আলফাজ আনাম
দুর্নীতির টাকার অঙ্ক আর দুর্নীতিবাজদের ছবি কয়েক মাস ধরে সংবাদপত্রের প্রধান খবর হয়ে উঠছে। মহাজোট সরকারের ক্ষমতার মেয়াদের শেষ দিকে এসে একটির পর একটি দুর্নীতির কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগের সাথে আরো বড় আকারের তিনটি দুর্নীতির খবর বেশি আলোচিত হচ্ছে। সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্কের টাকা আত্মসাৎ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নিয়োগ-বাণিজ্যের টাকা এবং ডেসটিনির হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট। দুর্র্নীতির এসব অভিযোগের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলেও তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পাবে কি না তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। একই সাথে দুর্নীতির কেলেঙ্কারির সাথে প্রভাবশালী যেসব ব্যক্তির নাম এসেছে তাদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে।
হলমার্কের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির এমডি তানভীর মাহমুদ আর জিএম তুষার আহমেদকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাদের ২৯ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন তানভীর আহমেদকে তলব করেছিল। তিনি দুদক কার্যালয়ে হাজির হয়েছিলেন নম্বরপ্লেটবিহীন দামি গাড়িতে চড়ে। বলেছিলেন, যে পরিমাণ টাকা তিনি সোনালী ব্যাংক থেকে নিয়েছিলেন তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি সম্পদ তার রয়েছে। কিন্তু সংবাদপত্রের অনুসন্ধানে দেখা গেছে সাভারে শিল্পকারখানা স্থাপনের নামে কিছু জমি কিনে দখল করেছিলেন সরকারি খাস জমি। হলমার্কের এই হচ্ছে স্থায়ী সম্পদ। হলমার্কের শিল্পকারখানা ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের যে বিবরণ সংবাদপত্রে এসেছে তাতে প্রায় চার হাজার কোটি ব্যাংকঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করার সামর্থ্য যে এই প্রতিষ্ঠানটির নেই তা নিশ্চিত। তানভীর-তুষার ব্যক্তিগতভাবে এই বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছেন, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। শিল্পকারখানা পরিচালনায় তাদের যেমন অতীত অভিজ্ঞতা নেই তেমনি বিদেশে টাকা পাচারের কলাকৌশল তারা কতটা জানেন তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো এই টাকা গেল কোথায়? চোরাচালানের যেমন বাহক থাকে মূল কারবারিরা থাকে পর্দার অন্তরালে, তেমনি হলমার্কের নামে টাকা উত্তোলনকারী ছিলেন তানভীর। এই টাকার আসল কারবারিরা এখনো রয়ে গেছেন পর্দার অন্তরালে।
নামসর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠানকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেয়ার পরও এর দায় সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অস্বীকার করেছেন। পর্ষদের সদস্যদের দুর্নীতি দমন কমিশনে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তাদের সংশ্লিষ্টতা পায়নি কমিশন। অথচ ব্যাংকিং খাতের সাবেক শীর্ষ ব্যক্তিরা এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকও বলেছে, পরিচালনা পর্ষদ এই কেলেঙ্কারির দায় এড়াতে পারে না। ইতোমধ্যে পরিচালনা পর্ষদের সুন্দরী এক সদস্যের বিরুদ্ধে তিন বছরের মধ্যে বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার খবর সংবাদপত্রে এসেছে। ক্ষমতাসীন দলের এই নেত্রী স্কুলশিক্ষিকা থেকে এখন কোটি টাকার মালিক। দুর্নীতি দমন কমিশন তার আয় ও সম্পদের তদন্ত করছে। দুর্নীতি দমন কমিশন, সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত পরিচালনা পর্ষদের অন্য সদস্যদের সম্পদের হিসাব খতিয়ে দেখা এবং তাদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করা।
গণমাধ্যমে হলমার্কের জালিয়াতির সাথে মূল নায়ক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে তানভীরকে। এই তানভীরের সাথে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের সম্পর্ক খবর সংবাদপত্রে এসেছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছেরের নাম নানাভাবে এসেছে। নয়া দিগন্তে গত বুধবার একটি ছবি ছাপানো হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে তানভীরের স্ত্রী জেসমিনের গলায় মেডেল পরাচ্ছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা আর পাশে দাঁড়িয়ে তানভীর। ডা. মোদাচ্ছের বেশ কয়েকবার সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা অফিসে গেছেন। তিনি বলেছেন, তার এলাকার এক মহিলা ব্যাংক কর্মীর কাছে দেখা করতে নাকি তিনি যেতেন। মন্ত্রীর পদমর্যাদার একজন উপদেষ্টা মাঝে মধ্যে ব্যাংকের একটি শাখায় যেতেন একজন এলাকার বা আত্মীয় ব্যাংক কর্মীর সাথে দেখা করতে এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কিন্তু মোদাচ্ছেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি দুদক। আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম আর পদত্যাগী অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমানও হলমার্কের কারখানায় গিয়েছেন। তাদের সাথে হলমার্কের সম্পর্ক কেমন ছিল তাও জানা দরকার। কিন্তু সে দিকে এগোচ্ছে না দুদক। তানভীরকে জিজ্ঞাসাবাদে কাদের নাম আসছে তা নিশ্চয়ই প্রকাশ করবে না দুদক। কিন্তু শুধু তানভীরকে ধরলে সোনালী ব্যাংকের টাকা উদ্ধার হবে না, প্রকৃত অপরাধীরাও শাস্তি পাবে না। আবার জিজ্ঞাসাবাদে অসুস্থ হয়ে তানভীর হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। হার্ট অ্যাটাক এখন বড় ধরনের অপরাধের সাক্ষী গায়েবের একটি কৌশল হয়ে দেখা দিয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন যদি সত্যিই এই অর্থ আত্মসাৎকারীদের বিচার করতে চায় তাহলে প্রথমে দেখতে হবে মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের সাথে হলমার্ক গ্রুপের সম্পর্ক কিভাবে গড়ে উঠেছে। ব্যাংক থেকে টাকা উঠানোর জন্য শাস্তি দিলে হবে না, যাদের পরিকল্পনায় টাকা তোলা হয়েছে এবং যারা ভাগবাটোয়ারা পেয়েছেন তাদেরও শাস্তির আওতায় না আনতে পারলে এ ধরনের জালিয়াতি বন্ধ হবে না।
দুই.
দুর্নীতি দমন কমিশন যে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহসী হবে না তা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দুর্নীতি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা যে কিভাবে দুর্নীতি ও ঘুষের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন তার বিরল নজির স্থাপন করেছেন সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর ঘোষণা দিয়েছিলেন রেলের কালো বিড়ালগুলোকে তিনি খুঁজছেন। ঘুষ কেলেঙ্কারির পর দেখা গেল তার আশপাশে সবই কালো বিড়াল। এরা মন্ত্রীর পকেটে ঢুকে পড়েছে। কালো বিড়ালগুলোকে বাঁচানোর জন্য মন্ত্রীর চেষ্টারও কোনো কমতি ছিল না। আর মন্ত্রীর ক্ষমতায় থাকার জন্য ইঁদুর-বিড়াল খেলায় ৯ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত চলছে নানা নাটকীয়তা।
এ দিন গভীর রাতে পিলখানায় বর্ডার গার্ডের হেডকোয়ার্টার গেটে বিপুল টাকাসহ মন্ত্রীর এপিএসের মাইক্রোবাস আটক করা হয়। গাড়ির চালক হঠাৎ করে পিলখানায় গাড়িটি ঢুকিয়ে দেন। মন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক, রেলের পূর্বাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী মৃধা, রেলের ঢাকা বিভাগের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা এনামুল হক ও গাড়িচালক আলী আজম আটক হন। পরে গাড়িচালককে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেয় বিজিবি। মন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানান, গাড়িচালক তার এপিএসকে হাইজ্যাক ও ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছিল। গাড়িতে থাকা টাকা তার এপিএসের ব্যক্তিগত। তিনি ব্যক্তিগত টাকা বহন করতেই পারেন। মন্ত্রীর দাবি রাত ১০টার মধ্যে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন তার বাড়িতে আসার প্রশ্নই আসে না। একই সময়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় ৫ কোটি টাকা লাইসেন্স ফি দিয়ে সুরঞ্জিতপুত্র সৌমেন সেনগুপ্ত টেলিকমিউনিকেশন লাইসেন্স পেয়েছেন। ১৬ এপ্রিল সাংবাদিকদের কাছে তিনি পদত্যাগের কথা জানান। তিনি সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে পদত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করি। তিনি সাগ্রহে সম্মতি দিয়েছেন। তাই আমি সব ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব মাথায় নিয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার পত্র পাঠিয়েছি। তার এই সিদ্ধান্তকে আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষ থেকে গণতন্ত্রের জন্য ভালো পদক্ষেপ ও মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু ১৭ এপ্রিল সরকারি তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়। ১৯৯৬ সালের কার্যপ্রণালী বিধির ৩(৪) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দফতরবিহীন মন্ত্রী করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর থেকে গাড়িচালক আলী আজমের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন এ ঘটনার তদন্ত করে ও রেলের কর্মকর্তাদের দায়ী করলেও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি দুদক। একই সাথে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ছেলের আয়ের উৎসেও কোনো অসঙ্গতি পায়নি।
দুদকের এই সার্টিফিকেট দেয়ার পর নিখোঁজ হওয়ার ছয় মাস পর একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সাথে সাক্ষাৎকারে আলী আজম বলেন, এই টাকা মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি বিবেকের তাড়নায় দুর্নীতির এই টাকা ধরিয়ে দেন। তিনি আরো বলেন, এর আগেও একাধিকবার তিনি মন্ত্রীর বাসায় টাকা নিয়ে গেছেন। আলী আজম জানান, রেলওয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ১০ কোটি টাকার নিয়োগ-বাণিজ্যের অংশ হিসেবে ৭৪ লাখ টাকা মন্ত্রীর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। রেল বিভাগে ৬০০ লোক নিয়োগ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সুরঞ্জিতপুত্রের টেলিকমিউনিকেশন লাইসেন্সের টাকাও ঘুষের টাকা থেকে এসেছে বলে তিনি দাবি করেন।
আলী আজমের এই সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয় দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে না। ঘটনার প্রধান সাক্ষী ছিলেন গাড়িচালক আলী আজম কিন্তু তার সাক্ষ্য ছাড়াই দুদক মামলা নিষ্পত্তি করে। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, পিওন-চাপরাশির কথায় কারো বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে না। অর্থাৎ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিতে চাইছে না দুর্নীতি দমন কমিশন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের যেসব নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তাদের নিষ্কলুষ হিসেবে সার্টিফিকেট প্রদান করা।
তিন.
বাংলাদেশে অভিনব এক ব্যবসায় চালু করেছিল ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। ডেসটিনির এই ব্যবসায়ের লাভের পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদের পরিমাণ তিন বছরের ব্যবধানে ১৩ হাজার ভাগেরও বেশি বেড়েছিল। পরিশোধিত মূলধন পাঁচ বছরের ব্যবধানে মাত্র এক কোটি ৬২ লাখ থেকে বেড়ে হয় এক হাজার ১৯৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ ধরনের ব্যবসায় করার মধ্য দিয়ে দেশে ভয়াবহ দুর্নীতি বিস্তার ঘটিয়েছে ডেসটিনি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কোম্পানির পরিচালকেরা। ডেসটিনির কার্যক্রমের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদনে গত মার্চে বলা হয়েছিল, প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদফতরে নিবন্ধন নিয়ে অবৈধভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, লাখ লাখ মানুষের কাছ থেকে উচ্চসুদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শত শত কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু তারল্য সঙ্কটের কারণে যেকোনো সময় আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি চড়া সুদে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে প্রতি মাসে কমপক্ষে ২০-২৫ কোটি টাকা মুনাফা করছে।
সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা মোট ৩৮ লাখ অ্যাজেন্টের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের কমিশন দেয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি তার ব্যবসায়ের পরিধি বাড়িয়েছে একই সাথে প্রতিষ্ঠানটি তথাকথিত শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ডেসটিনি ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এলসির (ঋণপত্র) বিপরীতে এক কোটি ৮৫ লাখ মার্কিন ডলার পাঠানো হয়েছে। আরেক দফায় এলসির বিপরীতে পাঠানো হয় আরো ৭৮ লাখ ৮৮ হাজার মার্কিন ডলার। এলসির আবরণে ডেসটিনি গ্রুপ বিদেশে অর্থ পাঠিয়ে থাকতে পারে। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে স্থগিত করা ডেসটিনি গ্রুপের ৪৬১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৯০ কোটি চার লাখ টাকা রয়েছে। কিন্তু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করার আগে ডেসটিনি গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ও ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন লিমিটেডের ২৮২টি ব্যাংক হিসাবে এ যাবৎ পাঁচ হাজার ১৩২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা জমা ছিল এবং পরে এ হিসাব থেকে আবার পাঁচ হাজার ১১৩ কোটি টাকা তুলেও নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক অ্যাকাউন্টের প্রায় সব টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।
সাধারণ মানুষের সাথে এ প্রতারণার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন ডেসটিনির চেয়ারম্যান সাবেক সেনাপ্রধান ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সদস্য সচিব হারুন অর রশিদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন। জেনারেল হারুন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে কত যে বক্তব্য রেখেছেন, তার ইয়াত্তা নেই। ডেসটিনির টাকায় পরিচালিত টেলিভিশন চ্যানেলটির স্লোগান হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। জাতির গর্বিত সন্তান দেশের সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চয়ই এসব কাণ্ড দেখে লজ্জায় অধোবদন হয়ে পড়ছেন। জেনারেল হারুন প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের চেতনা সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, ডেসটিনির এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পরও ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। গণমাধ্যমে নিজেদের জালিয়াতি ও প্রতারণা পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছেন। প্রতারকেরা হয়েছিলেন সেলিব্রেটি। জেলা জজ আদালত থেকে জামিন নিয়ে তারা এ প্রচারণায় নেমে পড়েন। মামলা হওয়ার পরও তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের নাকি খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু মোবাইল ফোনে এরা নিয়মিত সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছেন। শেষ পর্যন্ত আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাদের জেলে পাঠানো হয়। এখন জিজ্ঞাসাবাদে সাধারণ মানুষের অর্থ আত্মসাতে যে দুর্নীতির কলাকৌশল গ্রহণ করেছিল, তা কতটা বেরিয়ে আসে সেটাই দেখার বিষয়।
ডেসটিনি থেকে হলমার্ক কিংবা আবুল থেকে সুরঞ্জিত সব দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজের চিত্র প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমের কল্যাণে। আলী আজমের মতো এক যুবক সততার সাহস না দেখাতে পারলে কালো বিড়ালদের রূপ আমরা দেখতে পারতাম না। তাদের মিয়াও মিয়াও আওয়াজও শুনতে পারতাম না। দুর্নীতি বা জালিয়াতির জন্য যদি শুধু তানভীরের শাস্তি হয়, আর অন্যরা যদি আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে থাকে অথবা আইনের ফাঁকফোকর গলে পার পেয়ে যান, তাহলে দুর্নীতির আরো বিস্তার ঘটবে। মনে বলতে হবে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি দুর্নীতির ঘটনাও উদঘাটন করতে পারেনি। উল্টো অনেক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত প্রভাবশালীকে দিয়েছে নিষ্কলুষ সার্টিফিকেট। গণমাধ্যমে এসব কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ না হলে হয়তো কারো নজরে আসত না। আর এ কারণেই রেলের কালো বিড়াল ক্ষিপ্ত হয়েছেন মিডিয়ার ওপর। যদিও মিডিয়ায় তিনি সেলিব্রেটি রাজনীতিক ছিলেন। যেকোনো রাজনীতিকের চেয়ে বেশি মিডিয়া কভারেজ পেয়েছেন। এখন তিনি বলছেন, মিডিয়ার বিরুদ্ধে তিনি আইনি ব্যবস্থা নেবেন। আসলে মিডিয়া এখন দুর্নীতিবাজদের প্রধান শত্রুতে পরিণত।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন