গত শনিবার তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত হলো উপজেলা নির্বাচন। এই নির্বাচনে সহিংসতা ও ভোট জালিয়াতি লক্ষ্য করার মতো। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত শনিবার ৮১টি উজেলায় ভোটগ্রহণকালে সহিংসতায় বাগেরহাট সদর ও শরীয়তপুরের নড়িয়ায় দু’জন নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় ব্যালট ছিনতাই ও সংঘর্ষে আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। এছাড়া নেত্রকোনার মদন উপজেলায় ২৩ মার্চ হবে ভোটগ্রহণ। শনিবার সেখানে নির্বাচনী সহিংসতায় একজন মারা যান। নির্বাচনে ভোট কারচুপি ছাড়াও কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, এজেন্টদের বের করে দেয়া, জোর করে সিল মারার ঘটনাগুলো সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকীবউদ্দিন আহমদের বিদেশ সফর নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচটি ইমামের বক্তব্য লক্ষ্য করার মতো। তিনি বলেছেন, সিইসি অনেকদিন ধরেই ছুটি চাচ্ছিলেন, এতগুলো নির্বাচন করে তিনি ক্লান্ত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নির্বাচন পরিচালনা করাই যার দায়িত্ব, নির্বাচন নিয়ে তিনি ক্লান্ত হন কেমন করে? প্রধান ব্যক্তিই যদি ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তাহলে অন্যদের কাছ থেকে সঠিক দায়িত্ব পালন আশা করা যায় কী? এমন অবস্থায় সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার কী প্রশ্নবিদ্ধ হবে না? এ ব্যাপারে তাদের জবাব জাতি জানতে চায়।
উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে এসে যে চিত্র লক্ষ্য করা গেল, তাতে উপলব্ধি করা যায়, সরকারি ঘরানার লোকজন এবার যে কোনো মূল্যে বেশি আসনে জিততে চেয়েছেন। গত দুই ধাপে উপজেলা নির্বাচনে জনগণের রায়ের প্রতি তারা হয়তো শ্রদ্ধা দেখাতে পারেননি। তাই তারা চেয়েছেন জোর-জবরদস্তি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে জনগণের ভোটের শক্তির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে। এ কারণেই এবার ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই ও বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দেয়ার ক্ষেত্রে চরম বর্বরতা দেখানো হয়েছে। তৃতীয় ধাপে উপজেলা নির্বাচনে আরেক মারাত্মক বিষয় হলো, জাতীয় পত্রিকা ও টেলিভিশন সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা। সাংবাদিকরা যাতে ভোট কারচুপি ও সন্ত্রাসের ঘটনা তুলে ধরতে না পারে, সেজন্য এবার সরকারি ঘরানার লোকজন খুবই বেপরোয়া হয়ে উঠে। সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বলা হয়, আর এক মিনিট কেন্দ্রে থাকলেই তোদের লাশ পড়বে, সাংবাদিক মারলে কী হয়? এই মুহূর্তে কুমিল্লা ছাড়বি। তা না হলে তোদের সবাইকে পুলিশে দেবো। ঢাকা থেকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাচন কাভার করতে আসা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশনের সাংবাদিকদের এভাবে হুমকি দেয় রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের পিএ মোশাররফ হোসেন। পাশাপাশি সকাল থেকেই এই উপজেলার ১০৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭৩টি কেন্দ্র মন্ত্রীর লোকজন দখলে নেয় বলে মানবজমিন-এর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। মন্ত্রীর নিজ কেন্দ্র শ্রীপুরের নাটচরে ১৯ দল সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট সোহেলকে লাথি দিয়ে বের করে দেয় মন্ত্রীর লোকজন। এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনাকে ভোট ডাকাতির উৎসব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ১৯ দলীয় জোটের নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ।
তৃতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে কাগজ-কলমের হিসাবে আওয়ামী লীগ হয়তো কিছু আসন বেশি পেয়েছে। কিন্তু এই ক’টা আসন বেশি পেতে গিয়ে তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের যে হাল করেছেন, তাতে তাদের কোনো লাভ হয়েছে কী? সন্ত্রাস ও চাতুর্যের বিজয় আসলে কোনো বিজয় নয়। এমন বিজয়ে জনগণের আস্থা নষ্ট হয় এবং ক্ষোভের মাত্রাও বাড়ে। পত্রিকায় যখন শিরোনাম হয়, ‘গায়েবি ভোটে বাক্স বোঝাই’, কিংবা লেখা হয়, ‘কোথাও আবার ভোট বোঝাই বাক্স নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের ভোঁ-দৌড়’, তখন নির্বাচনের প্রকৃতি বুঝতে কারোরই কষ্ট হয় না। এমন নির্বাচনের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছে সরকারি দল। এই নির্বাচনের মাধ্যমে ১৯ দলীয় জোটের বক্তব্যকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এই সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না বলেই ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোট। তৃতীয় ধাপে উপজেলা নির্বাচনে জালিয়াতি ও সহিংস আচরণের মাধ্যমে বিরোধী জোটের সিদ্ধান্তকে যেন যথার্থ বলে প্রমাণ করে দিল সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা। তাই বলা চলে, এই নির্বাচনে প্রকৃত হার হয়েছে সরকারি দলের। এমন পরাজয় থেকে তারা কোনো শিক্ষা নেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন