এমএ নোমান
গত এক যুগে দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৭ বার। এর মধ্যে শুধু গত তিন বছরেই বেড়েছে ৬ বার। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই নয় বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে মাত্র একবার। তাও আবার ইউনিটপ্রতি মাত্র ২৪ পয়সা। তখন ক্ষমতায় ছিল আজকের বিরোধী দলে থাকা বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। যতটুকু মনে পড়ে ওই সময় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ (বর্তমান ক্ষমতাসীন) সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করেছিল।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পরপরই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির হিড়িক পড়ে যায়। এ সময় রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের নামে বিদ্যুত্ খাত থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩৪ হাজার কোটি টাকা লুট করার কারণে বিদ্যুতের উত্পাদন ব্যয় তিনগুণ বেড়ে যায়। ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের পকেট কেটে ভর্তুকির টাকা জোগাড়ের অভিনব ফর্মুলা বের করা হয়। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর একক কৃতিত্ব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেনের।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির চেয়ারম্যান হিসেবে সৈয়দ ইউসুফ হোসেন দায়িত্ব নেন ২০০৯ সালের ১২ অক্টোবর। বিদায় নেন ২০১২ সালের ১০ অক্টোবর। এই তিন বছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ে ৬ বার। আগে গ্রাহক পর্যায়ে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ছিল আড়াই টাকা। সেই একই বিদ্যুত্ এখন গ্রাহকদের কিনতে হচ্ছে ইউনিটপ্রতি ক্ষেত্রবিশেষ সাড়ে আট টাকা করে। এর ওপরে আবার প্রয়োগ করা হয়েছে ধাপ পদ্ধতি নামের ধারাল ছুরি। জনগণের পকেট কেটে বিদ্যুতের দাম তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়ে সরকারের দুর্নীতির টাকা জোগাড়ে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন সৈয়দ ইউসুফ হোসেন।
সৈয়দ ইউসুফ হোসেন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সর্বশেষ (ষষ্ঠবার) ঘোষণা দেন গত ২০ সেপ্টেম্বর। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) পক্ষ থেকে ওইদিন সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। সাংবাদিকদের পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন এবং বিদ্যুত্ উত্পাদন ও বিতরণকারী সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন। জনাকীর্ণ এ সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসি চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন বিদ্যুতের গ্রাহক পর্যায়ে আরও ১৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। ঘোষণা শেষ হলে একজন সাংবাদিক বিইআরসি চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে বলেন, মাননীয় চেয়ারম্যান! বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই।
বিইআরসি চেয়ারম্যান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লে ওই সাংবাদিক বলেন, আমরা ছোটকালে নিজাম ডাকাতের গল্প শুনেছি। আপনিও নিশ্চয় শুনেছেন। নিজাম ডাকাত নাকি সারা রাত দুর্নীতি করে যারা অর্থ-বিত্তের পাহাড় গড়েছেন ওইসব দুর্নীতিবাজ বড়লোকদের বাড়িতে ডাকাতি করত। আর দিনের বেলায় ডাকাতির সব মালামাল গরিব লোকদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দিত। একপর্যায়ে নিজাম ডাকাত গরিব লোকদের আশীর্বাদ আর দোয়ার বরকতে ‘নিজাম উদ্দিন আউলিয়া’ হয়ে যায়। এরপর থেকে নিজাম উদ্দিন আউলিয়া আর কোনোদিন ডাকাতি করেনি। কিন্তু আপনি দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সাধারণ গ্রাহকদের পকেট কেটে টাকা নিয়ে সরকারের দুর্নীতির টাকার জোগান দিচ্ছেন। বিইআরসি চেয়ারম্যানের প্রতি প্রশ্ন রেখে সাংবাদিক বলেন, মাননীয় চেয়ারম্যান! আমার প্রশ্ন হলো—নিজাম ডাকাত যদি গরিবদের দোয়া ও আশীর্বাদে আউলিয়া হয়ে যান তাহলে ওই একই গরিব ও দুঃখী মানুষের বদ-দোয়ায় আপনি কী হবেন?
বিইআরসি চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেনের প্রতি ভূমিকাসহ সাংবাদিকের ওই প্রশ্নের পরে উপস্থিত ভোক্তা, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও সাংবাদিকরা মুহুর্মুহু করতালি দেন। তবে ওইদিন বিইআরসি চেয়ারম্যানকে এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে দেখেছি। কমপক্ষে দুই মিনিট সময় ধরে তিনি চুপ করে কী যেন ভাবছিলেন। ততক্ষণে জনাকীর্ণ এ সংবাদ সম্মেলনে মুহুর্মুহু করতালি ভেঙে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। অসহায়ের মতো চেয়ারম্যান তার সহকর্মী অপর সদস্যদের দিকে কয়েকবার তাকালেন। কারও মুখেই কোনো শব্দ নেই। শেষে তিনি শুধু একটা বাক্যই বললেন, আইন অনুযায়ী আমাকে ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ করারই কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের বিদ্যুত্ খাতে সরকারের ভর্তুকির কথাটাও মাথায় রাখতে হয়।
তিন বছর দায়িত্ব পালন শেষে গত ১০ অক্টোবর বিইআরসি থেকে বিদায় নেন সৈয়দ ইউসুফ হোসেন। বিদায় বেলায়ও তিনি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সংবাদ সম্মেলন কভার করার জন্য যথানিয়মে তার কার্যালয় থেকে প্রতিটি মিডিয়ার প্রধান প্রতিবেদক ও সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের কাছে ফোন করা হয়। বেশ আগ্রহ নিয়েই বিইআরসির বিদায়ী চেয়ারম্যানের সংবাদ সম্মেলন কভার করতে যাই। গিয়ে অবাক হলাম। নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা পরে সংবাদ সম্মেলন শুরু হলো। প্রিন্ট মিডিয়ার পক্ষ থেকে আমি একাই। এছাড়া প্রায় দুই ডজন স্যাটেলাইট চ্যানেল থেকে মাত্র দুটি চ্যানেলের প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অপর চ্যানেলগুলোর কেউই আসেনি। বিইআরসির কয়েকশ’ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে তিন সদস্য এবং অপর তিন কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলনসহ চেয়ারম্যানের এ বিদায়ী অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
চেয়ারম্যানের বিদায় অনুষ্ঠান ও সংবাদ সম্মেলন বর্জন করার কারণ জানতে চেয়েছিলাম বিইআরসির এক কর্মকর্তার কাছে। বললেন, ভাই! বিদ্যুত্ বিলের বোঝার নিচে পড়ে সবাই পিষ্ট। সম্ভবত এ কারণেই কেউ আর আগ্রহ দেখায়নি।
লেখক : সাংবাদিক
nomansalimbd@yahoo.com
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পরপরই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির হিড়িক পড়ে যায়। এ সময় রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের নামে বিদ্যুত্ খাত থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩৪ হাজার কোটি টাকা লুট করার কারণে বিদ্যুতের উত্পাদন ব্যয় তিনগুণ বেড়ে যায়। ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের পকেট কেটে ভর্তুকির টাকা জোগাড়ের অভিনব ফর্মুলা বের করা হয়। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর একক কৃতিত্ব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেনের।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির চেয়ারম্যান হিসেবে সৈয়দ ইউসুফ হোসেন দায়িত্ব নেন ২০০৯ সালের ১২ অক্টোবর। বিদায় নেন ২০১২ সালের ১০ অক্টোবর। এই তিন বছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ে ৬ বার। আগে গ্রাহক পর্যায়ে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ছিল আড়াই টাকা। সেই একই বিদ্যুত্ এখন গ্রাহকদের কিনতে হচ্ছে ইউনিটপ্রতি ক্ষেত্রবিশেষ সাড়ে আট টাকা করে। এর ওপরে আবার প্রয়োগ করা হয়েছে ধাপ পদ্ধতি নামের ধারাল ছুরি। জনগণের পকেট কেটে বিদ্যুতের দাম তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়ে সরকারের দুর্নীতির টাকা জোগাড়ে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন সৈয়দ ইউসুফ হোসেন।
সৈয়দ ইউসুফ হোসেন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সর্বশেষ (ষষ্ঠবার) ঘোষণা দেন গত ২০ সেপ্টেম্বর। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) পক্ষ থেকে ওইদিন সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। সাংবাদিকদের পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন এবং বিদ্যুত্ উত্পাদন ও বিতরণকারী সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন। জনাকীর্ণ এ সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসি চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন বিদ্যুতের গ্রাহক পর্যায়ে আরও ১৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। ঘোষণা শেষ হলে একজন সাংবাদিক বিইআরসি চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে বলেন, মাননীয় চেয়ারম্যান! বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই।
বিইআরসি চেয়ারম্যান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লে ওই সাংবাদিক বলেন, আমরা ছোটকালে নিজাম ডাকাতের গল্প শুনেছি। আপনিও নিশ্চয় শুনেছেন। নিজাম ডাকাত নাকি সারা রাত দুর্নীতি করে যারা অর্থ-বিত্তের পাহাড় গড়েছেন ওইসব দুর্নীতিবাজ বড়লোকদের বাড়িতে ডাকাতি করত। আর দিনের বেলায় ডাকাতির সব মালামাল গরিব লোকদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দিত। একপর্যায়ে নিজাম ডাকাত গরিব লোকদের আশীর্বাদ আর দোয়ার বরকতে ‘নিজাম উদ্দিন আউলিয়া’ হয়ে যায়। এরপর থেকে নিজাম উদ্দিন আউলিয়া আর কোনোদিন ডাকাতি করেনি। কিন্তু আপনি দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সাধারণ গ্রাহকদের পকেট কেটে টাকা নিয়ে সরকারের দুর্নীতির টাকার জোগান দিচ্ছেন। বিইআরসি চেয়ারম্যানের প্রতি প্রশ্ন রেখে সাংবাদিক বলেন, মাননীয় চেয়ারম্যান! আমার প্রশ্ন হলো—নিজাম ডাকাত যদি গরিবদের দোয়া ও আশীর্বাদে আউলিয়া হয়ে যান তাহলে ওই একই গরিব ও দুঃখী মানুষের বদ-দোয়ায় আপনি কী হবেন?
বিইআরসি চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেনের প্রতি ভূমিকাসহ সাংবাদিকের ওই প্রশ্নের পরে উপস্থিত ভোক্তা, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও সাংবাদিকরা মুহুর্মুহু করতালি দেন। তবে ওইদিন বিইআরসি চেয়ারম্যানকে এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে দেখেছি। কমপক্ষে দুই মিনিট সময় ধরে তিনি চুপ করে কী যেন ভাবছিলেন। ততক্ষণে জনাকীর্ণ এ সংবাদ সম্মেলনে মুহুর্মুহু করতালি ভেঙে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। অসহায়ের মতো চেয়ারম্যান তার সহকর্মী অপর সদস্যদের দিকে কয়েকবার তাকালেন। কারও মুখেই কোনো শব্দ নেই। শেষে তিনি শুধু একটা বাক্যই বললেন, আইন অনুযায়ী আমাকে ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ করারই কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের বিদ্যুত্ খাতে সরকারের ভর্তুকির কথাটাও মাথায় রাখতে হয়।
তিন বছর দায়িত্ব পালন শেষে গত ১০ অক্টোবর বিইআরসি থেকে বিদায় নেন সৈয়দ ইউসুফ হোসেন। বিদায় বেলায়ও তিনি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সংবাদ সম্মেলন কভার করার জন্য যথানিয়মে তার কার্যালয় থেকে প্রতিটি মিডিয়ার প্রধান প্রতিবেদক ও সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের কাছে ফোন করা হয়। বেশ আগ্রহ নিয়েই বিইআরসির বিদায়ী চেয়ারম্যানের সংবাদ সম্মেলন কভার করতে যাই। গিয়ে অবাক হলাম। নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা পরে সংবাদ সম্মেলন শুরু হলো। প্রিন্ট মিডিয়ার পক্ষ থেকে আমি একাই। এছাড়া প্রায় দুই ডজন স্যাটেলাইট চ্যানেল থেকে মাত্র দুটি চ্যানেলের প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অপর চ্যানেলগুলোর কেউই আসেনি। বিইআরসির কয়েকশ’ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে তিন সদস্য এবং অপর তিন কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলনসহ চেয়ারম্যানের এ বিদায়ী অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
চেয়ারম্যানের বিদায় অনুষ্ঠান ও সংবাদ সম্মেলন বর্জন করার কারণ জানতে চেয়েছিলাম বিইআরসির এক কর্মকর্তার কাছে। বললেন, ভাই! বিদ্যুত্ বিলের বোঝার নিচে পড়ে সবাই পিষ্ট। সম্ভবত এ কারণেই কেউ আর আগ্রহ দেখায়নি।
লেখক : সাংবাদিক
nomansalimbd@yahoo.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন