মঙ্গলবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১২

অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেমে থাকে না




এক অস্থিতিশীল অবস্থার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে দেশের চলমান রাজনীতি। অপরিপক্বতা, অসহিষ্ণুতা ও অনৈক্য এবং বিভাজন চরম সীমায় এসে উপনীত হয়েছে। তাতে আতঙ্কিত হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষ। এক দিকে উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গন, অন্য দিকে অস্থির ও অশান্ত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। আরেক দিকে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও টেকনাফে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে জঘন্য হামলার পর সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আরো বেড়ে গেছে। দেশে তো বটেই, বাংলাদেশের অবনতিশীল রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বে সমালোচনার ঝড় বইছে। শাসকদের দমন-পীড়নও সীমা অতিত্র“ম করছে। ছাত্রলীগের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের কালো থাবায় দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গন মুখ থুবড়ে পড়ছে। নিরীহ ও সাধারণ ছাত্রদের ওপর চলছে অমানুষিক নির্যাতন।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ব্যাপারটি কোনো কাকতালীয় বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রামুর ঘটনার শিকড় অত্যন্ত গভীরে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি।
সুশাসন উপহার দিতে এবং জনজীবনের বিরাজমান সমস্যা সমাধানে সরকার চরমভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। তাই আগামীতে ক্ষমতায় যেতে পারবে না এই ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে, নিজেদের অধীনে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় যেতে বিরোধী দলের ওপর পরিকল্পিতভাবে অবর্ণনীয় দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। দেশের কোথাও কিছু ঘটলে সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অকারণে হয়রানি, মামলা ও গ্রেফতার করে হেনস্তা করছে। সরকারের দমননীতির মুখে বেপরোয়া পুলিশের হাতে রাস্তায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা মার খাচ্ছেন, নাজেহাল হচ্ছেন এবং রিমান্ডে যাচ্ছেন।
মনে রাখতে হবে, একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে কাউকে অসম্ভব শক্তিশালী মনে হতে পারে, আবার আরেকটি বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনিই হয়ে যেতে পারেন পৃথিবীর দুর্বলতম মানুষ। আরো মনে রাখতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন কখনো থেমে থাকে না; অন্যায়ের জয় হয় না, মানুষের ভেতরে ভেতরে ঠিকই আন্দোলন চলতে থাকে। এক সময় এই আন্দোলন দৃশ্যমান হয়ে গণবিস্ফোরণে রূপ নেয়। সেই সময় অবধারিত বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
বাংলাদেশের মানুষকে অনেক অনেক স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। বাংলাদেশ ডিজিটাল হবে, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে ইত্যাদি। তবে মানুষকে যে স্বপ্নই দেখানো হোক না কেন, স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এটি না থাকলে বাংলাদেশকে কোনো মানেই উন্নীত করা সম্ভব হবে না, উল্টো যেটুকু উন্নতি গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের হয়েছে; তা ধরে রাখাই কঠিন হবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করলে ঘোর অন্ধকার ছাড়া কোনো স্বপ্ন চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় না। গুম-গ্রেফতার ও জেল-জুলুমের শিকার হচ্ছেন শীর্ষ রাজনীতিবিদেরা! আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, যারা নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেবেন, সেই মানের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে অহরহ মামলা! দেশকে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা তৈরির পরিবর্তে, তাদের ঘুরতে হচ্ছে আদালতের দ্বারে দ্বারে! কোনো কোনো দলের শীর্ষ রাজনীতিবিদ দীর্ঘ দিন ধরে রয়েছেন জেলে! তারা জামিন পাচ্ছেন না! এই হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির বাস্তব চিত্র! দৃশ্যত রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের ফলে প্রাথমিকভাবে সরকারি দল পরিতৃপ্তি বোধ করলেও আলটিমেটলি এর চূড়ান্ত ফল বিরোধী দলের ঘরেই যাবে। তবে সরকারের এই অবিচার ও দমন-পীড়ন বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
অপরিপক্ব, অনৈক্য ও অসহিষ্ণু এবং বিভাজনের রাজনীতি চূড়ান্তভাবে দেশকে নিয়ে দাঁড় করাবে ভয়াবহ এক বিপর্যয়ের মুখোমুখিÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই! প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে দূরত্ব বাড়ছে এটি বলাই বাহুল্য। দূরত্ব বাড়ছে বললে বোধহয় কম বলা হবে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলকে নেতৃত্বশূন্য করারও চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। বিরোধী দলের নেত্রীকে হত্যার যড়ষন্ত্র হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল। দলটি বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক ভোটের অধিকারী। দেশব্যাপী দলটির রয়েছে সাংগঠনিক ভিত্তি। দলটির নেতৃত্বে পাঁচবার সরকার গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের শুভ ও বড় বড় অর্জনের সাথে বিএনপির নাম জড়িয়ে আছে। হামলা-মামলা ও দমন-পীড়নের ফলে দলটি বর্তমানে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিকূল সময় পার করছে। দলটির প্রধানকে তার ৪০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে বলতে গেলে এক প্রকার জোর করেই উচ্ছেদ করা হয়েছে।
অন্য দিকে বিএনপির প্রায় সব শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ও দলটিকে সুকৌশলে নেতৃত্বশূন্য করার পরিকল্পনা হচ্ছে বলে দলটির শীর্ষ নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন! হামলা-মামলা, গুম-গ্রেফতার ও দমন-পীড়নের ধরন দেখলে, তাদের কথার যৌক্তিকতা আছে বলেই প্রতীয়মান হয়! এমন অসহিষ্ণু, অনৈক্য ও বিভাজনের রাজনীতির ফল কোনোভাবেই ভালো হতে পারে না। এই অপরিপক্ব রাজনীতি একটি রাষ্ট্রকে সামনে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে রাষ্ট্রকে অবধারিত পেছনের দিকে নিয়ে যাবে আর বাস্তবে হচ্ছেও ঠিক তাই।
এই অবস্থায় যেকোনো সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অজানা গন্তব্য ও মারাত্মক পরিণতির দিকে মোড় নিতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কাজেই সময় থাকতে পরস্পরে ভেদাভেদ ভুলে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র তৈরি করার দিকে সবাইকে মনোনিবেশ করতে হবে। যাতে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের পথ এড়ানো সম্ভব হয়। যাতে দেশে সুস্থ রাজনীতির ধারা ফিরে আসে।
রাজনীতিতে অশুভ শক্তির উত্থানের পথ প্রশস্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়, কেননা খোদ রাজনীতিবিদদের জন্যই তা ভয়ঙ্কর, আগে-পরে রাজনীতিবিদেরাই এর শিকার হবেন। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এসব নিঃসন্দেহে অশনি সঙ্কেত!
গণতন্ত্র মেনে রাজনীতি করলে রাজনীতি কোনোভাবেই সহিংসতার পথে ধাবিত হয় না। রাজনীতিতে পরাজয়কে সহজভাবে মেনে নেয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে এবং বিজয়কে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোনো মানুষ যদি দুনিয়ার সব ক্ষমতা পেয়ে যায় আর আত্মাকে হারায় তাতে কোনো প্রশান্তি নেই।
বাংলাদেশে বিদেশী শক্তির কর্তৃত্ব কায়েমের বিশেষ তৎপরতা লক্ষণীয়। এই তৎপরতার অংশ হিসেবেই এ দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে অত্যন্ত সুকৌশলে বিভেদ-বিভক্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং ক্রমান্বয়ে এই বিভেদ-বিভক্তি ভয়ানক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যাতে জনগণের কাছে রাজনীতিবিদদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, যাতে এ দেশকে রাজনীতিশূন্য করা সম্ভব হয়। আর এটি করতে পারলেই এখানে নৈরাজ্যকর পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে। তাহলে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে বাংলাদেশে বিদেশী শক্তির কর্তৃত্ব কায়েমের পথ সুগম হবে।
বাংলাদেশ ছোট কোনো জনপদ নয়। জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের অষ্টম রাষ্ট্র। একটি রফতানিমুখী দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমর্যাদা থাকা অপরিহার্য। সঙ্ঘাতপূর্ণ ও অশান্ত রাজনীতি এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা  বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। বাংলাদেশকে উন্নয়নের শীর্ষে নিয়ে যেতে হলে, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এই নির্মোহ সত্যটি যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করা যাবে, ততই দেশের মঙ্গল হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads