জেনারেল হারুন ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন
সৈয়দ আবদাল আহমদ
পাহাড়সমান বড় এক দুর্নীতি-লুটপাটের কাহিনীর নাম ডেসটিনি। নানা প্রতারণা এবং প্রলোভনের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশের গরিব মানুষ এবং সাধারণ চাকরিজীবীদের টাকা-পয়সাই শুধু হাতিয়ে নেয়নি, তাদের সর্বস্বান্তও করে দিয়েছে। প্রাথমিক তদন্তেই দেখা গেছে, ডেসটিনি গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। আর এ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে এবং দুর্নীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যে মানুষটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন, তিনি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল হারুন-অর-রশীদ।
জেনারেল হারুনের বর্তমান পরিচয়, তিনি ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট। এর আগে তার পরিচয় ছিল তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সদস্য সচিব। এরও আগে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান অর্থাত্ সেনাপ্রধান ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তিনি অংশ নিয়েছেন। অর্থাত্ তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও। এমন একজন ব্যক্তির দ্বারা যখন দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়, সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তিনি নিজেও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তখন তার অপরাধকে কোনোভোবেই ছোট অপরাধ বলা চলে না। দুর্নীতি-লুটপাটের জন্য যারা ডেসটিনি বানিয়েছে, তারা তো দুর্নীতিবাজ অপরাধীই। কিন্তু যারা দুর্নীতির বিষয়টি জেনেশুনে সজ্ঞানে নিজেকে সেই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত করেছে, তার অপরাধ আরও বড়, আরও বিশাল। ডেসটিনির দুর্নীতিবাজরা জেনারেল হারুনকে সাবেক সেনাপ্রধান, একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং শেখ হাসিনা সরকারের কাছের লোক জেনেই এ কোম্পানির প্রেসিডেন্ট করেছে। তাকে মাসিক বেতন দেয়া হয়েছে দুদকের আইনজীবীর মতে ১০ লাখ টাকা। তবে অলিখিতভাবে তার মাসিক বেতন ২০ লাখ টাকা বলে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে। এছাড়া ডেসটিনি থেকে তিনি মোটা অঙ্কের কমিশন পেতেন। ডেসটিনিকে তিনি ছায়া দেবেন—এ শর্তেই তার নিয়োগ এবং শীর্ষপদে বসানো। জেনারেল হারুন তার দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়েই ডেসটিনির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন। এতে ডেসটিনির দুর্নীতির দায় থেকে জেনারেল হারুন কোনোভাবে মুক্ত নন; বরং তার অপরাধ ডেসটিনির এমডি-পরিচালকদের চেয়েও বেশি। কারণ জেনারেল হারুন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ইমেজকে ক্ষুণ্ন করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের ইমেজকে ক্ষুণ্ন করেছেন। তার অনুধাবন করা উচিত ছিল, তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ ওই পদে থাকার কারণেই তাকে দিয়ে কাজ উদ্ধারের জন্য ডেসটিনি তাকে চাকরি দিয়েছে। হতে পারে তিনি অবসরপ্রাপ্ত একজন সেনাপ্রধান কিন্তু তিনি যখন দুর্নীতিগ্রস্ত একটি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেনাবাহিনীর ইমেজও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটা জেনেও জেনারেল হারুন এমন কুকর্মে জড়িত হলেন। সুতরাং তার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। এরই মধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করার জন্য জেনারেল হারুনের বড় ধরনের শাস্তি হওয়া উচিত। তিনি এ পর্যন্ত যেসব রাষ্ট্রীয় ও সরকারি পদক পেয়েছেন, সম্মান পেয়েছেন, তা-ও ছিনিয়ে নেয়া উচিত।
দুদকের মামলার আসামি হিসেবে জেলে নেয়ার পর বৃহস্পতিবার জেনারেল হারুনকে হাইকোর্ট থেকে জামিন দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দুদক থেকে তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টেও অস্বাভাবিক লেনদেন পাওয়া গেছে। তদন্তে দেখা গেছে, জেনারেল হারুনের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ডেসটিনির অ্যাকাউন্ট থেকে ১৯ কোটি ৮২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা জমা হয়েছে। আবার এ টাকা থেকে তিনি ১৩ কোটি ৯৭ লাখ ৯৬ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন। এ টাকা কোথায় গেল, এখনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। মামলার শুনানির সময় জেনারেল হারুনের আইনজীবী আবদুল মতিন খসরু আদালতে বলেন, তার মক্কেল জেনারেল হারুন ডেসটিনির একজন বেতনভুক্ত কর্মকর্তা ছাড়া কিছুই নন। তাছাড়া তিনি জেনারেল হারুনকে মুক্তিযুদ্ধের একজন ‘সেক্টর কমান্ডার’ হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জেনারেল হারুন কখনোই মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের কোথাও সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তার নাম নেই। তাছাড়া তিনি ডেসটিনির শুধুই একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী এটাও ঠিক নয়। সেটা হলে তার অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে কীভাবে। গত নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ হয়েছিল। এ সংগঠনের সদস্য সচিব হিসেবে তিনি কাজ করেন। এ পদটিকেও তিনি অপব্যবহার করেছেন। ডেসটিনির দুর্নীতির কাজে ব্যবহার করেছেন। ডেসটিনির দুর্নীতির বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার জন্য তিনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সাক্ষাত্কার চান সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সদস্য সচিব হিসেবে। পরে অর্থমন্ত্রী যখন জানতে পারেন জেনারেল হারুন ডেসটিনির লোকজনকে নিয়ে দেখা করতে এসেছেন, তখন ওই সাক্ষাত্কার বাতিল করে দেন।
হাইকোর্টে ১১ অক্টোবর জামিন আবেদন নিয়ে শুনানিকালে তার আইনজীবী জেনারেল হারুনের সামাজিক মর্যাদার বিষয় তুলে ধরেন। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, জনগণের অর্থ আত্মসাত্কারী চোরদের আবার সামাজিক মর্যাদা কিসের? রাষ্ট্রের স্বার্থে জনগণের অর্থ আত্মসাত্কারীদের উপযুক্ত বিচারে সহায়তা করতে আমি দাঁড়িয়েছি।
ডেসটিনির দুর্নীতির সঙ্গে জেনারেল হারুন যুক্ত হওয়ায় সেক্টর কমান্ডারস ফোরামও বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে। তবু দেখা যায় জেনারেল হারুন ডেসটিনি ছাড়েননি; সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সদস্য সচিবের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ বিষয়টি হাইকোর্টে শুনানির সময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, শুধু টাকার জন্য জেনারেল হারুন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম থেকে পদত্যাগ করেন। কই, তিনি তো ডেসটিনি থেকে পদত্যাগ করেননি? তার অ্যাকাউন্টে ১৯ কোটি ৮২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা এলো কোত্থেকে? এ টাকা থেকে ১৩ কোটি ৯৭ লাখ ৯৬ হাজার টাকা তিনি সরিয়ে ফেলেছেন। কোথায় গেল সেসব টাকা? এখনও তার অ্যাকাউন্টে ৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা রয়েছে। ডেসটিনির গ্রাহকদের কাছ থেকে তোলা এ টাকা তিনি ডেসটিনির অ্যাকাউন্ট থেকে নিজের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেছেন। তাই তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের মামলা হয়েছে।
তদন্তে ডেসটিনির দুর্নীতি
হাত খুলে দুর্নীতিতে নামে ডেসটিনি। ডেসটিনি গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা ৩ হাজার ৮শ’ কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন বলে সরকারি তদন্তেই উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা সরাসরি তছরুপ করা হয়েছে। বাকি ২ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার লেনদেন অস্বাভাবিক ও সন্দেহভাজন। এই অর্থ কোথায় আছে, কেউ জানে না। এজন্য আরও নিবিড় তদন্ত দরকার।
গত ১৩ অক্টোবর সাংবাদিকদের কাছে ডেসটিনির অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদফতরের (রেজসকো) নিবন্ধককে প্রধান করে ৯ সদস্যের এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ৮ মাসের মাথায় এই তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়।
তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায়, ডেসটিনি গ্রুপের ৩৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬টির কোনো না কোনোভাবে কার্যক্রম আছে। বাকি ১৩টি প্রতিষ্ঠান নামকাওয়াস্তে। এর মধ্যে ডেসটিনি ২০০০ সহ ২৬টি কোম্পানির মধ্যে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে ৪৭৩ কোটি টাকার। ২৬ কোম্পানির অস্বাভাবিক লেনদেন এক হাজার ২৮২ কোটি টাকার। আর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৬২ কোটি টাকার। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাত্রা আরও কত ব্যাপক তা নিবিড় তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে।
বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেন সাংবাদিকদের কাছে ডেসটিনির অনিয়ম-দুর্নীতির কর্মকাণ্ডকে অবহিত করেছেন মাকড়সার জাল হিসেবে। মাঠে-ঘাটে যেখানে-সেখানে তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। ট্রি-প্লান্টেশন প্রকল্পের নামে ডেসটিনি এক গাছ ১০০ জনের কাছে বিক্রি করেছে। কতজনের কাছ থেকে যে তারা টাকা নিয়েছেন, আল্লাহই জানেন। অদ্ভুত অদ্ভুত সব পণ্য তারা বিক্রি করেছেন। অথচ ডেসটিনির নিজস্ব কোনো পণ্য নেই। পরিচালকরা কিছু পণ্য উত্পন্ন করতেন। উচ্চ দামে সেগুলো বিপণন করা হতো। তারপর তারা কমিশন ভাগাভাগি করতেন। ডেসটিনি পরিবারভুক্ত ২২ পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডার নিজেদের মধ্যেই অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করেছেন। শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেননি। চড়া সুদে অবৈধ ব্যাংকিং করেছে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি। ক্রমাগত লোকসানি প্রতিষ্ঠানে মূলধন বিনিয়োগের মাধ্যমে তহবিল তছরুপ করেছেন পরিচালকরা। তাদের ব্যাংক হিসাবে সমিতির অর্থ বেআইনিভাবে স্থানান্তরিত হয়েছে। বৃক্ষরোপণের নামে মানুষের কাছ থেকে যে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে, তার কোনো হদিস নেই।
তদন্ত কমিটি তাদের সুপারিশে ডেসটিনির শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সাতটি সংস্থার কথা উল্লেখ করেছে। এগুলো হচ্ছে—দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও রেজসকো। দুদক এরই মধ্যে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ডেসটিনির ২২ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। দুদক টাকা আত্মসাতের অভিযোগেও মামলা করেছে। মামলার আসামিরা হচ্ছেন—ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন, প্রেসিডেন্ট লে. জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশীদ, রফিকুল আমীনের স্ত্রী ফারাহ দীবা, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন, ডায়মন্ড বিল্ডার্স লিমিটেডের পরিচালক দিদারুল আলম, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোফরানুল হক, পরিচালক সাঈদ-উর রহমান, মেজবাহউদ্দিন স্বপন, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ইরফান আহমেদ সানি, জামসেদ আরা চৌধুরী, শেখ তৈয়েবুর রহমান, গোপাল চন্দ্র বিশ্বাস, জাকির হোসেন, আজাদ রহমান, সাঈদুল ইসলাম খান, আবুল কালাম আজাদ, আকরাম হোসেন সুমন, শিরিন আক্তার, রফিকুল ইসলাম সরকার, মুজিবুর রহমান ও সুমন আলী খান।
গত ১১ অক্টোবর ডেসটিনির তিন শীর্ষ কর্মকর্তা ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশীদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন ও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাদের জেলে পাঠিয়ে দেন। দুদক এই তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে ১০ দিন করে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করে। হাইকোর্টে জামিন আবেদন শুনানির পর বৃহস্পতিবার জেনারেল হারুনকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয়া হয়। আদেশে বলা হয়, ডেসটিনির সঙ্গে জেনারেল হারুন কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবেন না। এমনকি ডেসটিনির অফিসের আশপাশে যেতে পারবেন না এবং টেলিফোন যোগাযোগও করতে পারবেন না।
জেনারেল হারুন সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায়ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তত্কালীন শেখ হাসিনা সরকারের (১৯৯৬-২০০১) মেয়াদের শেষদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি বিতর্কিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে অংশ নিয়ে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য সমালোচিত হন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
জেনারেল হারুনের বর্তমান পরিচয়, তিনি ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট। এর আগে তার পরিচয় ছিল তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সদস্য সচিব। এরও আগে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান অর্থাত্ সেনাপ্রধান ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তিনি অংশ নিয়েছেন। অর্থাত্ তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও। এমন একজন ব্যক্তির দ্বারা যখন দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়, সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তিনি নিজেও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তখন তার অপরাধকে কোনোভোবেই ছোট অপরাধ বলা চলে না। দুর্নীতি-লুটপাটের জন্য যারা ডেসটিনি বানিয়েছে, তারা তো দুর্নীতিবাজ অপরাধীই। কিন্তু যারা দুর্নীতির বিষয়টি জেনেশুনে সজ্ঞানে নিজেকে সেই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত করেছে, তার অপরাধ আরও বড়, আরও বিশাল। ডেসটিনির দুর্নীতিবাজরা জেনারেল হারুনকে সাবেক সেনাপ্রধান, একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং শেখ হাসিনা সরকারের কাছের লোক জেনেই এ কোম্পানির প্রেসিডেন্ট করেছে। তাকে মাসিক বেতন দেয়া হয়েছে দুদকের আইনজীবীর মতে ১০ লাখ টাকা। তবে অলিখিতভাবে তার মাসিক বেতন ২০ লাখ টাকা বলে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে। এছাড়া ডেসটিনি থেকে তিনি মোটা অঙ্কের কমিশন পেতেন। ডেসটিনিকে তিনি ছায়া দেবেন—এ শর্তেই তার নিয়োগ এবং শীর্ষপদে বসানো। জেনারেল হারুন তার দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়েই ডেসটিনির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন। এতে ডেসটিনির দুর্নীতির দায় থেকে জেনারেল হারুন কোনোভাবে মুক্ত নন; বরং তার অপরাধ ডেসটিনির এমডি-পরিচালকদের চেয়েও বেশি। কারণ জেনারেল হারুন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ইমেজকে ক্ষুণ্ন করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের ইমেজকে ক্ষুণ্ন করেছেন। তার অনুধাবন করা উচিত ছিল, তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ ওই পদে থাকার কারণেই তাকে দিয়ে কাজ উদ্ধারের জন্য ডেসটিনি তাকে চাকরি দিয়েছে। হতে পারে তিনি অবসরপ্রাপ্ত একজন সেনাপ্রধান কিন্তু তিনি যখন দুর্নীতিগ্রস্ত একটি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেনাবাহিনীর ইমেজও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটা জেনেও জেনারেল হারুন এমন কুকর্মে জড়িত হলেন। সুতরাং তার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। এরই মধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করার জন্য জেনারেল হারুনের বড় ধরনের শাস্তি হওয়া উচিত। তিনি এ পর্যন্ত যেসব রাষ্ট্রীয় ও সরকারি পদক পেয়েছেন, সম্মান পেয়েছেন, তা-ও ছিনিয়ে নেয়া উচিত।
দুদকের মামলার আসামি হিসেবে জেলে নেয়ার পর বৃহস্পতিবার জেনারেল হারুনকে হাইকোর্ট থেকে জামিন দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দুদক থেকে তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টেও অস্বাভাবিক লেনদেন পাওয়া গেছে। তদন্তে দেখা গেছে, জেনারেল হারুনের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ডেসটিনির অ্যাকাউন্ট থেকে ১৯ কোটি ৮২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা জমা হয়েছে। আবার এ টাকা থেকে তিনি ১৩ কোটি ৯৭ লাখ ৯৬ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন। এ টাকা কোথায় গেল, এখনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। মামলার শুনানির সময় জেনারেল হারুনের আইনজীবী আবদুল মতিন খসরু আদালতে বলেন, তার মক্কেল জেনারেল হারুন ডেসটিনির একজন বেতনভুক্ত কর্মকর্তা ছাড়া কিছুই নন। তাছাড়া তিনি জেনারেল হারুনকে মুক্তিযুদ্ধের একজন ‘সেক্টর কমান্ডার’ হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জেনারেল হারুন কখনোই মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের কোথাও সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তার নাম নেই। তাছাড়া তিনি ডেসটিনির শুধুই একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী এটাও ঠিক নয়। সেটা হলে তার অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে কীভাবে। গত নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ হয়েছিল। এ সংগঠনের সদস্য সচিব হিসেবে তিনি কাজ করেন। এ পদটিকেও তিনি অপব্যবহার করেছেন। ডেসটিনির দুর্নীতির কাজে ব্যবহার করেছেন। ডেসটিনির দুর্নীতির বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার জন্য তিনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সাক্ষাত্কার চান সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সদস্য সচিব হিসেবে। পরে অর্থমন্ত্রী যখন জানতে পারেন জেনারেল হারুন ডেসটিনির লোকজনকে নিয়ে দেখা করতে এসেছেন, তখন ওই সাক্ষাত্কার বাতিল করে দেন।
হাইকোর্টে ১১ অক্টোবর জামিন আবেদন নিয়ে শুনানিকালে তার আইনজীবী জেনারেল হারুনের সামাজিক মর্যাদার বিষয় তুলে ধরেন। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, জনগণের অর্থ আত্মসাত্কারী চোরদের আবার সামাজিক মর্যাদা কিসের? রাষ্ট্রের স্বার্থে জনগণের অর্থ আত্মসাত্কারীদের উপযুক্ত বিচারে সহায়তা করতে আমি দাঁড়িয়েছি।
ডেসটিনির দুর্নীতির সঙ্গে জেনারেল হারুন যুক্ত হওয়ায় সেক্টর কমান্ডারস ফোরামও বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে। তবু দেখা যায় জেনারেল হারুন ডেসটিনি ছাড়েননি; সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সদস্য সচিবের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ বিষয়টি হাইকোর্টে শুনানির সময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, শুধু টাকার জন্য জেনারেল হারুন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম থেকে পদত্যাগ করেন। কই, তিনি তো ডেসটিনি থেকে পদত্যাগ করেননি? তার অ্যাকাউন্টে ১৯ কোটি ৮২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা এলো কোত্থেকে? এ টাকা থেকে ১৩ কোটি ৯৭ লাখ ৯৬ হাজার টাকা তিনি সরিয়ে ফেলেছেন। কোথায় গেল সেসব টাকা? এখনও তার অ্যাকাউন্টে ৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা রয়েছে। ডেসটিনির গ্রাহকদের কাছ থেকে তোলা এ টাকা তিনি ডেসটিনির অ্যাকাউন্ট থেকে নিজের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেছেন। তাই তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের মামলা হয়েছে।
তদন্তে ডেসটিনির দুর্নীতি
হাত খুলে দুর্নীতিতে নামে ডেসটিনি। ডেসটিনি গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা ৩ হাজার ৮শ’ কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন বলে সরকারি তদন্তেই উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা সরাসরি তছরুপ করা হয়েছে। বাকি ২ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার লেনদেন অস্বাভাবিক ও সন্দেহভাজন। এই অর্থ কোথায় আছে, কেউ জানে না। এজন্য আরও নিবিড় তদন্ত দরকার।
গত ১৩ অক্টোবর সাংবাদিকদের কাছে ডেসটিনির অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদফতরের (রেজসকো) নিবন্ধককে প্রধান করে ৯ সদস্যের এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ৮ মাসের মাথায় এই তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়।
তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায়, ডেসটিনি গ্রুপের ৩৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬টির কোনো না কোনোভাবে কার্যক্রম আছে। বাকি ১৩টি প্রতিষ্ঠান নামকাওয়াস্তে। এর মধ্যে ডেসটিনি ২০০০ সহ ২৬টি কোম্পানির মধ্যে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে ৪৭৩ কোটি টাকার। ২৬ কোম্পানির অস্বাভাবিক লেনদেন এক হাজার ২৮২ কোটি টাকার। আর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৬২ কোটি টাকার। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাত্রা আরও কত ব্যাপক তা নিবিড় তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে।
বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেন সাংবাদিকদের কাছে ডেসটিনির অনিয়ম-দুর্নীতির কর্মকাণ্ডকে অবহিত করেছেন মাকড়সার জাল হিসেবে। মাঠে-ঘাটে যেখানে-সেখানে তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। ট্রি-প্লান্টেশন প্রকল্পের নামে ডেসটিনি এক গাছ ১০০ জনের কাছে বিক্রি করেছে। কতজনের কাছ থেকে যে তারা টাকা নিয়েছেন, আল্লাহই জানেন। অদ্ভুত অদ্ভুত সব পণ্য তারা বিক্রি করেছেন। অথচ ডেসটিনির নিজস্ব কোনো পণ্য নেই। পরিচালকরা কিছু পণ্য উত্পন্ন করতেন। উচ্চ দামে সেগুলো বিপণন করা হতো। তারপর তারা কমিশন ভাগাভাগি করতেন। ডেসটিনি পরিবারভুক্ত ২২ পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডার নিজেদের মধ্যেই অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করেছেন। শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেননি। চড়া সুদে অবৈধ ব্যাংকিং করেছে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি। ক্রমাগত লোকসানি প্রতিষ্ঠানে মূলধন বিনিয়োগের মাধ্যমে তহবিল তছরুপ করেছেন পরিচালকরা। তাদের ব্যাংক হিসাবে সমিতির অর্থ বেআইনিভাবে স্থানান্তরিত হয়েছে। বৃক্ষরোপণের নামে মানুষের কাছ থেকে যে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে, তার কোনো হদিস নেই।
তদন্ত কমিটি তাদের সুপারিশে ডেসটিনির শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সাতটি সংস্থার কথা উল্লেখ করেছে। এগুলো হচ্ছে—দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও রেজসকো। দুদক এরই মধ্যে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ডেসটিনির ২২ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। দুদক টাকা আত্মসাতের অভিযোগেও মামলা করেছে। মামলার আসামিরা হচ্ছেন—ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন, প্রেসিডেন্ট লে. জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশীদ, রফিকুল আমীনের স্ত্রী ফারাহ দীবা, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন, ডায়মন্ড বিল্ডার্স লিমিটেডের পরিচালক দিদারুল আলম, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোফরানুল হক, পরিচালক সাঈদ-উর রহমান, মেজবাহউদ্দিন স্বপন, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ইরফান আহমেদ সানি, জামসেদ আরা চৌধুরী, শেখ তৈয়েবুর রহমান, গোপাল চন্দ্র বিশ্বাস, জাকির হোসেন, আজাদ রহমান, সাঈদুল ইসলাম খান, আবুল কালাম আজাদ, আকরাম হোসেন সুমন, শিরিন আক্তার, রফিকুল ইসলাম সরকার, মুজিবুর রহমান ও সুমন আলী খান।
গত ১১ অক্টোবর ডেসটিনির তিন শীর্ষ কর্মকর্তা ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশীদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীন ও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাদের জেলে পাঠিয়ে দেন। দুদক এই তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে ১০ দিন করে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করে। হাইকোর্টে জামিন আবেদন শুনানির পর বৃহস্পতিবার জেনারেল হারুনকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয়া হয়। আদেশে বলা হয়, ডেসটিনির সঙ্গে জেনারেল হারুন কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবেন না। এমনকি ডেসটিনির অফিসের আশপাশে যেতে পারবেন না এবং টেলিফোন যোগাযোগও করতে পারবেন না।
জেনারেল হারুন সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায়ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তত্কালীন শেখ হাসিনা সরকারের (১৯৯৬-২০০১) মেয়াদের শেষদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি বিতর্কিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে অংশ নিয়ে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য সমালোচিত হন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন