মানব শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে চোখ। যার চোখ নেই তার কাছে দুনিয়া অন্ধকার। একই সাথে চোখ মানব শরীরের সৌন্দর্যের আধার। চোখ নিয়ে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে কবির যেমন আবেগী কবিতা আছে, তেমনি উপন্যাস-গল্পে নায়ক-নায়িকার চোখের বর্ণনা নানাভাবে এসেছে। বাংলা ভাষার কবি-লেখকেরা নানা ধরনের চোখের বর্ণনা দিয়েছেন; যেমনÑ মায়াবী চোখ, পটোলচেরা চোখ, হরিণ চোখ, অতলান্তিকের মতো নীল চোখ ইত্যাদি। প্রেম-ভালোবাসার সাথে যেমন চোখের বর্ণনা উঠে আসে, তেমনি এই চোখ কখনো মানুষের জন্য বিপদের কারণ হয়ে ওঠে। চোখ হয়ে উঠতে পারে মানুষের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু।
লেখক ও ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের একটি অসাধারণ গল্পের নাম চোখ। খেজুরকাঁটা দিয়ে এক চোরের চোখ তুলে নেয়ার ঘটনার বর্ণনাকে কেন্দ্র করে হুমায়ূন আহমেদ গল্পটি লিখেছেন। পালিয়ে বেড়ানোর কারণে চোর মতি মিয়ার সাথে তার স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়েছে দীর্ঘ দিন। শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর খোঁজ পান তিনি। স্ত্রী আছেন গ্রামের এক বাজারে। আড়তদার-ব্যাপারীদের মনোরঞ্জন এখন তার পেশা। তারপরও স্ত্রীর প্রতি মতি মিয়ার ভালোবাসার কোনো ঘাটতি নেই। গোপনে দেখা করার জন্য মতি মিয়া বাজারের পথে রওনা হন। আর সেখানেই দেখা দেয় বিপত্তি। এক ব্যক্তি চিনে ফেলে মতি মিয়াকে, ধরে নিয়ে আসে গ্রামে। মেম্বার-মাতবররা মিলে তার শাস্তি নির্ধারণ করেন চোখ তুলে নেয়ার। সেই শাস্তি কার্যকর হওয়ার আগে মতি মিয়াকে নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে পড়তে হয়। এ অবস্থার মধ্যেও কিভাবে মনের জোর ঠিক রাখতে হয় তার বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে এই গল্পে। শেষ পর্যন্ত মতি মিয়ার চোখ তুলে নেয়া হয় কি না তা আর উল্লেখ করেননি হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু চোখ তুলে নেয়ার যে বীভৎসতা তার অনুভূতি ঠিকই পাঠক গল্পটি পড়ে অনুধাবন করতে পারবেন।
শুধু গল্প-উপন্যাস নয়, আগের যুগের রাজরাজড়া অবাধ্য কর্মচারী বা বিদ্রোহী প্রজাদের চোখ তুলে নিতেন এমন অনেক বিবরণও পাওয়া যায়। কিন্তু সভ্য সমাজে চোখ তুলে নিয়ে কাউকে শাস্তি দেয়ার বিধান নেই। যত বড় অপরাধই হোক, কারো অঙ্গহানি করে শাস্তি দেয়ার বিধান এখন সভ্য সমাজে আর গ্রহণযোগ্য নয়। শাস্তি এখন জেল-জরিমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকি দুনিয়ার বহু দেশে মৃত্যুদণ্ড তুলে নেয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এখন মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি বিলোপ করার দাবি জানাচ্ছে। তবে বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম। ফাঁসির দাবি কিংবা ফাঁসি কার্যকরের পর উল্লাসের নানা খবরও এখন টেলিভিশনে প্রচার হয়। এ ধরনের নিষ্ঠুর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি মনে হয় আরো প্রকাশ্য রূপ পেতে যাচ্ছে।
সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারিত টকশোতে একজন মন্ত্রী প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতার চোখ তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এই হুমকি দিয়েছেন বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়াকে। ঠিক হুমকি না বলে মন্ত্রীর শাস্তিও বলা যায়। কারণ মন্ত্রীর মতে এই নেতা তার সাথে বেয়াদবি করেছেন। রফিকুল ইসলাম মিয়াও মন্ত্রী ছিলেন। এখন সাবেক। তিনি একজন ব্যারিস্টারও বটে। আইনের মাধ্যমে শাস্তি দেয়ার পক্ষে-বিপক্ষে তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে থাকেন। এখন তাকে অঙ্গহানি করে শাস্তি দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার কী অপরাধ? অবশ্যই অপরাধ আছে। অপরাধ ছাড়া তো কোনো নিরীহ ব্যক্তিকে মন্ত্রী মহোদয় শাস্তি দেয়ার কথা বলতে পারেন না। মন্ত্রী মহোদয় যখন টেলিভিশনে তার সরকারের সাফল্য এবং বিগত সরকারের অপকর্মের বিবরণ দিচ্ছিলেন, তখন বিরোধী দলের নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়া তার বক্তব্যে বাধা প্রদান করেন। একবার দুইবার নয়, বহুবার বাধা দেন। বর্তমান সরকারও অপকর্ম করছে বলে তিনি ফোড়ন কাটেন। অতীত নয় বর্তমানের কথা বলুন বলে মন্ত্রীর কথার পিঠে কথা চালিয়ে যান । এতে মন্ত্রীর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মন্ত্রীর মেজাজ বলে কথা। রফিকুল ইসলাম মিয়াও মন্ত্রী ছিলেন, তবে ২০ বছর আগে। এখনকার ডিজিটাল যুগের মন্ত্রীদের মেজাজ-মর্জির সাথে তিনি হয়তো অনেক দিন পরিচিত ছিলেন না। মন্ত্রী হুঙ্কার ছাড়েনÑ বেয়াদব। কিন্তু তাতেও থামেন না রফিকুল। তিনিও তো রাজনীতিক। টকশোতে এসেছেন কথা বলতেই। কথা তাকেও বলতে হবে। উত্তেজনা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে উপস্থাপক অনুষ্ঠান বন্ধ করার জন্য টেলিভিশন চ্যানেল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাতে থাকেন। কিন্তু কথা থামছে না। চেয়ার থেকে উঠে মন্ত্রী মহোদয় তেড়ে গেলেন প্রতিপক্ষ দলের নেতার দিকে। বললেন, তোমার চোখ তুলে ফেলব! তুমি আমাকে চেনো না? হারামজাদা, তুমি জানো না একজন মন্ত্রীর সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়? তোমাকে আজ জুতাপেটা করব। এবার থেমে গেলেন বিরোধী দলের নেতা। হয়তো ভয় পেয়েই চুপ হয়ে গেলেন। মন্ত্রী সফল। বিরোধী দলের একজন সামান্য নেতাই যদি মন্ত্রীকে ভয় না পান, তাহলে কিসের মন্ত্রী। অনুষ্ঠানের অন্য অতিথি-আলোচকেরা এতক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও এবার তারাও চুপসে গেলেন (মানবজমিন ২৪ অক্টোবর, ২০১২) মন্ত্রীর উত্তেজনা কমার পর আবার অনুষ্ঠান শুরু হয়। সবাই শান্তভাবে অনুষ্ঠান শেষ করেছেন। তবে শেষরক্ষা হয়েছে রফিকুল ইসলাম মিয়ার। তার চোখ রক্ষা পেয়েছে। মন্ত্রী তার চোখ তুলে নেয়ার শাস্তি বা হুমকি কার্যকর করেননি।
সংবাদপত্রগুলোতে কয়েকদিন ধরে এই চোখ তুলে নেয়ার হুমকির খবর নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি সত্যিই এসব কথা বলেছিলেন কি না? মন্ত্রী অবশ্য শিশুর মতো সরলভাবে জবাব দিয়েছেন রাগের মাথায় কী বলেছি এখন আর মনে নেই। এরপর তিনি বলেছেন, রফিকুল ইসলাম মিয়ার অসদাচরণ সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কোনো স্বাভাবিক ভদ্রলোক এমন আচরণ করতে পারেন না। তিনি আরো বলেছেন, মানুষকে সম্মান দিতে না জানলে সম্মান পাওয়া যায় না (বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৫ অক্টোবর, ২০১২)খুবই সত্যি কথা। মন্ত্রীর সাথে বেয়াদবি করেছেন, অতএব তিনি তাকে সম্মান দেবেন কেন?
মন্ত্রী শাজাহান খান শুধু মন্ত্রী নন, একজন শ্রমিক নেতাও বটে। শ্রমিকদের স্বার্থের ব্যাপারে তিনি খুবই সোচ্চার। এ ক্ষেত্রেও তিনি খুবই সহজ সরল। গত বছর ২ জুন ও ১২ জুলাই দুই দফায় নৌমন্ত্রী ২৭ হাজার ৩৮০ জন অদক্ষ চালককে ভারি ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার সুপারিশ করেন বিআরটিএর কাছে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। কারণ অদক্ষ চালকদের কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রতিদিন কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। এই লাইসেন্সের সুপারিশ করার সময় সাংবাদিক মিশুক মুনীর আর চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। স্বাভাবিকভাবে গণমাধ্যমে মন্ত্রীর এই সুপারিশের তীব্র সমালোচনা হয়। তখনো মন্ত্রীর মেজাজ কিছুটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তিনি জানিয়ে দেন, এই ড্রাইভারদের পরীক্ষা জরুরি নয়। তারা রাস্তায় গরু-ছাগল চিনতে পারে কি না সেটাই হচ্ছে আসল কথা।
যা হোক, আবার আমরা টকশোতে ফিরে আসি। চোখ তুলে নেয়ার এই হুমকি দেয়ার পর রফিকুল ইসলাম মিয়া প্রশ্ন তুলেছেন, তিনি এখনো মন্ত্রী থাকেন কী করে? এটা অবশ্য অদ্ভুত প্রশ্নÑ এই সামান্য ঘটনায় একজন মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব চলে যাবে তা ভাবাই যায় না। তবে আমরা ধারণা করেছিলাম এই ব্যারিস্টার সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা হয়তো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের না হোক অন্তত থানায় একটি জিডি করবেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। হয়তো ভয়ে কিংবা থানা পুলিশ আর আদালতের অবস্থা বিবেচনা করে। কারণ থানায় মামলা দিতে গেলে উল্টো তার বিরুদ্ধে পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়ার মামলা হতে পারে। অবশ্য এই ঘটনায় একজন আইনজীবী নৌপরিবহন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন। আদালতে দায়ের করা এই মামলার কোনো ভবিষ্যত আছে বলে মনে হয় না।
বিরোধী দলের এই নেতাকে হুমকি দেয়ার প্রতিবাদে তার দল ও সমর্থকেরা প্রেস ক্লাবে মানববন্ধন করেছেন। নিরীহ এই কর্মসূচি পালন করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। এ দলের নেতারা গুম হওয়ার পরও কিংবা দলশুদ্ধ প্রথম সারির নেতাদের লাইন ধরে জেলে পাঠানোর পরও এমন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। মানুষ গুম করার চেয়ে চোখ তুলে নেয়ার হুমকি তো আর বড় হতে পারে না।
যা হোক, এ ঘটনার মধ্যদিয়ে আমাদের সামনে যে বিষয়টি স্পষ্ট হলো, ডিজিটাল যুগে একজন সফল মন্ত্রীর অন্যতম যোগ্যতা হচ্ছে বিরোধী দলের নেতার চোখ তুলে নেয়ার কলাকৌশল জানা। আর বিরোধী দলের নেতার সফলতা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত চোখ রক্ষা করা। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব ঘটনাস্থল ত্যাগ করা কিংবা আগেভাগেই এসব নেতাকে এড়িয়ে চলা। কারণ কোনো বিরোধীদলীয় নেতা যদি চোখ হারান, তাহলে তিনিও ভবিষ্যতে মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন। কারণ বাংলাদেশের ইতিহাসে চোখ হারানো বা অন্ধ কোনো ব্যক্তি কখনো মন্ত্রী হয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। আর যদি মন্ত্রী তাতে সফল হন, তাহলে সুপার ডিজিটাল যুগ অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি মন্ত্রী থাকতে পারবেন। আলোচিত এই টেলিভিশন টকশোতে আসলে মন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা কেউই বিজয়ী হতে পারেননি। মন্ত্রী দলের নেতাকর্মীদের কাছে তার আচরণের জন্য সাধুবাদ পেলেও দেশের মানুষ তার চূড়ান্ত সাফল্য অর্জনের ব্যর্থতায় হতাশ হয়েছেন। আর বিরোধী দলের এই নেতা কোনোমতে চোখ রক্ষা করতে পারলেও মানববন্ধন করে যে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেছেন, তাতে মানুষ তার সাহসিকতার অভাব দেখতে পাচ্ছে। এমন দুর্বল লোকেরা যদি দেশের মন্ত্রী হন, তাহলে দেশের অগ্রগতি আরো থেমে যেতে পারে। ডিজিটাল যুগের ভোটারদের এখন প্রধান কর্তব্য হচ্ছেÑ আগামী নির্বাচনে আরো সাহসী জনপ্রতিনিধি খুঁজে বের করা, যারা চোখ তুলে নেয়ার হুমকি না দিয়ে সাথে সাথেই চোখে আঙুল বসিয়ে দেবেন অথবা টকশোর মতো অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে পকেটে খেজুরকাটা নিয়ে যাবেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন