কক্সবাজারে বৌদ্ধদের ওপর হামলার ঘটনা
গত মাসের শেষ দিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ইন্ধনেই কক্সবাজার জেলার সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের বসতিতে ব্যাপক হামলা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে এটা ঘটেছে বলে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের যে অভিযোগ, এর সাথে একমত সব দল। আর এই মারাত্মক ঘটনার ব্যাপারে শুরু থেকেই সন্দেহের আঙুল উঠেছে সরকারি দলের দিকে। তাই পুলিশ এটাকে মোড় ঘুরিয়ে প্রথমে রোহিঙ্গাদের দিকে এবং এখন অন্যতম প্রধান বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর দিকে নিতে চেষ্টা করছে। সে মোতাবেক, আলোচিত ফেসবুকের সাথে জড়িত এক তরুণকে সরকারবিরোধী হিসেবে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
গতকাল সোমবার নয়া দিগন্তের নিজস্ব অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। সাথে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার কোর্টবাজার থেকে বের হওয়া মিছিলে নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, দলের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক, স্থানীয় দুইজন ইউপি চেয়ারম্যান প্রমুখ। উল্লিখিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, আলিফ নামে যে তরুণ ফেসবুকের ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়েছে, তার মা আওয়ামী লীগ নেত্রী। পরিবারটি বহু বছর ধরে এ দলের রাজনীতিই করে আসছে। তার সোজা কথা, ছেলে কোনো দল করে না। এ দিকে ভিক্ষুসহ বৌদ্ধরা মনে করেন, পুলিশ ও সরকারি দল ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চাচ্ছে। রামুর প্রাচীনতম সীমা বৌদ্ধবিহারের ভান্তে সত্যপ্রিয় মহাথেরো নয়া দিগন্তকে বলেছেন, রাজনৈতিক বিবেচনা নয়, আসল অপরাধীদের ধরা দরকার। বৌদ্ধ নেতারা বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক পিয়াস করিমের অভিমত, তথ্যপ্রমাণ ব্যতিরেকে রোহিঙ্গাদের দায়ী করা ঠিক নয়। আর ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বিপজ্জনক। এর চর্চা করা হলে প্রকৃত ঘটনা আড়ালে থেকে যাবে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
পূর্বোক্ত তরুণ আলিফকে কোনো কোনো মহল ‘শিবির নেতা’ হিসেবে দেখানো প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, আলিফ নামে কেউ সংগঠনটির কর্মী ছিল বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যে উত্তম বড়–য়াকে ফেসবুকে ইসলামের অবমাননাকর ছবির জন্য দায়ী করা হচ্ছে, সে পলাতক থাকায় তার বক্তব্য আসেনি। মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানসহ কেউ কেউ মনে করেন, ফেসবুক এ হামলার কারণ নয়। উত্তম বড়–য়ার বাড়ি তো হামলার শিকার হয়নি; বরং হামলাটি পরিকল্পিত, উখিয়ার মতো রামু উপজেলা সদরেও ২৯ সেপ্টেম্বর রাতের মিছিলে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতারা নেতৃত্ব দেন। উখিয়ার সে মিছিল থেকে বৌদ্ধবিহারে হামলা হয়েছে। অপর দিকে রামুতে স্থানীয় এমপি (যিনি বিএনপির একজন নেতা) বৌদ্ধদের ওপর হামলা ঠেকানোর চেষ্টা করেন বলে আওয়ামী লীগও স্বীকার করেছে। যা হোক, স্থানীয় লোকজন বলেছেন, ঘটনার রাতে মিছিল-মিটিং-হামলার অগ্রভাগে ছিলেন আওয়ামী নেতাকর্মীরা।
রামু ও উখিয়ায় বৌদ্ধদের মন্দির ও বসতিতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে ক্ষুণœ হয়েছে আমাদের দেশের সুনাম। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জনপদ রূপে বাংলাদেশের যে সুখ্যাতি, তা নষ্ট করতেই ষড়যন্ত্র করে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এযাবৎ প্রত্যক্ষদর্শীসহ বিভিন্ন সূত্রে যেসব তথ্য মিডিয়ায় এসেছে, তাতে ক্ষমতাসীন দলের সম্পৃক্ততা এবং এহেন পরিস্থিতির উদ্ভব রোধ ও নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক ব্যর্থতা স্পষ্ট। তাই সরকার এই মর্মান্তিক ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অপপ্রচারের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করা কিংবা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে বিরোধী দলকে হয়রানি-নির্যাতন করার পরিণতি কারো জন্য শুভ হবে না। তা করা হলে দোষী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাবে এবং দেশের সুনাম আরো ক্ষুণœ হবে।
আমরা মনে করি, বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট হামলাকারী এবং তাদের মদদদাতাসহ মূল চক্রান্তকারীদের চিহ্নিত করা জরুরি। দলমত নির্বিশেষে দোষী ব্যক্তিদের সবার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক আইনি ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এমন ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তির শঙ্কা দূর হবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন