বুধবার, ১৯ মার্চ, ২০১৪

প্রহসনের রাজনীতি মানুষ অনেক দেখেছে-


‘রাত গড়ালেই লাশ’- পত্রিকার এমন শিরোনাম থেকে সহজেই উপলব্ধি করা যায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় বিভিন্ন কারণেই মানুষের রাতে ঘরে ফেরা হয় না। কাজকর্মে অনেকেই আটকে যান বাইরে। স্বজনরা ভাবেন, মানুষটি পরদিন ফিরে আসবেন। কিন্তু রাতে না- ফেরা মানুষটি পরদিন ঘরে ফিরছেন লাশ হয়ে। রাত গড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে সেই লাশ উদ্ধারের খবর। উল্লেখ্য যে, দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপরহণ ও গুমের ঘটনা বেড়ে চলেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবে গত ২ মাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে অপহরণ করা হয়েছে। এরপর তাদের কারও লাশ মিলেছে নদীতে, কারও লাশ খালে-বিলে, কারোরটা আবার ডোবা-নালায়। কারও লাশ মেলেনি। তাদের কী ঘটেছে জানতে পারছেন না স্বজনরা। আমাদের সময়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়: গত সোমবার চট্টগ্রাম, নোয়াখালীর চাটখিল ও হাতিয়া, খুলনার ফুলতলা, বাগেরহাটের ফকিরহাট, কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া ও ঝিনাইদহ জেলায় নিখোঁজ ১০ ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ ও হাতে-পায়ের রগকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতদের মধ্যে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ নেতা, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও পোশাককর্মী রয়েছেন। চট্টগ্রামে রাতে নিখোঁজ ছাত্রলীগ কর্মীসহ দুই বন্ধুর লাশ উদ্ধার করা হয় সেপটিক ট্যাংক থেকে। চাটখিলে পুকুরে ও খালে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায় ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ নেতার গুলিবিদ্ধ লাশ। ফুলতলায় শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় নিখোঁজ স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জেই গত এক বছরে অপহরণ বাণিজ্যের শিকার হয়ে খুন হয় ১৪ স্কুল ছাত্র। এর মধ্যে বিশেষভাবে আলোচিত হয় মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী ও ইমন হত্যার ঘটনা।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এইসব হত্যাকা-ের শিকার শুধু রাজনৈতিক নেতা-কর্র্মীরাই হননি, পেশাজীবী এমনকি কোমলমতি স্কুলছাত্ররাও হয়েছে হত্যাকা-ের শিকার। সমাজের মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হলে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কতটা অবনতি ঘটলে একটি সমাজে এইসব হত্যাকা- ঘটতে পারে তা সমজেই অনুমেয়। মানুষ তো নিহত হওয়ার জন্য কিংবা হত্যাকা- ঘটাবার জন্য সমাজবদ্ধ হয়নি। মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে পরস্পরের সহযোগিতায় উন্নত ও মানবিক জীবন যাপনের জন্য। এই লক্ষ্যকে চূড়ান্ত পরিণতি দেয়ার জন্যই মানুষ রাষ্ট্র গঠন করেছে, নির্বাচিত করেছে সরকার। রাষ্ট্র ও সরকার যখন জনগণের আকাক্সক্ষার আলোকে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় এবং ক্ষমতার দম্ভে কর্তৃত্বের ছড়ি ঘোরায়, তখন সমাজে দেখা দেয় ক্ষোভ-বিক্ষোভ। এ অবস্থায় সরকার যদি আত্মসমালোচনার মাধ্যমে সংশোধনের পথে এগিয়ে যায় তখন সমাজে আবার ফিরে আসে শান্তি ও সমৃদ্ধি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এমন সুমতি ক্ষমতাসীনদের মধ্যে খুব কমই লক্ষ্য করা যায়। বরং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা গ্রহণ করে দমন-অবদমন ও নিপীড়নের নীতি। এমন অবস্থায় দেশে সুশাসন থাকে না। পুলিশ ও প্রশাসনকে বিক্ষোভ ও প্রতিপক্ষকে দমনে ব্যস্ত রাখায় দেশে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে এবং লুটপাট, সন্ত্রাস, হত্যা ও অপহরণের মাত্রা যায় বেড়ে। এমন বাতাবরণে জনগণ তাদের পছন্দের সরকার কিংবা জন প্রতিনিধি নির্বাচনেও হয় বাধাগ্রস্ত। এমন এক অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী পরিবেশেই এখন আমাদের বসবাস।
গত শনিবার তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত হলো উপজেলা নির্বাচন। এই নির্বাচনে সহিংসতা ও ভোট জালিয়াতি লক্ষ্য করার মতো। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত শনিবার ৮১টি উপজেলায় ভোটগ্রহণকালে সহিংসতায় বাগেরহাট সদর ও শরীয়তপুরের নড়িয়ায় দু’জন নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় ব্যালট ছিনতাই ও সংঘর্ষে আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। এছাড়া নেত্রকোনার মদন উপজেলায় ২৩ মার্চ হবে ভোটগ্রহণ। শনিবার সেখানে নির্বাচনী সহিংসতায় একজন মারা যান। নির্বাচনে ভোট কারচুপি ছাড়াও কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, এজেন্টদের বের করে দেয়া, জোর করে সিল মারার ঘটনাগুলো সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকীবউদ্দিন আহমদের বিদেশ সফর নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচটি ইমামের বক্তব্য লক্ষ্য করার মতো। তিনি বলেছেন, সিইসি অনেকদিন ধরেই ছুটি চাচ্ছিলেন, এতগুলো নির্বাচন করে তিনি ক্লান্ত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নির্বাচন, পরিচালনা করাই যার দায়িত্ব, নির্বাচন নিয়ে তিনি ক্লান্ত হন কেমন করে? প্রধান ব্যক্তিই যদি ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তাহলে অন্যদের কাছ থেকে সঠিক দায়িত্ব পালন আশা করা যায়  কি? এমন অবস্থায় সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার কি প্রশ্নবিদ্ধ হবে না? এ ব্যাপারে তাদের জবাব জাতি জানতে চায়।
উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে এসে যে চিত্র লক্ষ্য করা গেল তাতে উপলব্ধি করা যায়, সরকারি ঘরানার লোকজন এবার যে কোনো মূল্যে বেশি আসনে জিততে চেয়েছেন। গত দুই ধাপে উপজেলা নির্বাচনে জনগণের রায়ের প্রতি তারা হয়তো শ্রদ্ধা দেখাতে পারেননি। তাই তারা চেয়েছেন জোর-জবরদস্তি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে জনগণের ভোটের শক্তির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে। এ কারণেই এবার ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই ও বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দেয়ার ক্ষেত্রে চরম বর্বরতা দেখানো হয়েছে। তৃতীয় ধাপে উপজেলা নির্বাচনে আরেক মারাত্মক বিষয় হলো, জাতীয় পত্রিকা ও টেলিভিশন সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা। সাংবাদিকরা যাতে ভোট কারচুপি ও সন্ত্রাসের ঘটনা তুলে ধরতে না পারেন, সে জন্য এবার সরকারি ঘরানার লোকজন খুবই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়: আর এক মিনিট কেন্দ্রে থাকলেই তোদের লাশ পড়বে, সাংবাদিক মারলে কি হয়? এই মুহূর্তে কুমিল্লা ছাড়বি। তা নাহলে তোদের সবগুলোকে পুলিশে দেব। ঢাকা থেকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাচন কভার করতে আসা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশনের সাংবাদিকদের এভাবে হুমকি দেয় রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের পিএ মোশাররফ হোসেন। পাশাপাশি সকাল থেকেই এই উপজেলার ১০৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭৩টি কেন্দ্র মন্ত্রীর লোকজন দখলে নেয় বলে মানবজমিন-এর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। মন্ত্রীর নিজ কেন্দ্র শ্রীপুরের নাটচরে ১৯ দল সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট সোহেলকে লাথি দিয়ে বের করে দেয় মন্ত্রীর লোকজন। এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনাকে ভোট-ডাকাতির উৎসব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ১৯ দলীয় জোটের নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ।
তৃতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে কাগজ-কলমের হিসাবে আওয়ামী লীগ হয়তো কিছু আসন বেশি পেয়েছে। কিন্তু এই ক’টা আসন বেশি পেতে গিয়ে তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের যে হাল করেছেন, তাতে তাদের কোনো লাভ হয়েছে কি? সন্ত্রাস ও চাতুর্যের বিজয় আসলে কোনো বিজয়ই নয়। এমন বিজয়ে জনগণের আস্থা নষ্ট হয় এবং ক্ষোভের মাত্রাও বাড়ে। পত্রিকায় যখন শিরোনাম হয়, ‘গায়েবি ভোটে বাক্স বোঝাই’, কিংবা লেখা হয়, ‘কোথাও আবার ভোট বোঝাই বাক্স নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের ভোঁ-দৌড়’ তখন নির্বাচনের প্রকৃতি বুঝতে কারোই কষ্ট হয় না। এমন নির্বাচনের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছে সরকারি দল। এই নির্বাচনের মাধ্যমে ১৯ দলীয় জোটের বক্তব্যকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এই সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না বলেই ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোট। তৃতীয় ধাপে উপজেলা নির্বাচনে জালিয়াতি ও সহিংস আচরণের মাধ্যমে বিরোধী জোটের সিদ্ধান্তটা যেন যথার্থ বলে প্রমাণ করে দিলো সরকারি দলের নেতাকর্মীরা। তাই বলা চলে, এই নির্বাচনে প্রকৃত হার হয়েছে সরকারি দলের। এমন পরাজয় থেকে তারা কোনো শিক্ষা নেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
রাত গড়ালেই আমরা আর লাশ দেখতে চাই না। আমরা চাই সুশাসন ও উন্নত নৈতিক চেতনায় গড়ে ওঠা এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এমন বাংলাদেশের লক্ষ্যেই মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে।
আমরা স্বাধীন মানচিত্র ও পতাকা পেয়েছি। কিন্তু এখনও পাইনি স্বপ্নের সেই আলোকিত বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশে যে অপশাসন ও অগণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি চলছে, তা স্বাধীনতার স্বপ্নের সাথে যায় না। বাংলাদেশের মানুষ তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে এ বিষয়টি বেশ স্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করেছে যে, স্বাধীনতার নামে বাগাড়ম্বরে স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জিত হয় না। জনগণকে উন্নত জীবন উপহার দিতে হলে যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, সহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন, এ ব্যাপারে সরকার ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বোধোদয় খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। মূল বিষয়ে কোনো উপলব্ধি না ঘটলে শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের অর্থহীন রাজনীতিতে জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। চাতুর্য ও প্রহসনের রাজনীতি এদেশের মানুষ অনেক দেখেছে, আর দেখতে প্রস্তুত নয়। সময়ের এ বার্তা কারা অনুধাবন করতে সক্ষমÑ সেটাই এখন দেখার বিষয়। সময়ের বার্তা বুঝতে ব্যর্থ হলে কোনো মতবাদ কিংবা ব্যক্তিপূজা কোনো কাজে আসবে না। এটাই ইতিহাসের সত্য।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads