অলিউল্লাহ নোমান
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পৌনে চার বছরে শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ আর স্বজনপ্রীতির মহারেকর্ড গড়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মহাজোট সরকারের আমলে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় বিবেচনায় ১২৫ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার বদলে প্রাধান্য পেয়েছে দলীয় বিবেচনা। সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাননি এমন ব্যক্তিও নিয়োগ পেয়েছেন শিক্ষক হিসেবে। প্রথম শ্রেণী প্রাপ্তদের বাদ দিয়ে খারাপ রেজাল্টধারীদেরও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এমনকি দলীয়করণের প্রভাবে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের শত বছরের পুরনো ছাত্রাবাসে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনার নায়ক কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তাজিম উদ্দীন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। একই সঙ্গে তিনি কলেজ ছাত্রলীগেরও সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার নেতৃত্বেই আগুন দেয়া হয় এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষকদের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মেধাবীদের বাদ দিয়ে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের শিক্ষক নিয়োগ, কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রথম স্থান অধিকারী শিক্ষার্থীকে বাদ দিয়ে ১৮তম স্থান অধিকারীকে শিক্ষক নিয়োগ, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত পদের সঙ্গে যোগ্যতার ন্যূনতম কোনো মিল না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ প্রদান, পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনার্স না থাকা সত্ত্বেও ২ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ, অধিকাংশ বিভাগে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দিতে প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত রেজাল্টধারীদের বাদ দিয়ে দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণী প্রাপ্তদের নিয়োগ, এক বিভাগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অন্য বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ, কম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভিসির নিজ এলাকার প্রার্থীদের অগ্রাধিকার, বিভাগের নাম পরিবর্তন করে ক্ষমতাসীন দলীয় শিক্ষকের এক স্ত্রীর নিয়োগ, বাংলা বিভাগে কলেজ থেকে ডিগ্রিধারীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগ, বর্তমান আমলে নিয়োগ পাওয়া ৩৮ জন শিক্ষককে দেড় থেকে দুই বছরের মাথায় সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি, শিক্ষক সমিতির নীতিমালা ও বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে দলীয় শিক্ষকদের পদোন্নতি দিয়ে অনিয়মের রেকর্ড গড়েছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।
ক্যাম্পাসের একটি সূত্র জানায়, একটি বিশেষ ধর্মের পরিচয় বহনকারী প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দেয়া হয়। ওই ধর্মের পরিচয় বহনকারী অন্তত ২৫ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া কলেজে অনার্স পড়ুয়া এক শিক্ষককে বাংলা বিভাগে নিয়োগ দিতে সিলেকশন বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যের তীব্র আপত্তি ছিল। সিলেকশন বোর্ডের বিরোধিতা সত্ত্বেও ওই ব্যক্তিকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট লঙ্ঘন ও শিক্ষক সমিতির নীতিমালা অগ্রাহ্য করে গত আগস্ট মাসে ৩৮ জন প্রভাষককে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নীতিমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবে না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে পদোন্নতিতে এত বড় অনিয়ম আর কখনও হয়নি বলে জানা গেছে। একটি সূত্র জানায়, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিল নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের প্রার্থীদের (ভিসিপন্থী) বিজয়ী করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় প্রশাসন গত আগস্ট মাসে এ সিদ্ধান্ত নেয়। সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের সাবেক ক্যাডার মিরাজুল ইসলামকে পরিসংখ্যান বিভাগে, সাবেক ছাত্রলীগ ক্যাডার নুরুল হোসাইন রিজুকে অর্থনীতি বিভাগে, শাকিনুল ইসলাম মণ্ডলকে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে, কলেজ থেকে অনার্স পাস করা ও সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা জফির উদ্দিনকে বাংলা বিভাগে, ফরেস্টি বিভাগে স্বপন কুমার সরকারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ রকম ২৪টি বিভাগে অযোগ্য প্রার্থীকে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রথম স্থান অধিকারী আয়েশা তাসনিম নামের এক ছাত্রীকে বাদ দিয়ে ২০০৯ সালে ১৮তম স্থান অধিকারী একজনকে ওই বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়। বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জাফর ইকবাল আয়েশা তাসনিমকে বোরকা পরার কারণে নিয়োগ দেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। জাফর ইকবাল এই বিভাগের প্রধান। বর্তমান আমলে তার প্রভাবে দলীয় বিবেচনায় ১১ জনকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এটিই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগের সর্বোচ্চসংখ্যক নিয়োগ। প্রভাষক নিয়োগে চরম দলীয়করণের কারণে প্রার্থীদের ৪টি প্রথম শ্রেণী/বিভাগপ্রাপ্ত প্রার্থীকে পাত্তা না দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী/বিভাগধারী বেশ কয়েকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে এই বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। অনার্সে ফল প্রকাশের আগেই প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে হৈচৈ ফেলে দেন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রভাষক ইয়ামিন রহমান। অধ্যাপক জাফর ইকবালের আস্থাভাজন হওয়ার কারণেই ফল প্রকাশের আগে ২০১০ সালে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত পদের সঙ্গে যোগ্যতার ন্যূনতম কোনো মিল না থাকা সত্ত্বেও রাজিয়া সুলতানা চৌধুরী নামে একজনকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনার্স না থাকা সত্ত্বেও ২০০৯ সালে শাহেদুল হাসান ও শাহানা আক্তার নামে ২ জনকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি না নিয়েও এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগে প্রভাষক হন এই ২ জন।
বাংলা বিভাগে শিক্ষা ছুটিজনিত শূন্যতা না থাকলেও শিক্ষা ছুটিজনিত কারণ দেখিয়ে প্রভাষক পদে ২টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। ওই পদে ঢাবি, জাবি, চবি থেকে প্রভাষক পদের জন্য মোট ২৫টি আবেদন জমা পড়েছে, যার মধ্যে ঢাবি থেকে ৪ জন, চবি থেকে ৭ জন, জবি থেকে ৭ জন, রাবি থেকে ৪ জন প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্ত প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু তাদের নিয়োগ না দিয়ে বাংলা বিভাগে কলেজ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করা জফির উদ্দিনকে ২০১১ সালে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া তার শিক্ষাজীবনে তৃতীয় বিভাগও রয়েছে। সিলেকশন বোর্ডের ৩ জন সদস্যের মধ্যে ২ জন সদস্য নোট অব ডিসেন্ট দিলেও তাকে বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ দিতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে নিয়োগ দেন ভিসি সালেহ উদ্দিন। ওই সময়ে শিক্ষকরা বিষয়টি নিয়ে দেখা করতে গেলে ভিসি বলেন, সারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একদিকে হলেও আমি তাকে নিয়োগ দিয়ে ছাড়ব। আবার নিয়োগের দেড় বছর যেতে না যেতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৪তম সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষক সমিতির নীতিমালা লঙ্ঘন করে জফিরকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এ নিয়োগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী পন্থী শিক্ষকরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
সূত্র আরও জানায়, ব্যবসা প্রশাসন বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য ২০০৯ সালে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান প্রাপ্ত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএতে ফার্স্টক্লাস রেজাল্টধারী রেদুয়ান রেজাকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তখন অন্তত ৫জন প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় শ্রেণী প্রাপ্ত আবদুল্লাহকে নিয়োগ দেয়া হয়। তখন বিবিএ বিভাগের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো ফলাফলকারী আবদুল্লাহ আল আলোকে শিবির আখ্যায়িত করে বাদ দেয়া হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, শিক্ষক পদোন্নতির ক্ষেত্রে মাস্টার্সে তৃতীয় সেমিস্টার পূর্ণ না থাকা সত্ত্বেও ১৬৮তম সিন্ডিকেটে প্রভাষক আবু সাঈদ আরেফিন খান, কাজী মাসুম, জীবন চন্দ্র দেব ও আবু হালিমকে অবৈধভাবে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে এমসি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তাজিম উদ্দিনকে নিয়োগ দেয়া হয় ২০১০ সালে। ছাত্রলীগের সভাপতি থাকা অবস্থায় তিনি সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় এ নিয়োগ পান। নিয়োগের ১ বছরের মাথায় ২০১১ সালে আবার তাকে সহকারী মহাবিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। শাবিতে পূর্ণ চাকরিরত অবস্থায় তাজিম উদ্দীন এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনায় নেতৃত্ব দেন। পরে এ ঘটনায় ছাত্রলীগের এ ক্যাডারের বিরুদ্ধে তিন-তিনটি মামলা হয়।
মেধাহীন আর দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দিয়ে বর্তমান মহাজোট সমর্থিত প্রশাসন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার সুন্দর পরিবেশ ধ্বংস করে দিয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের অভিমত। সরকার সমর্থিত এক সিনিয়র শিক্ষক বলেন, উচ্চশিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণ যা হচ্ছে তা না বলাই ভালো। এ বিষয়ে ভিসির অভিমত নেয়ার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মেধাবীদের বাদ দিয়ে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের শিক্ষক নিয়োগ, কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রথম স্থান অধিকারী শিক্ষার্থীকে বাদ দিয়ে ১৮তম স্থান অধিকারীকে শিক্ষক নিয়োগ, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত পদের সঙ্গে যোগ্যতার ন্যূনতম কোনো মিল না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ প্রদান, পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনার্স না থাকা সত্ত্বেও ২ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ, অধিকাংশ বিভাগে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দিতে প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত রেজাল্টধারীদের বাদ দিয়ে দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণী প্রাপ্তদের নিয়োগ, এক বিভাগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অন্য বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ, কম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভিসির নিজ এলাকার প্রার্থীদের অগ্রাধিকার, বিভাগের নাম পরিবর্তন করে ক্ষমতাসীন দলীয় শিক্ষকের এক স্ত্রীর নিয়োগ, বাংলা বিভাগে কলেজ থেকে ডিগ্রিধারীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগ, বর্তমান আমলে নিয়োগ পাওয়া ৩৮ জন শিক্ষককে দেড় থেকে দুই বছরের মাথায় সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি, শিক্ষক সমিতির নীতিমালা ও বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে দলীয় শিক্ষকদের পদোন্নতি দিয়ে অনিয়মের রেকর্ড গড়েছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।
ক্যাম্পাসের একটি সূত্র জানায়, একটি বিশেষ ধর্মের পরিচয় বহনকারী প্রার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দেয়া হয়। ওই ধর্মের পরিচয় বহনকারী অন্তত ২৫ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া কলেজে অনার্স পড়ুয়া এক শিক্ষককে বাংলা বিভাগে নিয়োগ দিতে সিলেকশন বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যের তীব্র আপত্তি ছিল। সিলেকশন বোর্ডের বিরোধিতা সত্ত্বেও ওই ব্যক্তিকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট লঙ্ঘন ও শিক্ষক সমিতির নীতিমালা অগ্রাহ্য করে গত আগস্ট মাসে ৩৮ জন প্রভাষককে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নীতিমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবে না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে পদোন্নতিতে এত বড় অনিয়ম আর কখনও হয়নি বলে জানা গেছে। একটি সূত্র জানায়, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিল নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের প্রার্থীদের (ভিসিপন্থী) বিজয়ী করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় প্রশাসন গত আগস্ট মাসে এ সিদ্ধান্ত নেয়। সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের সাবেক ক্যাডার মিরাজুল ইসলামকে পরিসংখ্যান বিভাগে, সাবেক ছাত্রলীগ ক্যাডার নুরুল হোসাইন রিজুকে অর্থনীতি বিভাগে, শাকিনুল ইসলাম মণ্ডলকে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে, কলেজ থেকে অনার্স পাস করা ও সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা জফির উদ্দিনকে বাংলা বিভাগে, ফরেস্টি বিভাগে স্বপন কুমার সরকারকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ রকম ২৪টি বিভাগে অযোগ্য প্রার্থীকে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রথম স্থান অধিকারী আয়েশা তাসনিম নামের এক ছাত্রীকে বাদ দিয়ে ২০০৯ সালে ১৮তম স্থান অধিকারী একজনকে ওই বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়। বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জাফর ইকবাল আয়েশা তাসনিমকে বোরকা পরার কারণে নিয়োগ দেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। জাফর ইকবাল এই বিভাগের প্রধান। বর্তমান আমলে তার প্রভাবে দলীয় বিবেচনায় ১১ জনকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এটিই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগের সর্বোচ্চসংখ্যক নিয়োগ। প্রভাষক নিয়োগে চরম দলীয়করণের কারণে প্রার্থীদের ৪টি প্রথম শ্রেণী/বিভাগপ্রাপ্ত প্রার্থীকে পাত্তা না দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী/বিভাগধারী বেশ কয়েকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে এই বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। অনার্সে ফল প্রকাশের আগেই প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে হৈচৈ ফেলে দেন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রভাষক ইয়ামিন রহমান। অধ্যাপক জাফর ইকবালের আস্থাভাজন হওয়ার কারণেই ফল প্রকাশের আগে ২০১০ সালে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত পদের সঙ্গে যোগ্যতার ন্যূনতম কোনো মিল না থাকা সত্ত্বেও রাজিয়া সুলতানা চৌধুরী নামে একজনকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনার্স না থাকা সত্ত্বেও ২০০৯ সালে শাহেদুল হাসান ও শাহানা আক্তার নামে ২ জনকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি না নিয়েও এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগে প্রভাষক হন এই ২ জন।
বাংলা বিভাগে শিক্ষা ছুটিজনিত শূন্যতা না থাকলেও শিক্ষা ছুটিজনিত কারণ দেখিয়ে প্রভাষক পদে ২টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। ওই পদে ঢাবি, জাবি, চবি থেকে প্রভাষক পদের জন্য মোট ২৫টি আবেদন জমা পড়েছে, যার মধ্যে ঢাবি থেকে ৪ জন, চবি থেকে ৭ জন, জবি থেকে ৭ জন, রাবি থেকে ৪ জন প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্ত প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু তাদের নিয়োগ না দিয়ে বাংলা বিভাগে কলেজ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করা জফির উদ্দিনকে ২০১১ সালে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া তার শিক্ষাজীবনে তৃতীয় বিভাগও রয়েছে। সিলেকশন বোর্ডের ৩ জন সদস্যের মধ্যে ২ জন সদস্য নোট অব ডিসেন্ট দিলেও তাকে বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ দিতে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে নিয়োগ দেন ভিসি সালেহ উদ্দিন। ওই সময়ে শিক্ষকরা বিষয়টি নিয়ে দেখা করতে গেলে ভিসি বলেন, সারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একদিকে হলেও আমি তাকে নিয়োগ দিয়ে ছাড়ব। আবার নিয়োগের দেড় বছর যেতে না যেতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৪তম সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষক সমিতির নীতিমালা লঙ্ঘন করে জফিরকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এ নিয়োগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী পন্থী শিক্ষকরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
সূত্র আরও জানায়, ব্যবসা প্রশাসন বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য ২০০৯ সালে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান প্রাপ্ত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএতে ফার্স্টক্লাস রেজাল্টধারী রেদুয়ান রেজাকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তখন অন্তত ৫জন প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় শ্রেণী প্রাপ্ত আবদুল্লাহকে নিয়োগ দেয়া হয়। তখন বিবিএ বিভাগের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো ফলাফলকারী আবদুল্লাহ আল আলোকে শিবির আখ্যায়িত করে বাদ দেয়া হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, শিক্ষক পদোন্নতির ক্ষেত্রে মাস্টার্সে তৃতীয় সেমিস্টার পূর্ণ না থাকা সত্ত্বেও ১৬৮তম সিন্ডিকেটে প্রভাষক আবু সাঈদ আরেফিন খান, কাজী মাসুম, জীবন চন্দ্র দেব ও আবু হালিমকে অবৈধভাবে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে এমসি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তাজিম উদ্দিনকে নিয়োগ দেয়া হয় ২০১০ সালে। ছাত্রলীগের সভাপতি থাকা অবস্থায় তিনি সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় এ নিয়োগ পান। নিয়োগের ১ বছরের মাথায় ২০১১ সালে আবার তাকে সহকারী মহাবিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। শাবিতে পূর্ণ চাকরিরত অবস্থায় তাজিম উদ্দীন এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনায় নেতৃত্ব দেন। পরে এ ঘটনায় ছাত্রলীগের এ ক্যাডারের বিরুদ্ধে তিন-তিনটি মামলা হয়।
মেধাহীন আর দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দিয়ে বর্তমান মহাজোট সমর্থিত প্রশাসন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার সুন্দর পরিবেশ ধ্বংস করে দিয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের অভিমত। সরকার সমর্থিত এক সিনিয়র শিক্ষক বলেন, উচ্চশিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণ যা হচ্ছে তা না বলাই ভালো। এ বিষয়ে ভিসির অভিমত নেয়ার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন