মে. জে. (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মিডিয়ার ওপর রুষ্ট এবং ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে প্রায় সব টিভি চ্যানেলে সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিন মধ্যরাতের আগে-পরে লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচারকৃত টকশোগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের ওপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রেগে আছেন। তিনি টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের তুলনা করেছেন ‘মধ্যরাতের সিঁধকাটা চোর’দের সাথে। তিনি বলেছেন, টকশোতে অংশগ্রহণকারীরা সরকারের গলা কাটায় ব্যস্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে কয়েকটি কথা নিবেদন করতে চাই। প্রথম কথা, টকশোতে কারা অংশগ্রহণ করেন? দ্বিতীয় কথা, অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্যগুলো কী কী প্রসঙ্গে হয়? তৃতীয় কথা, টকশোগুলো সম্পর্কে অতীতের কিছু কথা। চতুর্থ কথা, টকশো নামের অনুষ্ঠান যদি বন্ধ করা হয় বা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে সরকারের কী লাভ ও কী ক্ষতি? পঞ্চম কথা, আপনি যদি বিরোধী দলে থাকেন, তাহলে কি টকশোর বিরুদ্ধে একই রকম বক্তব্য রাখবেন?
প্রথম কথা, টকশোতে কারা অংশগ্রহণ করেন? সরকারদলীয় বা সরকারি রাজনৈতিক শিবিরের ও বিরোধীদলীয় বা বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের সম্মানিত কিছু এমপিসহ সুপরিচিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীলসমাজ বা বৃহত্তর নাগরিক সমাজের সুপরিচিত জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, প্রবীণ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ বা কর্মরত সাংবাদিক, ব্যবসায়িক জগতে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, রাজনৈতিক ও সামাজিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিশ্লেষক, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষক, সরকারের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তথা আমলা, হাতেগোনা কয়েকজন সামরিক বাহিনীর সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রমুখ টকশোতে অংশগ্রহণ করেন। এ ধরনের বা প্রকৃতির সম্মানিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে মানুষ শোভন ভাষায় যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণ ও বক্তব্য যেমন আশা করেন, তেমনই পেয়ে আসছেন।
দ্বিতীয় কথা, অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্যগুলো কী কী প্রসঙ্গে হয়ে থাকে? সরকারদলীয় ব্যক্তি বা সরকারের প্রতি অনুরক্ত ব্যক্তিরা সরকারের ভালো ভালো কাজের প্রশংসা করেন কিংবা সরকারি সিদ্ধান্তগুলোর পক্ষে যুক্তি ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। বিরোধীদলীয় ব্যক্তি বা বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক মতের প্রতি অনুরক্ত ব্যক্তিরা সরকারি সিদ্ধান্তের যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা করেন এবং বিরোধীদলীয় বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেন। আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে থাকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলি, সাম্প্রতিক বড় ব্যবসায়িক ঘটনাবলি, বড় বড় সম্ভাব্য দুর্নীতির ঘটনাবলি, সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক আন্তঃদেশীয় সংবাদ, যেখানে বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের স্বার্থ জড়িত, সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা অঙ্গনের পরিস্থিতি, যেখানে দেশের মাটি ও দেশের মানুষের নিরাপত্তার প্রসঙ্গ জড়িত এবং সাম্প্রতিক কোনো সামাজিক বা ধর্মীয় বিষয় বা ঘটনা যেটা নাগরিক সমাজের চিন্তাচেতনা বা আবেগ-অনুভূতিকে স্পর্শ করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয়াবলিও অবশ্যই মাঝে মধ্যে আলোচনায় আসে।
তৃতীয় কথা, টকশোগুলো সম্পর্কে অতীতের কিছু কথা। বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরে অন্যতম পুরনো টিভি চ্যানেল হচ্ছে চ্যানেল আই এবং এটিএন বাংলা। আমার বক্তব্য ভুল হলে অবশ্যই সংশোধিত হবো, তবে আমার স্মৃতি মতে, সবচেয়ে পুরনো টকশোর অনুষ্ঠান চ্যানেল আইতে উপস্থাপিত ‘তৃতীয় মাত্রা’ জিল্লুর রহমানের উপস্থাপনায় তৃতীয় মাত্রা দশ বছর পার করেছে অতি সম্প্রতি। আরেকটি পুরনো টকশো অনুষ্ঠান হচ্ছে এটিএন বাংলায় উপস্থাপিত ‘অন্যদৃষ্টি’ উপস্থাপক ছিলেন বা আছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক শ্যামল দত্ত। এটিএন বাংলায় সম্প্রচারিত হতো আরো একটি টকশো ‘ইসলাম কী বলে আমরা কী করি’… এর উপস্থাপক হতেন একাধিক ব্যক্তি যথা ড. শমসের আলী, জেনারেল ইবরাহিম, ড. মিজানুর রহমান শেলী প্রমুখ। বর্তমানে ১৬টির বেশি টেলিভিশন চ্যানেল আছে। সব চ্যানেলের সব টকশোর বিবরণ এখানে প্রদান করা স্থানাভাবে সম্ভব নয়, যদিও দিতে পারতাম। চ্যানেল আইতে, এটিএন বাংলায়, বাংলাভিশনে নিরাপত্তা বিশ্লেষক পরিচয়ে অতীতে প্রচুর টকশোতে অংশগ্রহণ করেছি। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলেও গিয়েছি বা যাওয়া-আসা করছি। অতীতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক বা মুক্তিযোদ্ধা বা সাবেক সেনা কর্মকর্তা বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে আমি টকশোতে অংশগ্রহণ করতাম; গত সাড়ে চার বছর যাবৎ টকশোতে প্রধান পরিচয় দেয়া হয় বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান তথা একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে। বিগত বিএনপি বা চারদলীয় জোট সরকারের আমলে টকশোগুলোতে সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা আলোচকেরা করেছেন। দশ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ার ঘটনা, একুশে আগস্টের গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনা, ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের আগের ঘটনাবলি, ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের ঘটনাবলি ইত্যাদি হচ্ছে অনেক-অনেক বিষয়ের মধ্যে কয়েকটি উদাহরণ, যেগুলো টকশোতে আলোচিত হয়েছে। ‘ওয়ান-ইলেভেন’ নামক ঘটনার আগে বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রচুর আলোচনা বিভিন্ন চ্যানেলের বিভিন্ন টকশোতে হয়েছে এবং যারা পরিস্থিতিকে অবনতিশীল করার জন্য দায়ী তাদের সমালোচনা করা হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেন নামের ঘটনা এসে যাওয়ার পর অল্প কিছু দিন সেই ঘটনা নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে বেশির ভাগ টেলিভিশন চ্যানেলে। কিন্তু অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। ওয়ান-ইলেভেন চলাকালে সম্ভাব্য রাজনৈতিক বা সম্ভাব্য নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি ইত্যাদি আলোচিত হতো বেশি। আলোচনার সময় ওয়ান-ইলেভেনকালীন সরকারের সমালোচনা প্রচুর হয়েছে; প্রশংসা হয়েছে অল্প। এসব আলোচনার মাধ্যমে টেলিভিশনের দর্শকমণ্ডলী আলোচ্য বিষয়গুলোর সাথে সরাসরি পরিচিত থাকতে পারেন। যেহেতু অনেক টকশোতেই টেলিফোনে প্রশ্ন নেয়ার অবকাশ রাখা হয়েছে, তাই আলোচকেরাও জবাবদিহিতার বলয়ে থাকেন বলে অনুভব করি।
চতুর্থ কথা, টকশো যদি বন্ধ করা হয় বা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে সরকারের কী লাভ ও কী ক্ষতি? সরকারের লাভ এই যে, লাখ লাখ বা কোটি কোটি মানুষ সরকারের সমালোচনা শুনবে না। সরকারের দুর্বলতাগুলো জানবে না। অতএব, সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। অতএব, বিরোধী দলের বক্তব্যের দিকে ঝুঁকবে না বলেও সরকার মনে করছে। সরকারের আরো লাভ এই যে, উচ্চপদস্থ সরকারি রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক ব্যক্তিরা মানসিক শান্তি পাবেন। কারণ অহরহ সমালোচনা শুনতে শুনতে তাদের কান ঝালাপালা হয়ে যায়। অপর দিকে, সরকারের ক্ষতি হবে এই যে, সরকারের সমালোচনা গোপনে বা আধা গোপনে হবে, সরকারবিরোধী প্রচারণা গোপনে বা আধা গোপনে হবে, গুজব প্রচারিত হওয়ার সুযোগ বেড়ে যাবে, সাংবাদিক সমাজের বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মীরা সরকারের ওপর নারাজ থাকবেন ইত্যাদি। প্রশ্নটি যদিও সরকারের লাভ-ক্ষতি নিয়ে, তথাপি জনগণের লাভ-ক্ষতি সম্পর্কে যদি না বলি, তাহলে আমার অন্যায় হবে। জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তথ্যবিভ্রান্তি এবং টিভি অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্য হারিয়ে যাওয়ার কারণে।
পঞ্চম কথা, আপনি যদি বিরোধী দলে থাকেন তাহলে কি টকশোর বিরুদ্ধে একই রকম বক্তব্য রাখবেন? আপনি বলতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বোঝাচ্ছি। আমার সুচিন্তিত অনুমান হচ্ছে, আপনি মাননীয় শেখ হাসিনা যদি বিরোধীদলীয় নেত্রী হন ভবিষ্যতে (যার সম্ভাবনা প্রচুর), তাহলে আপনি টকশোগুলোতে সেই আগামী দিনের সরকারের সমালোচনার জন্য আপনার নেতাকর্মীদের দারুণভাবে উৎসাহিত করবেন এবং কেউ যদি ভুলেও কম সমালোচনা করে, তার ওপর রুষ্ট হবেন।
টকশো নিয়ে আমাদের এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ বা কলাম এখানে শেষ করছি এই বলে যে, অনুষ্ঠানগুলো দারুণ জনপ্রিয়, নাগরিক বা টেলিভিশন দর্শকবান্ধব এবং চ্যানেলগুলোর জনপ্রিয়তার অন্যতম মাধ্যম ও সূচক। টকশোগুলো সরকারকে মারাত্মক মারাত্মক বিপদের হাত থেকে বাঁচায়। কারণ টকশোর মাধ্যমে সমালোচনা শুনে সরকার গোপনে অনেক সাবধানতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখ চট্টগ্রাম সেনানিবাসে একটি সামরিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠানটি ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার-পাঁচ বছর পরপর অনুষ্ঠিত পুনর্মিলনী। যেহেতু আমি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টেরই একজন সাবেক অফিসার, সেহেতু দাওয়াত পেয়েছিলাম এবং উপস্থিতও ছিলাম। যদিও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক সাবেক জ্যেষ্ঠ বা মধ্যম র্যাংকের অফিসার বিশেষত মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা দাওয়াত পাননি বিভিন্ন বিদঘুটে অজুহাতে। (দ্রষ্টব্য : সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক অঙ্গনে আমি বিরোধী শিবিরে যোগ দেয়ার পর, সরকারি সামরিক অনুষ্ঠানগুলোতে যেখানে অন্যান্য জ্যেষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত অফিসাররা দাওয়াত পান, সেখানে দাওয়াত পাই না, অবশ্য আমি বিক্ষুব্ধ হলেও স্বাভাবিকভাবেই এটাকে গ্রহণ করি। কারণ এটি আমাদের দেশের সামরিক-রাজনৈতিক একটি অশোভন দীর্ঘ দিনের রেওয়াজ)। ১২ ডিসেম্বর ২০০৯ কুচকাওয়াজের পর, কেক কাটার অনুষ্ঠানস্থলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদিক-ওদিক বিভিন্ন মেহমানের সাথে দু-এক মিনিট করে আলাপচারিতা করেন। আমার সাথে যে দু-এক মিনিটের আলাপচারিতা ছিল সেখানে একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, টকশোতে যদি দু-একটা ভালো কথা বলেন, তাহলে টকশোগুলো অত ‘টক’ (ইংরেজিতে গাওয়া) হয় না। আমি উত্তরে বলেছিলাম অনেকটা এ রকম, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, খাবার টেবিলে মিষ্টিজাতীয়, টকজাতীয়, ঝালজাতীয় একাধিক স্বাদের তরকারি দিলেই টেবিলটিকে মেহমানদের কাছে পূর্ণাঙ্গ মনে হয়। কারণ, অনেক মেহমানের মধ্যে কে কোন রান্নাটি পছন্দ করবেন এটা বলা মুশকিল। টকশোর কথাগুলোও এই রকম। টক-মিষ্টি-ঝাল বিভিন্ন স্বাদের কথা যদি না থাকে তাহলে দর্শক ও শ্রোতারা বোরিং বা একঘেয়েমি অনুভব করবেন।” ১২ ডিসেম্বর ২০০৯ সালের কথাটি আমি এখনো বলতে রাজি।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.kallyan-ibrahim.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন