শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০১৪

বেগম জিয়া, দেশ ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ


আধুুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মতার পালাবদলের একমাত্র উপায় জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ। প্রত্য ভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিরাই জনগণের হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন। তারা জনগণের আশা-আকাক্সা বাস্তবায়নের পাশাপাশি গণতন্ত্রের উন্নয়ন, বিকাশ ও স্থায়িত্বের জন্য কাজ করে থাকেন। সংসদ, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, স্বাধীন গণমাধ্যম ও বিরোধী দল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকার পরিচালনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। ২০০৮ সালে বিপুল সংখ্যাধিক্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট মতায় আসীন হয়। বিগত পাঁচ বছরের শাসনামলে দেশের প্রায় প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তবিত হয়েছে। সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণে কিছু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দোরগোড়ায় উপনীত।
গণতন্ত্র চর্চার েেত্র কার্যকর সংসদের কোনো বিকল্প নেই। জনগণের আশা-আকাক্সার প্রতিফলন ঘটে সংসদে। কিন্তু বিগত শাসনামলে সংসদকে কার্যকর করার উল্লেখযোগ্য পদপে ল করা যায়নি। বরং সরকারের বিভিন্ন পদপে ছিল সংসদকে অকার্যকর করার সহায়ক। নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের বসার স্থান পুনর্বিন্যাস করা হয়। তাদের হেয় করার জন্যই এ পদপে নেয়া হলেছিল। বিরোধী দলের প থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ করা হলেও সরকার কর্ণপাত করেনি। বিরোধী দলবিহীন একতরফা সংসদ চললেও বিরোধী দলকে সংসদমুখী করার কার্যকর পদপে জনগণ প্রত্য করেনি। বরং সংসদে দীর্ঘ অনুপস্থিতির সুযোগে জনগণের কাছে বিরোধী দলকে হেয় করার জন্য অপপ্রচার চালানো হয়, যা দেশের জনগণের কাম্য ছিল না।
সরকারের কর্মকাণ্ডের গঠনমূলক সমালোচনা করা বিরোধী দলের নৈতিক দায়িত্ব। সরকার বিরোধী দলের দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগের মতো কঠোর কর্মসূচি পালিত হয়। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন গণতান্ত্রিক অধিকার। মহাজোট সরকার বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। এভাবে বিরোধী মতকে দমন করার চেষ্টা করা হয়। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের ওপর পুলিশের হামলা ছিল ন্যক্কারজনক। বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুককে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয়। তাকে নির্যাতনকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে সরকার প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালায়।
সংসদকে অকার্যকর করার পাশাপাশি সরকার বিরোধী দল ও মত দমনে ছিল ব্যস্ত, যা গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে। জনপ্রিয় নেতা গুম, হত্যা হওয়ার পাশাপাশি বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা দেয়া হয়। এই অশুভ তৎপরতা থেকে বিরোধী দলের প্রথমসারির নেতারাও রেহাই পাননি। এমনকি প্রধান বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবও নন। বিরোধী দলের প্রধান কার্যালয়ও বন্ধ করে দেয়া হয়। নাটক সাজিয়ে বিরোধী দলের কার্যালয়কে বোমা তৈরির কারখানা বানানোর অপচেষ্টা চালানো হয়। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে যানবাহন বন্ধ করে বাধার সৃষ্টি করা হয়, যা গণতন্ত্রের বিকাশে বাধার শামিল।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাহী বিভাগের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এই বিভাগও সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ থেকে রা পায়নি। মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে শত শত কর্মকর্তাকে বরখাস্ত কিংবা ওএসডি করা হয়েছে। দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি দিয়ে নির্বাহী বিভাগকে মূলত অদক্ষ করে তোলা হয়। যোগ্যতার চেয়ে দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পাওয়ায় প্রশাসন জনমুখী না হয়ে একটি দলের মুখাপেী হয়ে পড়ে। প্রশাসন দেশ ও জাতির উন্নয়নে সহায়ক হয় না। বরং এজাতীয় প্রশাসন গণতন্ত্র বিকাশের অন্তরায়। সরকারের অযাচিত হস্তেেপ স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ব্যাপারেও জনগণ সন্দিহান। মুন সিনেমা হল মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রহিতকরণের রায়কে জনগণ রাজনৈতিক বিবেচনার রায় হিসেবেই মনে করে। বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিক এম কে আনোয়ারের রিমান্ড মঞ্জুর জনগণকে মর্মাহত করেছে। দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে হামলা এবং আক্রমণকারীরা গ্রেফতার কিংবা বিচারের আওতায় না আসা দেশের ভবিষ্যতের জন্য অশনি সঙ্কেত।
সরকারের ভুলক্রটি তুলে ধরে সঠিক পথে চালানোর েেত্র স্বাধীন গণমাধ্যমের ভূমিকা বিরাট। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গণমাধ্যমের অবদান ব্যাপক। আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরের শাসনামলে গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য এ মাধ্যমটিও সঠিকভাবে চলতে পারেনি। সরকারের হস্তেেপ আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করা হয়। সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দুই শতাধিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। সাগর-রুনির মতো ২০ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার। তদুপরি প্রেস কাবে সাংবাদিকদের ওপর সশস্ত্র হামলা সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ। সার্থকদের ৫ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের শেষ লেবাসটুকুও যেন খুলে ফেলতে চেয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণ সব মতার উৎস। জনগণের বাইরে মতার উৎস খুঁজলে গণতন্ত্রের বিকাশ ও স্থায়িত্বের পথে তা চরম অন্তরায় হবে।
বিরোধী দল বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে সরকারকে সঠিক পথে চলার তাগিদ দেয়। মূলত বিরোধী দল সরকারের কর্মকাণ্ডের জবাব রাজপথে না দিয়ে ভোটের মাঠে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার দেশব্যাপী লংমার্চ, চারদলীয় জোট বর্ধিতকরণ সেসবেরই বহিঃপ্রকাশ। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদের পথ বন্ধ করা হলে বিরোধী দল কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়। নির্দলীয় নিরপে ব্যক্তির অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে বাধ্য করতে হরতাল অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিতে হয়েছে। বিরোধী দলের দাবির প্রতি সরকার কর্ণপাত না করেই একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল। সরকারকে বাধ্য করার জন্য বিরোধী দল আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না।
বিরোধী দল দীর্ঘ দিন ধরে একজন নির্দলীয় নিরপে ব্যক্তির অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি করে আসছে। দাবিটি ছিল জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। বিরোধী দলের এ যৌক্তিক দাবির প্রতি জনগণ সমর্থন দিয়েছে। সরকার গণদাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণে এর প্রতিফলন ছিল না। সেজন্যই বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া একতরফা ভোট প্রতিহত করতে সিলেটের জনসভা থেকে জোটের নেতাকর্মীদের ভোটকেন্দ্রভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে দেশের প্রত্যেক জেলায় কেন্দ্রভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এতে সরকার দেশব্যাপী নির্বাচন করতে ভয় পায়। ১৫৩টি আসনে নির্বাচন না করে তারা নির্বাচনী মাঠকে ছোট করে আনে। সরকারের বিশ্বাস জন্মে, স্বল্প পরিসর ভোটের মাঠে যথেষ্টভোটার সমাগম এবং ৫০ শতাংশ ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করে দেশ-বিদেশে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করা যাবে। কিন্তু ১৯ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা দৃঢ় হওয়ায় আওয়ামী লীগের পে জনগণ ভোট দেয়নি। ৬৩টি কেন্দ্রে একটিও ভোট না পড়া তার প্রতি জনগণের আস্থার এবং সরকারের প্রতি অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা বিরোধী জোট ভাঙা এবং বিরোধী দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকে ভোটে অংশগ্রহণ করানোর পদপে নিয়েছিল। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতার বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে তা সফল হয়নি। বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান জনগণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানালে জনগণ এতে সাড়া দেয়। বিরোধী দলের ভোট বর্জন কর্মসূচি প্রতিহতকরণ থেকে ১৯ দলীয় জোটের নীতিনির্ধারকদের তিনটি বিষয় বাস্তবায়নের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। (ক) জোটের বন্ধন অটুট রাখা; (খ) প্রহসনের নির্বাচনে যেতে নেতাকর্মীদের নিরুৎসাহী করা; (গ) একতরফা নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে বিতর্কিত করা। সেদিক থেকে বিরোধী দল শতভাগ সফল, তা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। বিরোধী দলের নীতিনির্ধারক এবং নেতাকর্মী, সমর্থক ও জনগণের চাওয়া পাওয়ার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য ল করা যায়। নেতাকর্মী, সমর্থক ও জনগণের চাওয়া ছিল আওয়ামী লীগের পতন। সে উদ্দেশ্যেই আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছিল। বলে তাদের ধারণা এটা পতন না হওয়ায় জনগণের এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা হলেও হতাশা বিরাজ করা স্বাভাবিক। ১৯ দলের শতভাগ সফলতার বিষয়াদি তুলে ধরে নেতাকর্মীদের হতাশা দূর করার এখনই সময়। প্রথম দফা আন্দোলনের বিজয়ই বিরোধী দলের দ্বিতীয় দফা বিজয়কে ত্বরান্বিত করবে। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ স্বস্তিতে আছে এমনটি মনে করার কারণ নেই। নৈতিকভাবে মতা যে, দীর্ঘায়িত করা যাবে না তা তারা ভালোভাবেই জানে।
আওয়ামী লীগের মতো একটি দলকে বিরোধী দলের দাবি আদায়ে বাধ্য করতে হলে একই ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দরকার। বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সারা দেশের জনগণ যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছেন, ঢাকায় তেমনটি ল করা যায়নি। তার নেতৃত্বের প্রতি দেশের জনগণের পূর্ণ আস্থা ছিল এবং আছে। তিনি দেশ ও গণতন্ত্র রায় কোনো অশুভশক্তির সাথে আপস করবেন না, এটি জনগণ দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নেবে, এমনটা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। রাজপথের আন্দোলনই কেবল সরকারকে বিরোধী দলের দাবি আদায়ে বাধ্য করবে। সে েেত্র ঢাকায় আন্দোলন জোরদার করা এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের দাবি বাস্তবায়নের জন্য জনগণ বেগম জিয়ার দিকেই চেয়ে আছে। জনগণ দেশ ও গণতন্ত্র রায় তাকেই কাণ্ডারি হিসেবে মনে করে।

ড. মো: এমতাজ হোসেন


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads