সমস্যার একটি ভয়াবহ সমাধানের কথা জানিয়েছেন। তার ভাষায়, রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমার থেকে বিতাড়ন’ এর সমাধান। এ থেকে স্পষ্টতই আঁচ করা যায় যে, রোহিঙ্গারা প্রকৃতপক্ষেই উগ্র বর্ণবাদী আচরণের কবলে পড়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মিয়ানমারের এক সময়ের আরাকান রাজ্যে শত শত বছর ধরে বসবাস করে আসছে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী। ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত তারা সে দেশের নাগরিক ছিল। অথচ মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করছে। এই অস্বীকৃতি ইতিহাসের বিচারে যেমন তেমনি আধুনিক আইনের দৃষ্টিতেও স্ববিরোধী এবং বর্ণবিদ্বেষজাত। সম্প্রদায়বিশেষের ওপর এভাবে দফায় দফায় মানবিক বিপর্যয় চাপিয়ে দিয়ে সে দেশের সরকার যে নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের অভিসম্পাত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দাই কুড়াচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই।
যে কোনো বিচারেই রোহিঙ্গা বিতাড়নের কারণ হচ্ছে জাতিগত বৈরিতার ফলাফল। এর সমাধান বস্তুত মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। তবে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশকেও এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে, রোহিঙ্গা সমস্যার স্বরূপ তুলে ধরতে হবে বিশ্ববাসীর কাছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের কেন বাংলাদেশী অভিবাসী বলছে, কেন এমন প্রচারণা চালাচ্ছে—তার বিরুদ্ধেও বাংলাদেশকে নিতে হবে কঠোর অবস্থান।
আমরা মনে করি রোহিঙ্গা সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের বেদনার্ত ঘটনা। আগুনে ভস্মীভূত জনপদের পর জনপদে গণহত্যার শিক্ষার শত শত নিরাপরাধ মানুষের লাশ ফেলে রেখে বিশ্ববাসী উদাসীন থাকতে পারেন না। এর দ্রুত সমাধান জরুরি। মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছার অভাবে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ থেকেই বেরিয়ে আসবে এ সমস্যার সমাধান। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের বর্তমান হৃদয়হীন শাসকরাও হয়তো তখন তাকে স্বাগত জানাবে

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads