মঙ্গলবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১২

প্রধানমন্ত্রী বলছেন, খেলা শুরু হয়ে গেছে



সাদেক খান
প্রধানমন্ত্রী বলছেন, খেলা শুরু হয়ে গেছে
রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, দখলবাণিজ্যের দাপট, ছিনতাই, ডাকাতি, গুমখুনের আতঙ্ক, বছরে কয়েক ধাপে বিদ্যুতের দাম কয়েক গুণ বাড়ানোর পরও লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা, প্রায় সবগুলো শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রাবাসে দলীয়-উপদলীয় সংঘর্ষের খেসারত আর দ্রব্যমূল্যের যাঁতাকল, বাড়ি ভাড়ার চক্রবৃদ্ধিÑ এসব মিলিয়ে দুঃসময়ের যে সমাজচিত্র প্রতিদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে, তার সাথে এখন পাকাপাকিভাবে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক যুদ্ধাবস্থা আর সাংবিধানিক অচলাবস্থার আশঙ্কা। দ্বিধাবিচ্ছিন্ন মূলধারার দুই মেরুর বাকযুদ্ধ আর মামলা-হামলা, দোষারোপের পালায় মানুষ অভ্যস্ত। এখন সার্বিকভাবে মূলধারার রাজনীতিতে নেতৃত্বের ক্ষুদ্র স্বার্থপরায়ণতা আর ব্যর্থতার কথা জোরেশোরেই আসছে সুশীলসমাজের তরফে টেলিভিশনের টকশোতে আর বিভিন্ন বৈঠক-সেমিনারে। খোদ প্রধানমন্ত্রীই বলছেন, ‘খেলা’ শুরু হয়ে গেছে। আর বিরোধী দল বলছে, সরকার পড়ে যাচ্ছে। আসছে কে?
এরই মধ্যে একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে জনমনে হাল আমলের জনপ্রতিনিধিদের সদাচার-দুরাচারের ধারণাভিত্তিক একটা জরিপ। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) বাংলাদেশী অঙ্গ সংগঠন টিআইবি ১৪ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে সংসদ সদস্যদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক কাজের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৪৯ জন সংসদ সদস্যের ওপর (সরকারি দলের ১৩৬ ও বিরোধী দলের ১৩ জন) পরিচালিত গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, সংসদ সদস্যদের ৯৭ শতাংশই  হত্যা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার, উন্নয়নকাজে কমিশন গ্রহণ থেকে শুরু করে কোনো না কোনো নেতিবাচক কাজের সাথে জড়িত। আবার তাদের মধ্যে ৫৩.৫ শতাংশ সরাসরি হত্যা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলের মতো ভয়াবহ অপরাধের সাথে জড়িত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যদের কাজের সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা, সংসদ এবং সংসদের বাইরে সংসদ সদস্যদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক কাজের পর্যালোচনার জন্য এ গবেষণা করা হয়েছে। গবেষণায় ১৪৯ জন সংসদ সদস্যকে নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের ১৩৬ এবং বিরোধী দলের ১৩ জন। তাদের নিয়ে সাতটি বিভাগের ৪২টি জেলায় ৪৪টি দল গঠন করে আলোচনা করা হয়। শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী ও অন্যান্য পেশার মোট ৬০০ জন্য ব্যক্তি আলোচনায় অংশ নেন। তবে কী প্রক্রিয়ায় এই ৬০০ লোক নির্বাচন করা হয়, তা বলা হয়নি কিংবা ওই ১৪৯ জন সংসদ সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তাদের কোনো বক্তব্যও প্রতিবেদনের জন্য নেয়া হয়নি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংসদ সদস্যদের নেতিবাচক কাজের মধ্যে রয়েছেÑ প্রশাসনিক কাজে প্রভাব বিস্তার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার, হত্যা, দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, প্রতারণা, সরকারি কেনাকাটায় প্রভাব বিস্তার, নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করা, মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ পাওয়া ইত্যাদি। তথ্যের প্রত্যক্ষ উৎস হিসেবে সাতটি বিভাগের ৪২টি জেলায় দলনিরপেক্ষ সচেতন জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে ৪৪টি দল গঠন করে আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ৬০০ ব্যক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতাভিত্তিক তথ্য ও মতামত গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে নেয়া হয়। পরোক্ষ উৎস হিসেবে সংবিধান, সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি, আইন ও বিধি, প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত প্রবন্ধ, অনলাইন ও পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে।
আলোচিত সংসদ সদস্যদের ৮১ দশমিক ৮ শতাংশ প্রশাসনিক কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বদলি ও নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেন। এসব সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে খুব কম ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে। কোথাও কোথাও সংসদ সদস্যরা পাল্টা মামলা করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের চাপে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। উল্লিখিত সংসদ সদস্যদের ৭৬ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার, কমিটি নিয়ন্ত্রণ, পছন্দের সদস্য নির্বাচন, শিক্ষক নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ, অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেয়া, কমিশনের বিনিময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বরাদ্দের অপব্যবহার ইত্যাদি দুর্নীতির সাথে জড়িত। এসব অনিয়মের ঘটনায় সংসদ সদস্যের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
১৪৯ সংসদ সদস্যের ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশ উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে স্থানীয় উন্নয়নকাজে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুবিধা নেয়া, নিজস্ব কর্মীদের সুবিধা দেয়া, ভুয়া প্রকল্প ও প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ নেয়া, টিআর ও কাবিখা বিতরণে অনিয়ম ইত্যাদি আছে। এসব সংসদ সদস্যের মধ্যে ৭৮ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ অনুমোদন দিতে গিয়ে কমপক্ষে ৫ শতাংশ হারে কমিশন আদায় করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশি কমিশনের বিনিময়ে দলীয় কর্মীদের কাজ না দিয়ে অন্য দলের কর্মীদের দেয়া হয়। এই সংসদ সদস্যদের ৭০ দশমিক ৬ শতাংশ হত্যা, খাসজমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও প্রতারণার সাথে জড়িত। তাদের মধ্যে ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ সংসদ সদস্য নিজেরাই বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত। এসব সংসদ সদস্যের মধ্যে মাত্র ২৪ দশমিক ১ শতাংশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবের কারণে সংশ্লিষ্ট থানা মামলা গ্রহণ করেনি। সংসদ সদস্যদের ৬৯ দশমিক ২ শতাংশ জেলাপর্যায়ের সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। তাদের মধ্যে ৭১ দশমিক ৭ শতাংশ সংসদ সদস্য নিজের কিংবা আত্মীয়স্বজনের কিংবা অন্যের লাইসেন্স ব্যবহার করে ঠিকাদারি ব্যবসায় পরিচালনা করেন। তারা দরপত্র কিনতে বা জমা দিতে বাধা দেয়া, সমঝোতার মাধ্যমে কাজ বণ্টনের সাথে জড়িত। ৬২ দশমিক ২ শতাংশ সংসদ সদস্য নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন এবং ৮ দশমিক ৪ শতাংশ সংসদ সদস্য মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ নেয়ার সাথে জড়িত।
প্রতিবেদনে সংসদ সদস্যদের ইতিবাচক দিকও তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ১৪৯ জন সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে ইতিবাচক কাজের সাথে জড়িত। এদের মধ্যে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ১৯ জন, ছয়জন নারী সংসদ সদস্য এবং বিরোধী দলের পাঁচজন সদস্যও আছেন। বলা হয়েছে, ৩৫ শতাংশ সংসদ সদস্য অবকাঠামো নির্মাণ, ভূমি বরাদ্দ, অনুদান বরাদ্দ, বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ, চরাঞ্চলে চিকিৎসাসেবা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি করার কাজে ভূমিকা রেখেছেন। ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ সংসদ সদস্য রাস্তা ও সেতু নির্মাণ, বিদ্যুৎব্যবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ সংসদ সদস্য উপকূলীয় এলাকায় জলদস্যু নিয়ন্ত্রণ, লবণাক্ততা দূর, নদীভাঙন রোধ, পাটকল চালু করা ইত্যাদিতে ভূমিকা রেখেছেন। ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ সংসদ সদস্য পরিবেশ রক্ষা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও কর্মসংস্থানে ভূমিকা রেখেছেন। বিরোধী দলের ১৩ জনের মধ্যে আটজনের কোনো ইতিবাচক কাজ দেখা যায়নি।
সাধারণভাবে এমপিদের বেশির ভাগের কাজে এলাকার মানুষ সন্তুষ্ট নন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে বিরোধী দলের সদস্যরা পিছিয়ে। তবে বিরোধী দলের সদস্যরা এলাকায় সময় দেন বেশি।
প্রতিবেদনটি সারা দেশে, বিশেষ করে রাজনৈতিক মহল ও সুশীলসমাজে নতুন করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের দুরাচার-দুর্নীতির বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে, মিডিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশের পর এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘টিআইবির এই প্রতিবেদনের সাথে অনির্বাচিতদের ক্ষমতায় আনার পথ তৈরির (কারিগরদের) যোগসাজশ রয়েছে। আর এই প্রতিবেদনের কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে আমরা মনে করি না। কারণ দু-একজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতেই পারে; কিন্তু এ জন্য ঢালাওভাবে দোষ দেয়া যায় না। ‘অন্য দিকে প্রধান বিরোধী দলের পক্ষে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, ‘বিরোধী দলের এমপিরা বরাবরই কোণঠাসা। তাই টিআইবির রিপোর্ট সরকারের এমপিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই প্রতিবেদনের জবাবও তাই তারাই দেবেন। সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের ব্যাপারে আমরা এত দিন যা যা বলেছি, তাই টিআইবির প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়েছে।’
টিআইবির প্রতিবেদন নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় চললেও শুরুতে সংসদ সচিবালয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি। রিপোর্ট প্রকাশের পর সংবাদমাধ্যমকর্মীরা স্পিকারের সাথে দেখা করে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে স্পিকার এ ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়া থেকে বিরত থাকেন। তবে দু’দিন বাদে ১৬ অক্টোবর সংসদ ভবন এলাকায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আগত সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ তার বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া দিয়ে বলেন :
‘দেশে ১৬ কোটি মানুষ, ৬৪টি জেলা। টিআইবি ৪২ জেলা এবং মাত্র ৬০০ লোকের মতামত নিয়ে জরিপ করেছে। কোনো মানদণ্ডেই এটিকে জরিপ বলা যায় না। অথচ এদের কথার ওপর ভিত্তি করেই টিআইবি বলে দিলো, ৯৭ শতাংশ সংসদ সদস্য খারাপ। এটা কি ঠিক হলো? আমার প্রশ্ন হলো, টিআইবি যে ৬০০ লোকের মতামত গ্রহণ করেছে, তারা কারা? এরা কি টিআইবির লোক? তা যদি হয়, তাহলে তো জরিপ বিজ্ঞানসম্মত হলো না। এ ধরনের প্রতিবেদন দেখে সংসদ সদস্য হিসেবে আমিও অপমানিত বোধ করছি। ৯৭ শতাংশ সংসদ সদস্য খারাপের অর্থ হলো ৩০০ সদস্যের মধ্যে মাত্র ৯ জন ভালো। এর অর্থ কি এই নয় যে, বাকি ২৯১ জন সদস্য সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন? এমন ঘটলে তো এত দিনে দেশের মানুষ রুখে দাঁড়াত। কারণ এ দেশের মানুষ যথেষ্ট সচেতন। কিন্তু সে রকম ঘটনা তো কোথাও ঘটেনি, দেখাও যায়নি।’
আসলে থেকে থেকেই কিন্তু দেশের মানুষ রুখে দাঁড়াচ্ছে। সেসব খবরও পত্রপত্রিকা টেলিভিশনে আসছে। স্পিকারের মন্তব্যের ‘জবাব’ দিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বর্তমানে টিআইবির চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল প্রশ্ন করেছেন, ‘যারা টিআইবির প্রতিবেদনটির বিষয়ে বিষোদগার করে যাচ্ছেন, তারা কি সেটা সম্পূর্ণ পড়েছেন? এর আগেও টিআইবির কিছু কিছু প্রতিবেদন নিয়ে যাদের প্রসঙ্গে কথা উঠেছে তারা ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ মন্তব্য করেছেন। টিআইবির বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে যারা মন্তব্য করেছেন, তারাও বলেছেন যে, সম্পূর্ণ প্রতিবেদন না পড়েই তারা গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। যখন কোনো ব্যক্তি বা দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের যে প্রতিক্রিয়া টিআইবি পায়, তারা যখন ক্ষমতার বাইরে থাকে, তখন ঠিক তার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। যেমন বর্তমান বিরোধী দল এই প্রতিবেদনকে তাদের কথার প্রতিফলন বলে দাবি করছে। বর্তমান সরকারেরই মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সম্প্রতি এক জনসভায় বলেছিলেন, টিআইবি সব সময়ই প্রতিবেদন দেয়, আমরা সরকারে থাকলে বলি নাউজুবিল্লাহ আর বিরোধী দলে থাকলে বলি আলহামদুলিল্লাহ।’
একটি লিখিত নিবন্ধে নানা তরফের সমালোচনার বিভিন্ন যুক্তি খণ্ডন করে সুলতানা কামাল সরাসরি স্পিকারকে উদ্দেশ করে খেদোক্তি করেছেন : “মাননীয় স্পিকার, আপনি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। আপনার আদেশ, উপদেশ, নির্দেশ উপেক্ষা করে, অসম্মান করে দিনের পর দিন বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে যায়, আপনার উপস্থিতিতে একজন সংসদ সদস্য অপর সংসদ সদস্যকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করেন, আপনাকে আমরা দেখি অসহায়ভাবে তাদের মানাতে চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের হেয়প্রতিপন্ন করতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের প্রয়োজন হয়? কারও কারও ভাষায় ‘তৃতীয় পক্ষের’ প্রয়োজন হয়। সংসদে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়, আমার ব্যক্তিগত মতামতÑ চেষ্টা করলেও সে ভাষায় একটি বাক্যও উচ্চারণ করতে পারব না আমরা। মাননীয় স্পিকার, শ্রদ্ধেয় হামিদ ভাই, একটি তথ্যনিষ্ঠ, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রচিত, জনস্বার্থমূলক প্রতিবেদনকে উপলক্ষ করে গঠনমূলক সমালোচনার জবাবে উচ্চতম পর্যায় থেকে ‘চক্রান্তকারী’র অভিযোগ শুনতে হয়, তাতে আমরা যারা দেশ নিয়ে ভাবি, দুর্নীতিমুক্ত, সুশাসন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি দেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার কাজ করতে চাই, তারা অপমানিত বোধ করি, তারা শঙ্কিত বোধ করি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মোটামুটিভাবে প্রমাণিত, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা তেমন মানুষদের আইনের ঊর্ধ্বে রাখার পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতিতে মুক্তচিন্তার মানুষ যখন ভীত হতে শুরু করে, মাননীয় স্পিকার, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় কিছু আর ঘটতে পারে না।”
টিআইবি প্রতিবেদনের অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে তিনি বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন, সংসদ সদস্যদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া, সংসদ সদস্যের নিজ রাজনৈতিক দল থেকেও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত সংসদ সদস্যদের দল থেকে বহিষ্কার ও পরবর্তী নির্বাচনে মনোনয়ন না দেয়ার ঘোষণা এবং স্থানীয় পর্যায়ে নিয়মিত ‘জনগণের মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানÑ সংসদ সদস্যদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবি।
কিন্তু ইতঃপূর্বে খোদ প্রধানমন্ত্রী আলোচ্য টিআইবি রিপোর্ট প্রকাশের আগের দিন গণভবনে আওয়ামী লীগ জাতীয় কমিটির বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এক-এগারোর মতো ‘খেলা’ শুরু হয়েছে। দলীয় নেতাদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন : ‘ষড়যন্ত্র চললেও তা নস্যাৎ করে সংবিধান অনুযায়ীই দেশ চলবে। যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে এ প্লাস সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, অনির্দিষ্টকালের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতে পারে বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী, তারাই আবার খেলা শুরু করেছেন। তারাই অসাংবিধানিক ধারায় ক্ষমতায় যেতে চান।…গণতন্ত্র থাকলে তাদের মূল্য থাকে না। তাদের ওয়েট থাকে অসাংবিধানিক ধারায়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধ্বংস করা এবং অসাংবিধানিক প্রক্রিয়া নিয়ে চক্রান্ত সব সময়ই তারা করে থাকেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়ার আগে জুন মাসে সম্পূর্ণ বানোয়াট প্রতিবেদন দিয়েছিল।’
ইশারা সুস্পষ্ট। রেজিম চেঞ্জের লক্ষ্যে ‘দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র’ আর ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’র ইঙ্গিত। অন্য দিকে ১৭ অক্টোবর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের গ্রেফতার হয়রানি বন্ধের দাবিতে এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন মহানগর ও জেলা সদরে গণমিছিল ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের গণমিছিল শুরু করার আগে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘(ফটো সাংবাদিকতা-টকশো নিয়ন্ত্রণে) গণমাধ্যমের ওপর সরকার আবার আঘাত শুরু করেছে। সরকার আস্তে আস্তে আবার পঁচাত্তরের দিকে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ জনগণ মেনে নেবে না। চার বছরে সরকারের ব্যর্থতার হিসাব এত বেশি যে বলে শেষ করা যাবে না। এই ব্যর্থতার ভারে তাদের পতন ঘটবে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনেই এদের বিদায় করব।’
সাধারণ মানুষ দুশ্চিন্তায়, ঘোর অশান্তির দিন ঘনিয়ে আসছে কি না।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads