প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাথে সর্বশেষ বৈঠক করেছেন মিয়ানমারের নেপিতোতে বিমসটেক
সম্মেলনে। এটাই দুই প্রধানমন্ত্রীর শেষ বৈঠক। আগামী এপ্রিল মাসে ভারতে জাতীয় নির্বাচন।
এই নির্বাচনে কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে। ভারতের কংগ্রেস
সরকার শেখ হাসিনার সরকারকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। শেখ
হাসিনার সরকারকে সব ধরনের সমর্থনের কথা ভারতের পক্ষ থেকে বলা হলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়
স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে খুব কমই অগ্রগতি হয়েছে। বিমসটেক সম্মেলনে শেখ হাসিনা মনমোহন
সিংয়ের সাথে বৈঠকে সঙ্গত কারণেই তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুটি তুলে ধরেছেন। এবার আর আশ্বাস
নয়, মনমোহন স্পষ্ট করে বলেছেন তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুটি অত্যন্ত
জটিল। এর সমাধানের কোনো সম্ভাবনা আর নেই। অন্তত কংগ্রেস সরকারের দুই মাসের কম সময়ের
মেয়াদে তো সম্ভব নয়। নির্বাচনের পর ভারতে ক্ষমতাসীন হতে যাচ্ছে বিজেপি, জনমত জরিপে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিজেপি না হলে দিল্লিতে আঞ্চলিক দলগুলোর
একটি কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাও প্রবল। এ ধরনের সরকার গঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গের
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির থাকবে অপরিসীম প্রভাব। তাকে বাদ দিয়ে আগামী দিনে তিস্তার
পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আবার বিজেপি এ ব্যাপারে কতখানি
আগ্রহী হবে তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। আমরা ধরেই নিতে পারি তিস্তার পানি বণ্টন অনির্দিষ্টকালের
জন্য ঝুলে গেল। এখন প্রশ্ন হলো কংগ্রেসের এই শাসনামলে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে কী
পেলো।
প্রধানমন্ত্রী
মিয়ানমার থেকে ফেরার আগেই বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার
ব্যাপারে নতুন তৎপরতার কথা জানিয়েছেন। সম্প্রতি মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ভারতের সাথে কানেকটিভিটির
মাধ্যমে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতের সাথে রেল, নৌ ও স্থল ট্রানজিট সুবিধা চালু করতে যে উন্নয়ন কাজ চলছে, তার অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। বৈঠকে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড.গওহর রিজভী ও ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের
রাষ্ট্রদূত তারেক এ করিম উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ
বলেছেন, বিশ্বায়নের যুগে আমাদের আরো উদার হতে হবে। মনের দরজা খুলে দিতে
হবে। সত্যি কথা, বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো দেশ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। বাংলাদেশও
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশেষ করে ব্যবসায়
বাণিজ্য সম্প্রসারিত করতে পারে। কিন্তু এই যোগাযোগের ভিত্তি হতে হবে বাংলাদেশের স্বার্থ।
বাংলাদেশের কাছে ভারত বিভিন্ন সময় ট্রানজিট সুবিধা চেয়ে আসছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায়
আসার পর থেকে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার ব্যাপারে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। যদিও সরাসরি ট্রানজিটের
কথা না বলে এর নাম দেয়া হয়েছে কানেকটিভিটি।
২০১১ সালের
সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে ভারতের সাথে ট্রানজিট
চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টনসংক্রান্ত
বিষয়ে জটিলতার কারণে তা বেশি দূর এগোয়নি। তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে অনেক
সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ হয়েছিল তিস্তা চুক্তির অগ্রগতি না হলে ট্রানজিট নিয়ে এগোবে না
বাংলাদেশ। যা হোক মনমোহন সিংয়ের সফরের পর এ নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখন তিস্তা
চুক্তি না হলেও বাণিজ্যমন্ত্রী ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন।
কিন্তু
এই ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে, তা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য আসছে না। এ নিয়ে
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যে পর্যালোচনা বা সমীক্ষা হয়নি তা নয়। এমনকি ট্রানজিটের
মাশুল নির্ধারণের জন্য সরকারিভাবে একটি কোর কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটি তাদের
রিপোর্ট দিয়েছে। এসব সমীক্ষা ও রিপোর্টে ট্রানজিটের রুট ও লাভক্ষতির দিক নিয়ে বিস্তারিত
আলোচনা করা হয়েছে। সরকার এখন পর্যন্ত তা প্রকাশ করেনি। কংগ্রেস সরকারের বিদায়লগ্নে
হঠাৎ করে ট্রানজিট সুবিধা চালু করার এই তোড়জোড় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। ট্রানজিট
নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে শেষ মুহূর্তে কোনো চাপ আছে কি না তা-ও ভেবে দেখার বিষয়। যাই
হোক না কেন ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার আগে এর সামগ্রিক দিক নতুন করে পর্যালোচনা
করা দরকার।
ট্রানজিট
নিয়ে সমীক্ষা
প্রতিবেশী
ভারতসহ নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা দেয়ার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা
করতে অতীতে দু’টি সমীক্ষা পরিচালিত হয়েছে। বহুল আলোচিত সমীক্ষার একটি হয়েছে এশীয়
উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আওতায়। ইউএন-এসকাপের সাবেক পরিচালক রহমতউল্লাহ ও বাংলাদেশ
উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক মুহাম্মদ ইউনুস যৌথভাবে এই গবেষণাটি পরিচালনা
করেছেন। দ্বিতীয় সমীক্ষাটি হয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) পলিসি
রিসোর্স প্রোগ্রামের (পিআরপি) আওতায় পরিচালিত ‘ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ অ্যান্ড দ্য নর্থইস্ট : ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রানশিপমেন্ট স্ট্র্যাটেজিক
কনসিডারেশন’ শীর্ষক গবেষণা। বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক কে এ এস মুরশিদ এই গবেষণাটি
করেছেন।
২০১১ সালে
মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবর রহমানকে
প্রধান করে ট্রানজিট-সংক্রান্ত কোর কমিটি গঠন করা হয়। ট্রানজিট দেয়ার ক্ষেত্রে এই কমিটিও
বেশ কিছু সুপারিশ করে। ট্রানজিট নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে সমীক্ষাগুলোর ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত
করা দরকার।
রহমত উল্লাহর
সমীক্ষা
এডিবির
আওতায় ২০১০ সালে রহমত উল্লাহ ও ইউনুস যে সমীক্ষা চালিয়েছিলেন আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার
বা এডিবি তা প্রকাশ করেনি। তবে রহমত উল্লাহর সাক্ষাৎকারসহ বিভিন্নভাবে এই সমীক্ষার
বেশ কিছু বিষয় প্রকাশ হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ভারতের অন্য অংশ ও উত্তর-পূর্ব
রাজ্যগুলোর মধ্যে বছরে তিন কোটি ৮৫ লাখ টন পণ্যবাহী যান চলাচল করে। এর মধ্যে শুধু আসামের
সাথেই চলাচল হয় তিন কোটি ৪৩ লাখ টন। ট্রানজিট চালু হলে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এক কোটি
৫৬ লাখ টন পণ্য যাতায়াত হবে, যার মধ্যে আবার এক কোটি ২০ লাখ টনই হবে আসাম থেকে।
এ ছাড়া নেপাল ও ভুটানসহ আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন হবে সাড়ে ১৭ লাখ টন। তবে শুধু আসাম
থেকেই প্রায় সাড়ে চার লাখ টন পণ্য চলাচল হবে। অর্থাৎ এই উপ-অঞ্চলে বর্তমানে চার কোটি
১৮ লাখ টন পণ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ ট্রানজিট বাণিজ্যে স্থানান্তরিত হবে।
এই সমীক্ষায়
ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার জন্য অবকাঠামো নির্মাণে বিপুল বিনিয়োগের কথা বলা হয়।
সড়কপথের জন্য পাঁচ কোটি ৩৭ লাখ ডলার, রেলের জন্য ৭৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার, চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য সাত কোটি ৯০ লাখ ডলার ও মংলা বন্দরের জন্য ১২ কোটি
৯০ ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। ফলে বাংলাদেশের মূলধনী বিনিয়োগ দাঁড়াবে ১০৭ কোটি ডলার বা
প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। এর সাথে ৩০ বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রায় এক
কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে।
এই সমীক্ষায়
বলা হয় ট্রানজিট পাওয়ায় বিদ্যমান পণ্য পরিবহন খরচ যতখানি হ্রাস পাবে, তার সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ ট্রানজিট মাশুল হিসেবে বাংলাদেশকে আদায় করতে হবে। এর
সাথে যুক্ত হবে বন্দর ব্যবহারের মাশুল, বাহন মাশুল ইত্যাদি। তবে অবকাঠামো
উন্নয়ন ঘটিয়ে ষষ্ঠ বছর থেকে পুরোদমে ট্রানজিট সুবিধা ব্যবহার করা যাবে। আর তাই প্রথম
পাঁচ বছরে বাংলাদেশের বার্ষিক আয় হবে পাঁচ কোটি ডলার। এরপর পূর্ণ অবকাঠামোয় এই বার্ষিক
আয় ৫০ কোটি ডলার হবে। আর ২৭তম বছর থেকে বার্ষিক আয় ১০০ কোটি ডলার হবে। রহমত উল্লাহর
এই সমীক্ষা নিয়ে দেশের ভেতরে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। কারণ এই অবকাঠামো খাতে বিপুল ব্যয়ের
পর প্রকৃত অর্র্থে এই পরিমাণ পণ্য চলাচল হবে কি না সে প্রশ্ন রয়েছে। রহমত উল্লাহর এই
সমীক্ষাকে অতি আশাবাদী হিসেবে মনে করা হয়।
কে এস
মুরশিদের সমীক্ষা
বিআইডিএসের
গবেষক কে এস মুরশিদের সমীক্ষায় বলা হয় সড়ক ও রেলপথ মিলিয়ে ভারতের প্রধান অংশের সাথে
উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর বছরে সাড়ে পাঁচ কোটি টন পণ্য পরিবহন হয়ে থাকে। এর মধ্যে সড়কপথে
উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সাথে বছরে তিন কোটি ৯০ লাখ টনের পণ্য আনানেয়া হয়। বাকিটা রেলপথে।
রেলপথে বছরে এই রাজ্যগুলোয় ভারতের প্রধান অংশ থেকে যে পরিমাণ পণ্য আসে (২০০৮ সালে ৬৮
লাখ ৪৭ হাজার টন) ও এখান থেকে যে পরিমাণ পণ্য যায় (২০০৮ সালে ৯০ লাখ ৮৬ হাজার টন), তার ৭৯.৭ ও ৯৭.৭ শতাংশই আনানেয়া হয় আসামের সাথে। অন্য রাজ্যগুলোতে সাধারণত
আসামে পণ্য খালাস করার পর তা স্থানান্তর করা হয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশ যদি ট্রানজিট সুবিধা
দেয় তাহলে ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মনিপুরের ক্ষেত্রে
প্রায় পুরোটাই পণ্য বাংলাদেশের ওপর দিয়ে চলাচলের সম্ভাবনা রয়েছে। মেঘালয়ের ক্ষেত্রেও
কিছুটা পণ্য বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আনা-নেয়া হবে। এভাবে বছরে সমন্বিতভাবে ৩৩ লাখ টন (১০
লাখ টন রেলে ও ২৩ লাখ টন সড়কপথে) পণ্য ট্রানজিটে পরিবহন হতে পারে, যা বর্তমানের এই বাজারের অতি ুদ্র অংশ। সুতরাং আসামকেন্দ্রিক বাণিজ্যের কতখানি
বাংলাদেশী ট্রানজিটে নিয়ে আসা যাবে, তার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে
ট্রানজিট দেয়া থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তির বিষয়টি।
এই সমীক্ষায়
বলা হয়, বাংলাদেশে রেলওয়ের মৌলিক অবকাঠামো থাকলেও একে ট্রানজিটের উপযোগী
করতে হলে মান উন্নয়ন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে গোটা রেল খাতকেই পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করার
প্রয়োজন হবে। যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলে বাধা থাকায় বিরতিহীন
যাত্রা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে যমুনার এ পার-ও পারে পণ্য ওঠানামা করা ও দুই পারের জন্য
পণ্যবাহী ফেরি চালু করতে হবে, যা কার্যত ট্রানশিপমেন্টে রূপ নেবে আবার ব্যয়বহুল
ও সময়ক্ষেপণকারী হবে। প্রাথমিকভাবে অবকাঠামো ও পরিচালনা উন্নয়নে অন্তত ১০ কোটি ডলার
বিনিয়োগ করতে হবে রেলওয়েকে যেন আখাউড়া-আগরতলা সংযোগ স্থাপন, বন্ধ থাকা কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন চালু ও টঙ্গী-শাহবাজপুর রুট ডুয়েলগেজ করা
যায় এবং ট্রানশিপমেন্ট হাব (কেন্দ্র) তৈরি করা যায়।
কলকাতা-গুয়াহাটি
রুটে রেল বা সড়কপথের বাণিজ্য ট্রানজিটের দিকে ধাবিত হবে না। কারণ, বর্তমানে এই পথে যা খরচ, বাংলাদেশ রেলওয়ে তা কমাতে পারবে না। বাংলাদেশের
মধ্য দিয়ে কলকাতা-আগরতলা রুটে বাংলাদেশ ট্রানজিট দিলে ভারতের এই দুই স্থানের মধ্যকার
বর্তমানের এক হাজার ৬৮০ কিলোমিটারের দূরত্ব নেমে আসবে মাত্র ৪৯৬ কিলোমিটারে। মধ্য মেয়াদে
বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বছরে ৪০ লাখ টন পণ্য আনানেয়ার ফলে টনপ্রতি এক হাজার টাকা ট্রানজিট
মাশুল নিলে বাংলাদেশ পাঁচ কোটি ৭০ লাখ ডলারের রাজস্ব পাবে। রেলওয়ের জন্য ভর্তুকি বাদ
দিলে প্রকৃত রাজস্ব আয় প্রায় দেড় কোটি ডলার হবে। দরকষাকষি করে মাশুল দ্বিগুণ হলেও এই
আয় তিন কোটি ডলারের বেশি হবে না।
মুরশিদ
তার সমীক্ষায় দেখিয়েছেন ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ লাভ হবে আসলে সীমিত। পরে
মুরশিদ খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন, আমাদের সড়ক অবকাঠামো দুর্বল তাই সড়কপথে ট্রানজিট
না দেয়াই ভালো। এ ক্ষেত্রে রেলপথের দিকে জোর দেয়া উচিত। রেলপথের ওপর জোর দিলেও আমরা
তা এখন দিতে পারছি না। রেল খাত অনেক দিন ধরেই অবহেলিত। এখানে বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন।
তবে ট্রানজিট নিয়ে আমরা যেন বেশি ফানুস না ওড়াই। এ বিষয়ে অচিরেই যে বেশি লাভবান হবো
তা নয়।
কোর কমিটির
প্রতিবেদন
বাংলাদেশ
ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত কোর গ্রুপ যে প্রতিবেদন প্রণয়ন করে, ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে তা সরকারের কাছে পেশ করা হয়। এরপর অবশ্য আরো কিছু সংযোজন-বিয়োজন
করে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করার জন্য বলা হয়। কিন্তু এই প্রতিবেদন শেষ পর্যন্ত কোন পর্যায়ে
রয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী কোর গ্রুপের প্রতিবেদনে
অবকাঠামো বিনির্মাণ ও উন্নয়নসাপেক্ষে বছরে এক কোটি ৭৩ লাখ টন পণ্যবাহী কার্গো পরিবহন
হবে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ট্রানশিপমেন্ট দেয়া হলে ১৮ লাখ টন কার্গো পরিবহন হবে। সাতটি
সড়ক, সাতটি রেল ও তিনটি নৌপথ দিয়ে ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট দেয়া সম্ভব।
এই পথগুলোর
মাধ্যমে ট্রানজিট সুবিধা দিতে হলে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা (৭০০ কোটি ডলার) বিনিয়োগ
করা প্রয়োজন অবকাঠামো উন্নয়ন ও পথগুলো ট্রানজিটের উপযোগী করার জন্য। পরিবহন বাবদ ১৫
ধরনের মাশুল আদায় করা যাবে।
কোর কমিটির
সুপারিশে বলা হয়, প্রক্রিয়া শুরু করার পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট
দেয়া সম্ভব নয়। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ট্রানশিপমেন্ট দেয়া যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে ট্রানশিপমেন্টের
পরিধি বাড়ানো ও অবকাঠামো উন্নয়ন করে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিটে যাওয়া সম্ভব।
মাশুল
কিভাবে নেয়া হবে
ট্রানজিট-সংক্রান্ত
কোর গ্রুপ মাশুলের জন্য ন্যূনতম একটি হার সুপারিশ করে। এ ক্ষেত্রে কোর গ্রুপের বক্তব্য
হলো, ন্যূনতম হারে মাশুল সুপারিশ করার অর্থ হলো, এই হারের চেয়ে কম মাশুল নেয়া হলে ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগের
অর্থ প্রিমিয়ামসহ তুলে আনতে পারবে না। এতে বলা হয়, টনপ্রতি প্রতি কিলোমিটারের জন্য
সড়কপথে সাত সেন্ট, রেলপথে তিন সেন্ট ও নৌপথে আড়াই সেন্টের কম অর্থ নেয়া হলে ট্রানজিট
সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ কার্যত লাভবান হবে না। অর্থাৎ এর চেয়ে বেশি হারে মাশুল আরোপ করা
প্রয়োজন। আবার ভারতের জন্য যে হারে মাশুল আরোপ হবে, নেপাল ও ভুটানের জন্য সে হারে
না-ও হতে পারে। কেননা, ভুটান ভূআবদ্ধ দেশ। নেপাল ভূআবদ্ধ তো বটেই, স্বল্পোন্নত দেশও। মাশুল নিয়ে দরকষাকষির নীতি ঠিক করা হয়েছিল কোর কমিটি। অনেকেই
মনে করেন, মাশুল নিয়ে দরকষাকষির দিকে যাওয়া ঠিক হবে না। সাধারণত ট্রানজিট
প্রদানকারী দেশ নিজস্ব বিবেচনায় একতরফা মাশুল আরোপ করে। ট্রানজিট নিতে ইচ্ছুক দেশ তাতে
সম্মত হলে ট্রানজিট শুরু হয়। আমরা লক্ষ্য করছি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে
মন্ত্রিসভার বৈঠকে ট্রানজিট রুটগুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়েছে।
তাতে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। মাশুল কী হবে তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য দেয়া হচ্ছে
না। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ট্রানজিট করিডোর নিয়ে আমাদের এক ধরনের মাইন্ডসেট
আছে এবং সময় এসেছে তা পরিত্যাগ করার। তিনি বলেন, আমরা যদি আমাদের দরজা বন্ধ করে
দিই, অন্য দরজা দিয়ে কেউ জায়গা করে নেবে। কেউ কারো জন্য বসে থাকবে না।
এর মানে এই নয় যে, বিনা স্বার্থে আমরা দরজা খুলে দেবো। এটা একান্তই স্বার্থসম্পর্কিত
বিষয়। বাণিজ্যমন্ত্রী যে মাইন্ডসেট বদলানোর কথা বলেছেন তা তখনই বদলাবে, যখন মানুষের সামনে স্পষ্ট করা হবে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ এভাবে
লাভবান
হবে। উন্নয়নের ফানুস ওড়ানোর বক্তব্য দিয়ে নয়। এ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া
দরকার।
ট্রানজিট
ও রাজনীতি
ভারতকে
ট্রানজিট সুবিধা দেয়া নিয়ে বাংলাদেশে যথেষ্ট রাজনীতি হলেও গঠনমূলক আলোচনা খুব কমই হয়েছে।
সুশীলসমাজের একটি অংশ ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ বিপুলভাবে লাভবান হবে বলে প্রচারণা চালিয়েছিল।
২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি সমুন্নয় আয়োজিত একটি প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ রেহমান
সোবহান বলেছিলেন, ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। শুধু ভারত নয় চট্টগ্রাম
বন্দর ব্যবহার করতে দিলে বাংলাদেশ, চীন, নেপাল, ভুটানসহ এ অঞ্চলের বড় ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হবে। সিঙ্গাপুর হওয়ার
এই স্বপ্ন যে কতটা অলীক তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার পক্ষে
সব সময় সরব থাকা রহমত উল্লাহ নৌপ্রটোকল সংশোধনের সময় মাশুল আরোপ না করার তীব্র সমালোচনা
করেছিলেন। তিনি ট্রানজিট-সংক্রান্ত কোর কমিটির সদস্য ছিলেন। নৌপ্রটোকল সংশোধনের পর
তিনি বলেন, নৌপ্রটোকল সংশোধনের সময় মাশুল আরোপ না করা সরকারের একটি বিরাট
ভুল। ফলে এখন বিনা পয়সায় ভারত ট্রানজিট নিচ্ছে। এতে আমাদের খারাপ লাগছে। অপর দিকে প্রধানমন্ত্রীর
উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেছিলেন, ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্টের
জন্য ভারতের কাছ থেকে আমাদের ফি নেয়া উচিত নয়। আমরা যদি অসভ্য হতাম এবং আমাদের নেতৃবৃন্দ
যদি অশিক্ষিত হতো তাহলে এ দাবি করা যেতো। কিন্তু তা তো নয়।
ট্রানজিটের
বিনিময়ে আসলে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে তা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করেছেন সরকারের মন্ত্রী
ও উপদেষ্টারা। কারণ এ পর্যন্ত ট্রানজিট-সংক্রান্ত যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে বাংলাদেশের
লাভবান হওয়ার কোনো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেননি। আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ভারতকে
এককালীন ট্রানজিট সুবিধা দেয়া হয়েছিল ভারতের পালাটানায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতি
পরিবহনের জন্য। এরপর ২০১৩ সালের মে মাসে আবারো খাদ্যশস্য নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।
এসবের বিনিময়ে কোনো মাশুল আদায় করা হয়নি। ট্রানজিটের ব্যাপারে সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থান
প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর। তিনি এর আগে বলেছিলেন, নতুন কোনো চুক্তি ছাড়াই ভারতকে ট্রানজিট দেয়া যায়। তার মতে ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা
চুক্তিতেই ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা আছে। সর্বশেষ গত বছরের ২৮ জুন ঢাকায় এসকাপ
ও বিস-এর উদ্যোগে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোয় যোগাযোগ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ-সংক্রান্ত
এক সংলাপে বলেন, ট্রানজিটের মাশুল আদায়ের বিষয়টি যাতে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার
উদ্যোগকে ভেস্তে না দেয় সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে। ট্রানজিট চালুর ব্যাপারে নানা বিতর্ক
হলেও এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার পক্ষে। তা ছাড়া দক্ষিণ
এশিয়ার সব দেশে এখন গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর গণতান্ত্রিক সরকারগুলো
যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছে। (প্রথম আলো, ২৮ জুন ২০১৩) এই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান
বলেন, ট্রানজিটের মাশুল মানে রাজস্ব আদায় নয়। ট্রানজিট সুবিধা পেতে অবকাঠামো
ব্যবহারকারী রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ভূখন্ড ব্যবহারের জন্য টাকা দেবে। এ
অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী দেশকে ভর্তুকি সুবিধা দেয়া যাবে না। আবার ব্যবহারকারীর
প্রদেয় অর্থের হার নির্ধারণে অবকাঠামো নির্মাণের খরচের সাথে নির্ধারিত মাত্রায় লাভের
হার যুক্ত করা যাবে না। এই দুই উপদেষ্টার বক্তব্যে ট্রানজিট নিয়ে আমরা সরকারের মনোভাবের
যে প্রতিফলন পাচ্ছি তা আর্থিকভাবে বাংলাদেশ কতটা লাভবান করবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার
অবকাশ আছে।
সর্বশেষ
আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, বিশ্বায়নের যুগে আমাদের আরো উদার হতে হবে। মনের দরজা খুলে দিতে হবে। খুবই সত্যি
কথা। কিন্তু প্রশ্নটা ভারতকেও করতে হবে। ভারতের কাছ থেকে কতটা উদারতা পেয়েছে বাংলাদেশ? বাংলাদেশের নদী ভরাট করে ভারতের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহনের
জন্য আমরা ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছিলাম। ত্রিপুরার পালাটানার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে
এর বিনিময়ে আমাদের ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা ছিল। সেই বিদ্যুৎ কেনো ভারত এখন
আর দিতে আগ্রহী নয়। ভারত মনের দরজা বন্ধ করল কেন? এখন আমরা আশুগঞ্জ বন্দর থেকে
আখাউড়া হয়ে রেল যোগাযোগ চালু করতে চাইছি। কিন্তু এতে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে কতটা লাভবান
হবে তার চিত্র আগে প্রকাশ করা উচিত।
একইভাবে
স্থলপথে ভারতের পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের লাভ-লোকসানের দিকটি তুলে ধরতে হবে। মনে রাখতে
হবে, ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়াকে শুধু বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ
নেই। সামগ্রিকভাবে ভারতের সাথে ঝুলে থাকা অন্য সমস্যাগুলো এর সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।
তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি সুরাহা হচ্ছে না, তা স্পষ্ট করেই বলেছেন মনমোহন
সিং। সীমান্ত চুক্তির বিষয়গুলো ঝুলে আছে। কিন্তু হঠাৎ করে সরকারের মন্ত্রীরা ট্রানজিট
ও কানেকটিভিটির জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন। ভারতের স্বার্থ পূরণের জন্য মন্ত্রীদের এসব তৎপরতা
জনগণের মধ্যে এখন হতাশার সৃষ্টি করছে।
আলফাজ আনাম
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন