বাংলাদেশ এখনো রাজনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে না পারায় এবং সঙ্কট ক্রমাগত আরো ঘনীভূত হতে থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এই উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ সফরে আগত ইইউ’র সংসদীয় প্রতিনিধি দলের চেয়ারপারসন জিন ল্যাম্বার্ট। সংসদীয় দলের সফর শেষে ইইউ’র এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন পরবর্তী অচলাবস্থার কারণে শুধু নয়, উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি এবং নির্বাচনের আগে-পরে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায়ও তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। গত ২৪ ও ২৫ মার্চ ঢাকা সফরকালে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানানোর পাশাপাশি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে আলোচনায় বসতে হবে। আর এর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক পছন্দের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের মতপ্রকাশের অধিকারও সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। গুম ও বিচাবহির্ভূত হত্যাকা-ের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ইইউ সংসদীয় দলের প্রতিনিধিরা এ ধরনের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত এবং পুলিশি নির্যাতন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্তে জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলকে সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। ইইউ সংসদীয় দল আশা প্রকাশ করে বলেছেন, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হলে বাংলাদেশের সংকট এক সময় কেটে যাবে এবং দেশটি গণতান্ত্রিক, নিরপেক্ষ ও উদার দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজনৈতিক সংকট ও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচন পর্যন্ত কোনো বিষয়েই ইইউ সংসদীয় দল সামান্য বাড়িয়ে বলেননি বরং তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও জনগণের কল্যাণের জন্য সদিচ্ছারই প্রকাশ ঘটেছে। এর কারণ, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে শুধু নয়, সাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনেও ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভোট জালিয়াতি, ভোটকেন্দ্র দখল এবং বিরোধী দলীয় প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা করেছে সরকারি দল। অনেক এলাকায় ভোটাররা এমনকি ভোটকেন্দ্রেই যেতে পারেননি। দশম সংসদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড করেছিলেন, এবার করেছেন বল প্রয়োগ করে জিতে আসার রেকর্ড। একযোগে দেশজুড়ে চালানো হচ্ছে গ্রেফতারসহ রাজনৈতিক নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার মহোৎসব। এ ধরনের বিভিন্ন কারণেই ইইউ’র সংসদীয় প্রতিনিধি দল দেশের দ্বিতীয় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, গোপন আয়োজনের ভিত্তিতে জাতীয় পার্টিকে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান দেয়া হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিন্তু এখনো বিএনপিকেই প্রধান বিরোধী দল মনে করে। সে অনুযায়ী সম্মানও দেয়। প্রসঙ্গক্রমে অন্য একটি তথ্যেরও উল্লেখ করা দরকার। সে তথ্যটি হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানীসহ বিশ্বের কোনো দেশই এ পর্যন্ত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সেইভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। প্রতিটি রাষ্ট্র বরং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছেÑ যাতে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। অর্থাৎ যতো ঢাকঢোলই পেটানো হোক না কেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং সে নির্বাচনের ভিত্তিতে গঠিত সংসদ ও সরকারের ব্যাপারে একমাত্র ভারত ছাড়া বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। যার অর্থ, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান সরকারকে তারা জনগণের নির্বাচিত সরকার বলে মনে করে না। ইইউ সংসদীয় প্রতিনিধি দলও কিছুটা ঘুরিয়ে একই কথা জানিয়ে গেছে।
আমরা মনে করি, বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। প্রতিক্রিয়া ও বিভিন্ন পরামর্শের মাধ্যমে বিদেশীরা মূলত যে মেসেজ বা বার্তা দিয়ে চলেছেন সরকারের উচিত তার মর্মার্থ অনুধাবন করা। ক্ষমতাসীনদের একই সঙ্গে অন্তরালের প্রকৃত কারণ সম্পর্কেও বুঝতে হবে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে বাইরে ঠেলে দিয়ে নির্বাচনের নামে প্রহসন করাটাই আসলে প্রধান কারণ। দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া হয়তো এতটা মারাত্মক ও প্রত্যক্ষ হতো না আগে থেকে তারা যদি নির্বাচনমুখী ঘটনাপ্রবাহে জড়িত না থাকতো এবং সরকার ও বিরোধী দলের বক্তব্য ও ভূমিকা যদি লক্ষ্য না করতো। অন্যদিকে সত্য হলো, ইইউসহ প্রায় সব রাষ্ট্রই নানাভাবে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছে। কোনো পক্ষের বক্তব্য ও অবস্থানের প্রতি প্রকাশ্যে পূর্ণ সমর্থন না জানালেও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য ক্রমাগত তাগিদ দিয়েছে। মূলত এসব দেশের আগ্রহেই জাতিসংঘের মহাসচিব পর্যন্ত উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি তার বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকেও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। বলা যায়, ক্ষমতাসীনরা ব্যর্থ করে দিয়েছেন। এরই প্রভাব পড়েছে নির্বাচন এবং নির্বাচনের পর গঠিত সরকারের প্রতি নীতি ও মনোভাবের ওপর, যার পরিণতি হতে পারে অশুভ এবং দীর্ঘমেয়াদী। আমরা মনে করি, ক্ষমতাসীনদের উচিত নিজেদের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাকে পরিত্যাগ করা এবং ইইউসহ বিদেশীদের পরামর্শ ও আহ্বানের প্রতি সম্মান দেখানো। এজন্য প্রথমে দরকার অনুষ্ঠিত নির্বাচন এবং তার মাধ্যমে গঠিত দশম সংসদ ও মন্ত্রিসভা বাতিল করা এবং তারপর সংবিধানে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিধান যুক্ত করে সে সরকারের অধীনে নতুন করে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা। সরকারকে একই সঙ্গে বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ রাজনৈতিক নির্যাতনও বন্ধ করতে হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন