বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১২

বাংলাদেশের মানবাধিকার ইস্যুতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিতর্ক : বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্যই গুমের ঘটনা



ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউস অব লর্ডসে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ সংসদ সদস্যরা।
ব্রিটিশ লর্ডরা (সংসদ সদস্যরা) বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। এ সময় বলা হয়, বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্যই গুমের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দেখানোর যে ওয়াদা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন তাতে সংশয় প্রকাশ করে সংসদ সদস্যরা বলেন, চলতি বছরই ২১৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কথার চেয়ে কাজ বড়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিতর্কে বলা হয়, প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। এখানে বিচারে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা হচ্ছে না। ব্রিটিশ লর্ডরা বলেন, বাংলাদেশে ব্রিটিশ সাহায্য দেয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির শর্ত বেধে যায় কিনা তাও ব্রিটিশ সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। গতকাল অনুষ্ঠিত এই বিতর্কে বলা হয়, নোবেলজয়ী ড. ইউনূস সরকারের হিংসার শিকার। হাউস অব লর্ডসের ওয়েবসাইটে বিতর্কের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে। বিতর্কে অংশ নেন বেশ কয়েকজন লর্ড ।
বিতর্কের উদ্যোক্তা লর্ড হুসেন বলেন, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতি, নির্যাতন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও বিরোধী দল সমর্থক সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গুমের ঘটনার কারণেই আমি এই বিতর্কের আহ্বান জানিয়েছি।
তিনি বলেন, মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে বাংলাদেশে এমন কোনো সপ্তাহ যায় না যে সময় র্যাবের হাতে কেউ গুলিবিদ্ধ হয় না। র্যাব গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত এই বাহিনীর হাতে বেআইনিভাবে অন্তত ৭০০ লোক নিহত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে গ্রেফতারের পর ভিকটিমদের হত্যা করা হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরই নিরাপত্তা হেফাজতে ২১৬ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে কারাগারেই মারা গেছে ১১৬ জন। এদের বেশিরভাগই মারা গেছে নির্যাতনের কারণে।
বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর গুমের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লন্ডন সফরকালে আমার সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি দেশে তার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তবে ইলিয়াস আলী বলেছিলেন, গণতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের জন্য কথা বলতে তিনি দেশে ফিরে যাবেন। তার পরিবারের দৃঢ় বিশ্বাস সরকারের গোপন বাহিনীর অথবা র্যাব তাকে অপহরণ করেছে। গুমের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, সরকারের কাছে অবাঞ্ছিত লোকদেরই সরিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, র্যাবের অপরাধের তদন্ত র্যাবই করে থাকে। এখানে স্পষ্টতই স্বার্থের সংঘাত রয়েছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রতিবছর ২৫ কোটি পাউন্ড ব্রিটিশ সাহায্য পাবে জানিয়ে তিনি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির ওপর ব্রিটিশ সাহায্য দেয়ার শর্তারোপ করা যায় কিনা তা ভেবে দেখার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, ব্রিটিশ সরকার যেন ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভারের উদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ দেয়।
ব্যারোনেস ব্রিনটন বলেন, বাংলাদেশে অব্যাহত ও ক্রমবর্ধমান হারে গুমের ঘটনা বাড়ছে। আরও ভয়াবহ ব্যাপার হলো গুম হচ্ছে বিশেষ করে রাজনীতিকরা। আগামী বছর বাংলাদেশে নির্বাচন হবে। বিরোধী দলের যেসব নেতাকে হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তিনি জিরো টলারেন্স দেখাবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি ঘটনারও তদন্ত হয়নি। কথার চেয়ে কাজ বড়। বাংলায় ‘হিংসা’ শব্দ উচ্চারণ করে তিনি বলেন, নোবেলজয়ী ড. ইউনূস সরকারের হিংসার শিকার।
তিনি বলেন, সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে লন্ডন অবস্থানকালেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মীর কাসেম আলীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। কাসেম আলীর অপরাধ তিনি তার মালিকানাধীন গণমাধ্যমের মাধ্যমে শেখ হাসিনা স্থাপিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলনের জন্য যেভাবে ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছিল সেভাবে না করে প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে।
লর্ড হ্যারিস বলেন, ইলিয়াস আলী ও তার ড্রাইভারের গুম কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম, বিরোধী দলের নেতা নাজমুল ইসলামকেও হত্যা করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশে ১,৬০০ লোক বিচারবহর্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ভঙ্গুর। এটি পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ।
লর্ড অ্যাভেবুরি বলেন, বৌদ্ধদের ওপর হামলায় ঘটনা তদন্তে নিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ করতে হবে। কারণ বাংলাদেশের বিচারবিভাগ ও পুলিশকে চরমভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিভেন র্যাপসহ বিদেশের আইনজ্ঞরা বলেছেন, এই ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করছে না।
ব্যারোনেস রয়াল বলেন, শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবেন। কিন্তু চলতি বছরই ২১৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
বিতর্কে অংশ নিয়ে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক সিনিয়র মন্ত্রী ব্যারোনেস ওয়ার্সি বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাজ্য সরকার উদ্বিগ্ন। চলতি বছরে প্রথম নয় মাসে ২৪ জন গুম ও ৬০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার স্বচ্ছ ও অবাধ হতে হবে। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে প্রকাশ্যে এবং গোপনে বলেছি, যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে হবে এবং আমাদের এ আহ্বান অব্যাহত থাকবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads