শুক্রবার, ৭ মার্চ, ২০১৪

উপজেলা নির্বাচনের রাজনৈতিক ভূরাজনৈতিক জের


১৯ দলীয় বিরোধী জোটের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশবাসী ৫ জানুয়ারি মতাসীন মহাজোটের পাতানো নির্বাচন বর্জন যেভাবে কার্যকর করেছিল, জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেই ঘটনাকে নীরব বিপ্লব বলে অভিহিত করেছিলেন। ভোটকেন্দ্রগুলো ছিল ফাঁকা। মফঃস্বলের দূর-দূরাঞ্চলে রিকশাভ্যান পর্যন্ত চলেনি ওই দিন। মতাসীনেরা ভোটের দিনের দ্বিতীয়ার্ধে ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরে সিল মেরে ব্যালট বাক্স পূর্তির ব্যবস্থা নিয়ে দাবি করেছে, শতকরা ৪০ ভাগ ভোটদাতা এসেছে। নির্বাচন কমিশন সাজানো ফলাফল ঘোষণা করেছে। বেগম জিয়া বলেছেন, শতকরা ৫ ভাগ ভোটার মাত্র সংগ্রহ করতে পেরেছে প্রশাসন। আর ৫ জানুয়ারির আগেই ১৫৩টি তথা অর্ধেকেরও বেশি নির্বাচনী এলাকায় মতাসীনেরা প্রতিদ্বন্দ্বীও সংগ্রহ করতে পারেনি। শুধু ১৯ দলীয় জোট সদস্যরা নয়, বদরুদ্দোজা চৌধুরি-ড. কামাল-কাদের সিদ্দিকী জোট কিংবা সিপিবি-বাসদ জোট কিংবা অন্যান্য ছোট ডান-বাম দল কিংবা দলছুট বা নির্দলীয় প্রার্থীরাও নির্বাচন বয়কট করেছে। যেখানে অর্ধেকেরও বেশি ভোটদাতা ভোট দেয়ার সুযোগই পায়নি, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার মনোনীত ব্যক্তিরা পুনর্নির্বাচিত হতে পেরেছেন, সেখানে বাকি অংশে সিট ভাগাভাগির সাজানো প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখতে আসা নিরর্থক মনে করেছে বৈদেশিক পর্যবেকেরাও। নির্বাচনের দিন মতাসীন দলের মাস্তান ও পুলিশের সাথে বয়কটকারীদের সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ২৪ জন। তার আগে প্রায় মাসব্যাপী হরতাল অবরোধে রাজধানী ঢাকা ছিল প্রায় সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রশাসন ছিল ঢাকার বাইরে কার্যত অচল। তারও আগে বলতে গেলে প্রায় এক বছর ধরেই সরকারের কঠোর দমননীতির স্টিমরোলারে পিষ্ট হয়েছে বিরোধী জোটভুক্ত (ওই পর্যায়ে ১৮ দলীয়) নেতাকর্মীরা। হয়রানিমূলক গ্যাংকেসে জড়ানো হয়েছে লাধিক নেতাকর্মীকে, হুকুমের আসামি করা হয়েছে শীর্ষ নেতাদেরও। দীর্ঘদিন রিমান্ডে পীড়ন বা জেলে পুরে রাখা, ১০ কোর্টে দশরকম মামলা দেয়া, জামিন পেলেই জেলগেটে আরেক মামলার পরোয়ানা হাজির করা ইত্যাদি নির্যাতনে পুলিশরাজ যেভাবে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের কষ্ট দিয়েছে তা ভাবা যায় না। ইতোমধ্যে গত বছরের শুরুতে একজন ডাকসাইটে সাবেক আমলা রাজনীতিক বনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, বিরোধী জোটের দ্বিতীয় প্রধান দল জামায়াত বা তার ছাত্রসংগঠন শিবিরের কাউকে রাস্তায় দেখামাত্র গুলি করতে। জামায়াত-শিবির কারো গায়ে লেখা থাকে না। ফলে ঝটিকা মিছিল দেখামাত্র গুলি চললো ঢাকা চট্টগ্রাম খুলনা ও বগুড়ায়। এ ছাড়া গোপন নির্দেশ গেল বিােভ মিছিল থেকে চিহ্নিত করে নেতৃস্থানীয় আন্দোলনকারীদের তুলে নিয়ে ক্রস ফায়ারেমেরে ফেলার জন্য। ফলে শুধু এক জেলাতেই অবরোধ হরতালের মধ্যে স্থানীয় এমপি (বর্তমানে মন্ত্রী) পরিচালিত মোটরসাইকেল বহরে বাধাদান ও মারধরের অপরাধে পরবর্তিতে চার বাঘা কর্মী গুম হলেন, তাদের ফেলে দেয়া লাশ পাওয়া গেল চার জেলায় ছড়ানো। ৫ জানুয়ারির ব্যর্থ নির্বাচনের পর সংবাদ সম্মেলন করে বেগম জিয়া হিসাব দিলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচনপূর্ব আন্দোলন ও নির্বাচন বয়কট ঠেকাতে সরকার ৩০০ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে গুম কিংবা খুন করেছে। এ বছর ২৭ ফেব্রয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরে প্রকাশিত গত বছরের প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির যে আনুষ্ঠানিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে ওই সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাে  বাংলাদেশ সরকারের পুলিশ-র‌্যাবের হাতে নিহত হয়েছে ১৪৬ জন, গুম হয়েছে ৩৩ জন, রাজনৈতিক সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ১৮৯ জন, সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ১৪৪টি। সরাসরি প্রকাশনা বা সম্প্রচার নিষেধাজ্ঞা-জেলজুলুম, পরো হুমকি ও হয়রানির মাধ্যমে মিডিয়ার কণ্ঠরোধ বা বাধ্যতা আদায়, সরকারিপর্যায়ে দুর্নীতি, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এবং বিশেষ করে ক্রসফায়ারতথা বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা এখনো সমানে চলেছে বলে বিবৃতি এসেছে ওই রিপোর্টে। আর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেশবাসীও দেখছে বিগত সপ্তাহেই প্রায় নিত্য দুজন বা একজন করে ক্রসফায়ারেমরেছে পুলিশের হাতে আটক আসামি বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি। একজন সাংবাদিক থানার ছাদ থেকে পড়ে মরতে মরতে বলেছে, তাকে ডেকে ছাদে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে পুলিশ। তবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অগ্রহণযোগ্যপ্রমাণ করে কৌশল বদলেছে ১৯ দলীয় জোট। নিয়মতান্ত্রিক ধারাবাহিকতারায় মতাসীনদের প্রত্যাবর্তনের সরকার গঠনে কার্যত বাধা দেয়নি, তাকে অবৈধআখ্যা দিয়েছে মাত্র। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে এ দেশের অভ্যন্তরীণ ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাআখ্যা দিয়ে সরকারি সমর্থন দিয়েছিল প্রতিবেশী পরাক্রমশীল দেশ ভারত। সেই বাধ্যবাধকতা পালনের পর সংলাপের মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে আরেকটা নির্বাচন হবে, এমন খবর ভারতের সরকারি মহল ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের উদ্ধৃত করেই প্রচারিত হয়েছিল ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে। নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত করেও আরেকটা নির্বাচন দিয়ে সেই ত্রটি সংশোধনের সম্ভাব্যতা গ্রহণযোগ্য এমন ধারণা দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী দেশের কূটনীতিকরা। যেন সেই সবেরই কৃষ্ণের বাঁশি শুনে ১৯ দলীয় জোট অবরোধ-হরতাল কাতর নগরবাসীকে হাঁফ ছাড়ার অবকাশ দিতে, তিগ্রস্ত অর্থনীতিকে রাজনৈতিক রেহাই দিতে আন্দোলন বিরতি দিলো দল গোছানোর দোহাই দিয়ে। আর সেই কৃষ্ণের বাঁশিরই পার্শ্বধ্বনিতে জোট না ভেঙেও ইসলামপন্থীদের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে দল গোছানোর পন্থা, সভা সমাবেশে জামায়াত-শিবিরকে মঞ্চে না নিয়ে নিজস্ব সংঘশক্তি প্রদর্শনের কৌশল অবলম্বন করল ১৯ দলীয় বিরোধী জোটের প্রধান দল বিএনপি। অথচ বিশ্বায়নবাসীর মনোরঞ্জনে এ কথা জাহির করতে তৎপর হলো যে নীরব বিপ্লবের কারিগর হয়েও আদপে বিপ্লবী দল নয় বিএনপি, ‘নিয়মতান্ত্রিক ধারাবাহিকতারই ধ্বজাধারী নবগঠিত সরকার বাহাদুর কিন্তু সে জন্য ১৯ দলীয় বিরোধী জোটকে রেহাই দেয়নি। উল্টো আন্দোলন বিরতির সুযোগে মফঃস্বলের নীরব বিপ্লবীদের বেছে বেছে শায়েস্তা করতে র‌্যাব-পুলিশের রক্তচু চিরুনি অভিযান চালিয়েছে। রাজধানী পাহারা দিতে অতিরিক্ত পুলিশের আর প্রয়োজন না থাকায় গ্রামে গ্রামে পাঠিয়েছে গ্রেফতার তালিকা হাতে কিংবা নাম উহ্য রাখা গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে সশস্ত্র যৌথবাহিনী’ (র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবি)। অত্যাচার-গ্রেফতার-ক্রসফায়ার আতঙ্কে অনেক মহল্লা ও গ্রাম জনশূন্য থেকেছে দিনের পর দিন। মফঃস্বলে এমন অঘোষিত জরুরি অবস্থা, যা উপজেলা নির্বাচনের মধ্যেও সমানে চলেছে তার বিপরীতে রাজধানীতে অবশ্য স্বাভাবিক অবস্থার একরকম বাহ্যিক চেহারা সরকার ফিরিয়ে আনতে পেরেছে জামায়াত-শিবির বাদে ১৯ দলীয় বিরোধী জোটের অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের জামিনে মুক্তির ছাড় দিয়ে। কিন্তু অবাধ সভা সমাবেশ বা মিছিলের সুযোগ এখনো দিচ্ছে না সরকার। উপজেলা নির্বাচনেও ভোটডাকাতি কারচুপি হুমকি ধামকির সব কৌশল প্রয়োগ করে চলেছে মতাসীন গোষ্ঠী ও তার বাধ্য প্রশাসন, বাধ্য নির্বাচন কমিশন।
১৯ দলীয় জোটের কৌশল পরিবর্তনের একটা যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা এই যে : ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে যদিও প্রমাণ হয়েছে মতাসীন গোষ্ঠী জনসমর্থনরহিত, এখন মতার পটপরিবর্তনের জন্য বিশ্বায়নবাদী ভূরাজনৈতিক খেলোয়াড়দের কাছে এ কথা জাহির করা প্রয়োজন যে ১৯ দলীয় জোটের নেতৃত্বের প্রতি এ দেশের জনসমর্থন রয়েছে, আর প্রশাসনিক পপাত সত্ত্বেও স্থানীয় নির্বাচনের স্থানীয় শ্যেনচুর নজরদারিতে উপজেলা নির্বাচনে শামিল হয়ে তার প্রমাণ দেয়া সম্ভব। বাস্তবিক দুদফা উপজেলা নির্বাচনে সেই যুক্তির যথার্থই এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে ভোটার বঞ্চনার নির্বাচন হিসেবেই দেখেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। দশম সংসদ গঠনের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নবগঠিত সরকারের প্রথম কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে দ্রুত নতুন নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছিলেন বিদেশী দূতরা। জুনের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন দেখতে চান বলেছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। অন্যরাও নতুন নির্বাচন ও রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে দ্রুত সংলাপের উদ্যোগ নিতে প্রতিমন্ত্রীকে চেপে ধরেছিলেন। আন্তর্জাতিক পর্যবেকদের বয়কটের মধ্যে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের পরদিন থেকেই নতুন নির্বাচনের বৈদেশিক তাগিদ আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দফায় দুই শতাধিক উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল ওই তাগিদকে আরো জোরালো করেছে। সাধারণত স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে অভ্যন্তরীণ ঘটনা হিসেবেই শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা দুনিয়াতে দেখা হয়। কারণ, সরকার গঠন কিংবা পরিবর্তনে এ নির্বাচনের কোনো ভূমিকা নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশে উপজেলা পরিষদগুলোকে নামকাওয়াস্তে খাড়া রেখে স্থানীয় এমপিকে সব বিষয়ে উপজেলার জমিদারি দিয়ে দেয়া হয়েছে। তার হুকুমেই স্থানীয় সেবা স্কুল-কলেজ চলে। আর বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগীদের চোখে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার গুরুত্ব শুধু তৃণমূলপর্যায়ে সরকারি সেবা নিশ্চিত করার ভূমিকা সংক্রান্ত। কিন্তু সেই উপজেলা নির্বাচনই চলমান ও বাস্তবতায় রাজনৈতিক গুরুত্ব লাভ করেছে।
ইতঃপূর্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করার দাবিতে বিরোধী জোট যখন আন্দোলনে ব্যস্ত, তখন মহাজোট সরকার তাদের মনোযোগ ফিরাতে স্থানীয় নির্বাচনে শ শ-ব্যস্ত করতে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন আয়োজনের কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু চার সিটিতেই জয় পেয়ে যায় বিরোধীরা। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থীর জয় বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হয়। একটা পরীতি ও আস্থাভাজন নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য যে বিরোধীদলীয় দাবি, তার জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হিসেবে দেখা হয় ওই পাঁচ নগর করপোরেশন নির্বাচনকে। ফলে বিরোধী দলের দাবি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পায়। একটি গ্রহণযোগ্য সরকারব্যবস্থার অধীনে সবাইকে নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য খোদ জাতিসঙ্ঘ দূত পাঠায়। কিন্তু সেসব আমলে না নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশন একতরফা নির্বাচনের যে আয়োজন করে বিরোধী প্রধান জোট শুধু নয়, বাম-ডান সব দলই তা বর্জন করে। মামলায় এরশাদকে জেলের ভয় দেখিয়ে একরকম জোর করে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল সাজিয়ে পাতানো নির্বাচন করে আবার সরকারেই তার স্থান দেয়া হয়েছে। ১৫৩ আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। বাকি আসনে ভোটার আসেনি। নির্বাচন বয়কটের মিছিল ঠেকাতে সরকারের গু ার হাতে কিংবা পুলিশের লাঠি-গুলিতে ২৪ জনের অপমৃত্যু ঘটেছে। ওই বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিদেশী পর্যবেক না এলেও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অনেক বিদেশী পর্যবেক ও সাংবাদিক এসেছেন।
দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনে প্রায় অর্ধশত উপজেলা চেয়ারম্যান ফের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেছেন। উপজেলা পরিষদের দায়িত্বে থেকেই তারা এ নির্বাচনে অংশ নেন। এদের মধ্যে ৩৪ জন আওয়ামী লীগ, পাঁচজন বিএনপি সমর্থিত, বাকিরা অন্যান্য দলের। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ২৮ উপজেলা চেয়ারম্যানকে হারিয়ে দখল নিয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের তিনটিতে জয় পেয়েছে জামায়াত। একটিতে জাতীয় পার্টি। বিএনপির দখলে থাকা তিন উপজেলায় জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা।
বিগত পাঁচ বছর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে থাকাবস্থায় অনেকেই দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও বিতর্কিত কর্মকাে  জড়িয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আবার অনেকে দলীয় কোন্দলের বলি হয়েছেন। চেয়ারম্যানদের বেশ কয়েকজন দলীয় সমর্থন নিয়ে ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনে জয়ী হলেও এবার দলীয় সমর্থন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৭ জন চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৫ জন আওয়ামী লীগ, সাতজন বিএনপি ও তিনজন জামায়াত সমর্থিত। প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে ৪৩ উপজেলায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন। পাঁচ উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন। দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনে ১১২টি উপজেলার মধ্যে ৪৪টিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। দুইজন বিদ্রোহীসহ আওয়ামী লীগের জয়ী হয়েছেন ৪৬ জন। অপর দিকে চেয়ারম্যান পদে বিএনপি সমর্থিত ৫০ জন প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। একজন বিদ্রোহী প্রার্থী জয় পেয়েছেন। বিদ্রোহী মিলিয়ে বিএনপির জয়ী চেয়ারম্যানের সংখ্যা ৫১ জন। ৫১ উপজেলা বাদে বাকি উপজেলাগুলোর মধ্যে ৩২টিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। তবে বেশ কয়েকটি উপজেলায় নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেননি বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। পাঁচ উপজেলায় জয়ী প্রার্থীর পরই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীর অবস্থান।
সহিংসতার কারণে কয়েকটি উপজেলার ফল স্থগিত রয়েছে। প্রথম দফার ৯৭ ও দ্বিতীয় দফার ১১২ মোট ২০৯ উপজেলার ফলাফল একত্র করে দেখা যায়, বিদ্রোহী প্রার্থীসহ বিএনপি ৯৫ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থীসহ আওয়ামী লীগ ৮০ উপজেলায় জয় পেয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ২০ উপজেলায় ও জাতীয় পার্টি দুই উপজেলায় জয় পেয়েছে।
অন্তত ৪৪ জন বর্তমান চেয়ারম্যান যথেষ্ট ভোট পেয়েও হেরেছেন। এদের মধ্যে ৩৪ জন আওয়ামী লীগ (বিদ্রোহীসহ) ও পাঁচজন বিএনপি সমর্থিত। হেরে যাওয়ায় প্রার্থীরা ২০০৯ সালে দলীয় সমর্থন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় পান। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তাদের জনপ্রিয়তা এত কমে গেছে যে, তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও আসতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৭ জন চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৫ জন আওয়ামী লীগ, সাতজন বিএনপি ও তিনজন জামায়াত সমর্থিত। ১৮ উপজেলায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা দ্বিতীয় অবস্থানেও যেতে পারেননি, অর্থাৎ ভোটের হিসাবে তারা নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেতে ব্যর্থ হয়েছেন।
১৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনের পর সারা দেশেই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে পড়ে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভেঙে পড়া মনোবল ফিরিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহল। উপজেলা নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনগুলোকে আরো সিরিয়াসলিনেয়ার নির্দেশ দেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা যেকোনোভাবেই হোক দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে উঠেপড়ে লাগেন। ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফায় উপজেলা নির্বাচনে সারা দেশে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে হামলা, জালভোট, ব্যালট বাক্স ছিনতাইসহ নানা উপায়ে দলীয় প্রার্থীর বিজয় ছিনিয়ে আনার চেষ্টা করেন আওয়ামী লীগ কর্মীরা। আর বাধ্য প্রশাসন পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটকে লাগিয়ে দেয়া হয় মামলা হামলা যৌথ অভিযানে বিরোধী নেতাকর্মী ভোটার হয়রানি লোপাট করে হুমকি দিয়ে বা দূরের আদালতে হাজিরার তারিখ দিয়ে ভোটের দিন সরকারপরে জন্য মাঠ সাফ করতে।
ভোটডাকাতির এসব কলাকৌশল দিয়ে এ যাবত পুরো ফল পায়নি মতাসীন গোষ্ঠী, তবে অনেক উপজেলাতেই পার পেয়ে গেছে। টুঁ শব্দটি করেনি নির্বাচন কমিশন। বিশ্বায়নবাদীদের রব নেপথ্যে মতাসীনদের কর্ণকুহরে আদৌ প্রবেশ করছে কি না কে জানে। প্রকাশ্যে মতাসীনেরা বলে চলেছে, এখন আরেকটা নির্বাচন নয়, অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বলেই পাঁচ বছর পুরো মেয়াদে তারা মতায় থাকবে। তা ছাড়া আরো নগ্ন ভোটডাকাতির কলাকৌশলের পাশাপাশি দমননীতির আরো কঠোর প্রয়োগ করে তারা বাকি উপজেলাগুলোতে বিজয় নিশ্চিত করবে। উপজেলায় জিত না হলেই বা কী আসে যায়? উপজেলা পরিষদের বরাদ্দের জন্য মতাসীনদেরই পিছু নেবে, যারা উপজেলায় নির্বাচিত হবে তারা। বিরোধী জোটের সান্ত্বনা হবে, বিশ্বায়নবাদীদের কাছে ধরনা দিয়ে বলা যে, উপজেলা নির্বাচনে সরকার আর নির্বাচন কমিশনের ঘোর পপাতমূলক আচরণ ও ভোট কারচুপি আবারো প্রমাণ করল মতাসীন সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাতেও বা কী আসে যায়? হাসিনার মিত্র ভারতশক্তিকে ঘাঁটাবে না বিশ্বায়নবাদীরা। তা না হলে থাইল্যান্ডে যেমন সরকারি ভবন দখল করা জঙ্গি সরকারবিরোধী আন্দোলনের সহিংস অবস্থানকে গণতন্ত্রের নামে বাহবা দিয়েছে, ইউক্রেনে যেমন সহিংস মোকাবেলার মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে নাজেহাল করে বিরোধী শক্তির আন্দোলন ও মতা দখলকে জোরগলায় সমর্থন দিয়ে চলেছে, সেখানে খালেদা জিয়ার নির্বাচনপূর্ব ঢাকা-চলো গণতন্ত্র-মার্চ সরকার নিজেই যে সারা দেশ রাষ্ট্রশক্তির অবরোধ দিয়ে প  করেছিল, সেটা ভূরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশূন্য ছিল কেন

সাদেক খান


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads