শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১২

তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া সব অনির্বাচিত বড় আপন



ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব যুক্তি দিয়ে থাকেন তার অন্যতম হলো, কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া কিছুতেই ঠিক নয়। তাই শেখ হাসিনার নির্বাচিত সরকারই নির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করবেন। প্রাথমিকভাবে এ কথা শুনতে মন্দ নয়। এমনকি শেখ হাসিনা ও জামায়াতে ইসলামী যখন একেবারে গলায় গলা মিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির পক্ষে জোরদার আন্দোলন করছিলেন, তখন আমি ছাড়াও এ দেশের বহু নামী-দামি বুদ্ধিজীবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। এটা ছিল ওয়েস্ট-মিনস্টার টাইপ গণতন্ত্রের পদ্ধতি। একটি ব্রিটিশ পদ্ধতি। এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে বহু রাষ্ট্রই শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতিকেই কবুল করেছিল। কারণ যারা ক্ষমতায় ছিল তাদের ওপর সেসব দেশ আস্থা রাখতে পারেনি। যেখানে গণতন্ত্র নাজুক, শাসকেরা স্বৈরমানসিকতার, সেখানেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির প্রশ্ন এসেছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ভয়াবহ নাজুক বলে মনে করেছিল আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী।
আওয়ামী লীগ-জামায়াতের কাঁধে কাঁধ মেলানোর আন্দোলনের ফলেই সাংবিধানিকভাবে ১৯৯৬ সালে বিএনপি একতরফা নির্বাচন করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল। সে নির্বাচন নিয়ে কূটকাটব্য কম হয়নি। কিন্তু এ কথা কেউ বলতে পারবেন না যে, ওই নির্বাচনের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছিলেন, এ নির্বাচনের পর সবাই মিলেমিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির প্রবর্তন করব এবং পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে ওই সংসদ ভেঙে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন, আপনারা সবাই নির্বাচনে আসুন। ওকে, আপনারা যেভাবে চাইছেন, সেভাবেই সবাই মিলে সংবিধান সংশোধন করি এবং তিনি বারবার ঘোষণা করছিলেন, সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনে এই নির্বাচন করা হচ্ছে।
কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দল ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। কেন করেনি, সেটা আমরা উপলব্ধি করলেও যেহেতু তথ্যপ্রমাণহীন, বর্ণনা করতে পারছি না। তৎকালীন বিরোধী দল, যারা নির্বাচনে অংশ নেননি, ওই নির্বাচন নিয়ে অনেক ইতর মন্তব্য করেছেন। হাসিঠাট্টা করেছেন। কিন্তু অংশগ্রহণহীন সেই সংসদে পাস হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করা আওয়ামী লীগারদের এখন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৬ সালের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন, ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচন ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে একবার বিএনপি জয়ী হয়েছিল, একবার আওয়ামী লীগ। তেমন কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। এরপরই এলো ২০০৭ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গ। কিছু কিছু মিডিয়া যেন আমাদের ভুলিয়েই দিতে চাইল যে, রাষ্ট্রপতি কেন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিলেন।
বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল তখন বারবার সাংবাদিকদের সামনে হাজির হয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব বলেছিলেন, তিনি আবদুল জলিলকে জানান, যদি কোনো তত্ত্বেই তারা বিশ্বাস না করেন, তাহলে তারা ১০-১২ জন লোকের নাম দিন। বিএনপিও ১০-১২ জন লোকের নাম দেবে। সেগুলো সঙ্গোপনে। তার মধ্যে যেসব নাম কমন, রাষ্ট্রপতি সে নামগুলো প্রকাশ করবেন এবং তিনি যাকে খুশি তাদের মধ্য থেকে মনোনয়ন দেবেন। সে রকম জটিল অবস্থায় এর চেয়ে উত্তম প্রস্তাব কী হতে পারত, সেটি আমাদের জানা নেই।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র ঘনীভূত হতে থাকল। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সম্ভাব্য প্রধান অরাজনৈতিক ব্যক্তির নাম দিতে অস্বীকার করল। ফলে সংবিধানের বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকেই সে দায়িত্ব নিতে হলো। রাষ্ট্রপতি যখন নিজেই সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিলেন, তখন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, দেখি তিনি কতটা নিরপেক্ষভাবে সব কিছু পরিচালনা করেন। তখন বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক দৃশ্যপট তৈরি করলেন। তিনি বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান রাষ্ট্রপতি যদি তাদের কথামতো না চলেন, তাহলে তারা বঙ্গভবনে খাবার-দাবার, গ্যাস-পানি এমনকি অক্সিজেন পর্যন্ত বন্ধ করে দেবে। ডেইলি স্টার পত্রিকা লিখল, বিভিন্ন দোকানদার বঙ্গভবনের জন্য খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
আলোচনা শুরু করেছিলাম শেখ হাসিনার অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে। কিন্তু মহামান্য প্রধানমন্ত্রী আমাদের একেবারে এলোমেলো করে দিলেন। যখন তিনি বললেন যে, অনির্বাচিত কোনো ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দেয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। নিরাপদও নয়। অথচ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি, তিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক সরকারকে একেবারে আঁচল পেতে সমর্থন দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনী প্রধান জে. নাসিম যখন গণতন্ত্র রদ করে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে গিয়েছিলেন, তাতেও তার সমর্থন ছিল। আর জে. মইন উদ্দিন আহমদ ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি যখন সেনা অভ্যুত্থান ঘটালেন, তখন তিনি আর রাখঢাক করেননি। স্পষ্টই ঘোষণা করেন, এই অনির্বাচিত সরকারের প্রতি তার সর্বাত্মক সমর্থন রইল। আর জেনারেল মইনের সরকার যা-ই করুক না কেন, তার প্রতি তিনি অব্যাহত অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে যাবেন। সেটা সংবিধানবিরোধী হলেও আপত্তি নেই। প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধন করে তাদের সব অপকর্মের বৈধতা দেবেন। তিনি কথা রেখেছেন। তাদের সব কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিয়েছেন। সেই শেখ হাসিনার মুখে অনির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য আর কি মানায়! মানাক-না-মানাক তিনি ওই গীত এখন অবিরাম গেয়েই যাচ্ছেন।
শুধু এরাই নন, ২০০৮ সালের একেবারে শেষ দিকে যে আঁতাতের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়ে শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তাতেও লক্ষ করা যায়, অনির্বাচিতদের একেবারে ছড়াছড়ি, জয়জয়কার। ওই আঁতাতের নির্বাচনে যাদের জিতিয়ে আনা হলো, তাদের যোগ্যতা এত দিনে প্রমাণিত হয়ে গেছে। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলকে অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করা আর খিস্তিখেউড় করা ছাড়া তাদের আর কোনো যোগ্যতা আছে বলে মনে হয় না। ধারণা, শেখ হাসিনারও এটা বিশেষ পছন্দের। কিন্তু তাই তিনি যখন মন্ত্রিসভা গঠন করলেন, তখন তাতে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের একেবারে ছড়াছড়ি লক্ষ করা গেল। তার সরকারের কোথায় নেই অনির্বাচিত ব্যক্তি? তার মন্ত্রিসভায় আছে অনির্বাচিত ব্যক্তি, মন্ত্রীর পদমর্যাদায় যে সাতজন উপদেষ্টা নিয়োজিত আছেন, যারা রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন, তাদের সবাই অনির্বাচিত ব্যক্তি। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার প্রশাসনে আছেন বহুসংখ্যক  অনির্বাচিত ব্যক্তি। এখন তার মন্ত্রিসভায় আছেন তিনজন অনির্বাচিত মন্ত্রী, সাতজন বিশেষভাবে ক্ষমতাধর ৬১টি জেলা পরিষদে আছেন অনির্বাচিত প্রশাসকেরা। এমনকি বর্তমানে দ্বিধাবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনে আছেন দুইজন অনির্বাচিত প্রশাসক। এসব লোক শেখ হাসিনার পাশে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, অনির্বাচিত লোকদের মন্ত্রী করা সংবিধানের মূলনীতির ব্যত্যয়। শেখ হাসিনার সরকার অনির্বাচিতদের শাসনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেও অনির্বাচিত ব্যক্তির দ্বারা পরিবেষ্টিত। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাষ্ট্রের মূলনীতির পরিপন্থী বলে তা বাতিল করা হয়। শেখ হাসিনার সরকার প্রায় সাথে সাথে তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের সে রায় কার্যকর করে ফেলে। কিন্তু একই সংশোধনীতে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের মন্ত্রী করাকে যে সংবিধানপরিপন্থী বলা হলো, শেখ হাসিনা সরকার সেটি জোরেশোরেই অমান্য করে যাচ্ছেন। বলিহরি, আদালতের রায় বাস্তবায়ন! তেমনিভাবে একই রায়ের বলে উপদেষ্টারাও রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিতে পারেন না। কিন্তু করে তো যাচ্ছেন। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা পরিচালনা করার কথাও নির্বাচিত ব্যক্তিদের। সেখানে প্রশাসক বসানোর বিধান সংবিধানে নেই। প্রশাসক নিয়োগও তাই অসাংবিধানিক। সংবিধানের ৫৯ ধারায় বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকারের সব প্রশাসন অবশ্যই নির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে পরিচালিত হতে হবে। এমনই তিনি মান্য করেন সংবিধান।
তিনি সম্ভবত মনে করেন, সংবিধান কোনো ব্যাপারই নয়। তিনি যা বলবেন, সেটাই সংবিধান, সেটাই রাষ্ট্রের আইনকানুন। রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রে নির্বাচিত ব্যক্তিদের চেয়ে অনির্বাচিত ব্যক্তিদেরই তার অত্যন্ত আপন বলে মনে হয়। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অনির্বাচিত ব্যক্তিরা তার দুই চোখের বিষে পরিণত হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেই যাচ্ছে। তার সম্ভবত ধারণা এই, তিনি যা-ই করুন না কেন তার কোনো কিছুই এ দেশের মানুষ বুঝতে পারবে না। তিনি যদি বলেন সূর্য উঠেছে। তাহলে সূর্য উঠল। তিনি যদি রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুরে বলেন, এখন গভীর রাত। তাহলে জনগণ বিনা বাক্যব্যয়ে তথাস্তু বলে সে কথাই মেনে নেবে। ধারণা করি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী জনগণকে যতটা বেকুব ঠাউড়েছেন, জনগণ তা নয়।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads