স্কুল পেরিয়ে যখন কলেজে ভর্তি
হলাম, তখন প্রথম পড়েছিলাম আমার রাজনৈতিক তত্ত্বগুরু আবুল মনসুর আহমদের
বই পাক-বাঙলার কালচার। বইটি পড়ে চমৎকৃত হয়েছিলাম। এবং আমার ভেতরে একধরনের বোধ কাজ করতে
শুরু করে যে, আমরা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আসলে কারা। বাংলাদেশ আমলে বইটি বাংলাদেশের
কালচার শিরোনামে পুনর্মুদ্রিত হয়। এই বইয়ের মর্মার্থ আত্মস্থ করার জন্য আমি বারবার
পড়েছি। এবং পরবর্তীকালে এ বিষয়ে অধিকতর গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত করেছি। তার ওপরে পড়েছি
জওয়াহেরলাল নেহরুর শিক্ষামন্ত্রী ফরিদপুরের মানুষ হুমায়ুন কবিরের বাংলার কাব্য গ্রন্থটি।
সেখানে আবুল মনসুর আহমদের মতো পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় ভেদ রেখাগুলো অতটা স্পষ্ট ছিল
না। কিন্তু তাতে খুব ভালোভাবেই পূর্ব বাংলার মানুষের জাতিসত্তাগত বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট
ছিল।
হুমায়ুন
কবির লিখেছেন, ‘পশ্চিম বাঙলায় শালবন আর কাঁকড়ের পথ-দিগন্তে প্রান্তর
দৃষ্টিসীমার বাইরে মিলিয়ে আসে। শীর্ণ জলধারার গভীর রেখা কাটে দীর্ঘ সংখ্যাহীন স্রোতস্বিনী।
বাতাসে তীব্রতার আভাস, তপ্ত রৌদ্রে কাঠিন্য, দিনের তীè ও সুস্পষ্ট দ্বীপ্তির পর অকস্মাৎ সন্ধ্যার মায়াবী অন্ধকারে সমস্ত
মিলিয়ে যায়। রাত্রিদিনের অনন্ত অন্তরাল মনের দিগন্তে নতুন জগতের ইঙ্গিত নিয়ে আসে, তপ্ত রৌদ্রালোকে মূর্চ্ছাহত ধরণী অন্তরকে উদাস করে তোলে। পশ্চিম বাংলার প্রকৃতি
বাঙালির কবিমানসকে যে রূপ দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে লোকাতীত রহেস্যের আভাস। অনির্ব্বচনীয়ের
আস্বাদে অন্তর সেখানে উন্মুখ ও প্রত্যাশী, জীবনের প্রতিদিনের সংগ্রাম ও
প্রচেষ্টাকে অতিক্রম করে প্রশান্তির মধ্যে আত্মবিস্মরণ’।
অন্য দিকে
তিনি লিখেছেন, ‘বাঙলার পূর্ব্বাঞ্চলের প্রকৃতি ভিন্নধর্ম্মী। পূর্ব্ববঙ্গে
নিসর্গ হৃদয়কে ভাবুক করেছে বটে, কিন্তু উদাসী করেনি। দিগন্তপ্রসারিত প্রান্তরের
অভাব সেখানেও নাই, কিন্তু সে প্রান্তরে রয়েছে অহোরাত্র জীবনের চঞ্চল লীলা। পদ্মা-যমুনা-মেঘনার
অবিরাম স্রোতধারায় নতুন জগতের সৃষ্টি ও পুরাতনের ধ্বংস। প্রকৃতির বিপুল শক্তি নিয়তই
উদ্যত হয়ে রয়েছে, কখন আঘাত করবে তার ঠিকানা নেই। কূলে কূলে জল ভরে ওঠে, সোনার ধানে পৃথিবী ঐশ্বর্য্যময়ী, আর সেই জীবন ও মরণের অনন্ত দোলার
মধ্যে সংগ্রামশীল মানুষ। প্রকৃতির সে ঔদার্য্য, সৃষ্টি ও ধবংসের সেই সংহত শক্তি
ভোলবার অবসর কই? চরের মানুষ নদীর সাথে লড়াই করে, জলের ঐশ্বর্য্যকে লুটে জীবনের
উপাদান আনে। তাই লোকাতীতের মহত্ত্ব হৃদয়কে সেখানেও স্পর্শ করে। কিন্তু মনের দিগন্তকে
প্রসারিত করেই তার পরিসমাপ্তি ঃ প্রশান্তির মধ্যে আত্মবিস্মরণের অবকাশ কই?’
হুমায়ুন
কবির পূর্ব বাঙলার মানুষের বিপ্লবী মনোবৃত্তি নিয়ে আরও লিখেছেন যে, ‘বাঙলার পূর্ব্বাঞ্চলে সেই বিপ্লবী মনোবৃত্তি কেনো বেশী ছড়িয়ে পড়েছিল, তাও সহজেই বোঝা যায়। প্রকৃতির শক্তির উদ্যত আঘাতের সম্মুখে সংগ্রামশীল মন, নদী প্রবাহের ভাঙাগড়ায় গৃহসৃষ্টির ব্যর্থতাবোধ, এবং মঙ্গোলীয় রক্তের অহিংস্রতা মিলে পূর্ব্ববঙ্গকে বৌদ্ধমানসের উপযোগী করে
রেখেছিল। বাঙলায় আর্য্যপ্রভাবের শক্তি এমনিতেই ক্ষীণ, পূর্ব্ববঙ্গের সে প্রভাব ক্ষীণতর। বরঞ্চ পশ্চিমবঙ্গে স্থিরতা অনেক বেশী, রাজশক্তির প্রভাবও সেখানে অধিকতর কার্যকরী। তাই বৌদ্ধযুগের অবসানে যেদিন হিন্দু
অভ্যুত্থানে বৌদ্ধমানসকে ধ্বংস করবার চেষ্টা প্রবল হয়ে ওঠে, প্রাক্তন মজ্জাগত জাতিবিচারের পূর্ব্বস্মৃতির মধ্যে পশ্চিম বাঙলায় তা অনেক
পরিমাণে সম্ভব হয়েছিল। বল্লালী কৌলীন্যপ্রথার উদ্ভব সেখানে, সবচেয়ে বেশী সাফল্যও বোধহয় সেইখানে। কিন্তু ভঙ্গুর, বিপ্লবী, পরিবর্তনশীল পূর্ব্ববঙ্গে জাতি বিচারের পূর্ণপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা
সে পরিমাণে সার্থক হয়নি। সেই জন্যই পূর্ব্ব ও পশ্চিমবঙ্গের সমশ্রেণীর হিন্দুর মধ্যেও
বিবাহে, ব্যহারে সেদিন পর্য্যন্ত নানাবিধ বাধার কথা শোনা যায়। হিন্দু অভ্যুত্থানের
বিজয়ের দিনে কৌলীন্য ও জাতি-বিচারের প্রবল্যের মধ্যেও পূর্ব্বদেশে বৌদ্ধ মনোবৃত্তির
অহিংস্রতা ও সাম্য প্রচ্ছনে বেঁচেছিল। মোসলেম বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আত্মপ্রকাশ করে
পূর্ব্ববঙ্গের ধর্মীয় রূপ বদলে দেয়। বাংলার প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধেরা ব্রাক্ষ্মণ্যধর্ম্মকে
কোনো দিনই সর্ব্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেনি, রাজশত্তির পরিবর্ত্তনের সঙ্গে
সঙ্গে পূর্ব্ববঙ্গে ইসলামের প্রচারের মধ্যে বৌদ্ধমানসের ক্রিয়া তাই সুস্পষ্ট সেজন্যই এই প্রান্তপ্রদেশে মুসলমানের প্রাচুর্য্য।’
এত দীর্ঘ
অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করা হলো এটা বোঝানোর জন্য যে, বাংলাদেশ জনপদের মানুষ কিভাবে
ক্রমেই স্বতন্ত্র জাতিসত্তা হিসেবে বিকশিত হয়েছে। হুমায়ুন কবির খুব বেশি গ্রন্থ লেখেননি।
সে তুলনায় আবুল মনসুর আহমদের লেখা অনেক বেশি। তিনি রাজনীতি লিখেছেন। জীবনস্মৃতি লিখেছেন।
গবেষণা গ্রন্থ লিখেছেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপাত্মক বই লিখেছেন। তার এমন আর
একটি বাইয়ের নাম বেশী দামে কেনা কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা। এই বইয়ে ৪২টি নিবন্ধ
স্থান পেয়েছে। তার মথ্যে ৩৯টি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭২-৭৩ সালে তৎকালে দেশে সর্বাধিক প্রচারিত
দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের এক দেড় বছরের মধ্যেই এই
মনীষী লেখক উপলব্ধি করেছিলেন যে, আওয়ামী শাসনামলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের কাছে
বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লাখো মানুষ প্রাণ দিয়েছে। সর্বোচ্চ
আত্মত্যাগ স্বীকার করেছে। সে স্বাধীনতা ব্যর্থ তল্পিবাহক শাসকেরা কিভাবে বিপন্ন করে
তুলেছে।
১৯৭১ সালের
যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের
খবর শুনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়
বলেছিলেন, ‘হাজার সাল কা বদলা লে লিয়া।’ অর্থাৎ পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে
হাজার বছরের প্রতিশোধ তুলে নিয়েছেন। তার এ বক্তব্যের বহুমুখী মাজেজা ছিল। সেটি শুরু
হয়েছিল এখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির ভারত বিজয়ের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের
স্বাধীনতা তার প্রতিশোধ মাত্র।
শেখ মুজিবুর
রহমান যখন দিল্লিতে ভারতকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার জন্য ফারাক্কা চুক্তি সই করেছিলেন, তখন বাংলাদেশের পানি মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন আসাফউদ্দৌলা। চুক্তি স্বাক্ষরের
পর তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কি মনে করেন যে, বাংলাদেশ যদি স্বাধীন না হতো তাহলে এরকম চুক্তি করা কি আপনার পক্ষে করা সম্ভব
হতো?’ এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।
বাংলাদেশের
স্বাধীনতা নিয়ে অনেক গীত নিয়মিত আমরা শুনি। ভারত আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে এই করেছে, ওই করেছে। এ কথা বলার লোকের অভাব নেই। হ্যাঁ, বাংলাদেশের শরণার্থীদের তারা আশ্রয় দিয়েছিল। সেটি যত না আমাদের সাহায্যের জন্য, তারচেয়ে অনেক বেশি ছিল পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য। আর শরণার্থীদের থাকা
খাওয়ার জন্য ভারত সরকারের যে ব্যয় হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি তারা পেয়েছিল বিভিন্ন
আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে। এই বাণিজ্যটাও তাদের কাছে কম লাভজনক ছিল না। স্বাধীনতা
যুদ্ধে এ দেশের মানুষেরা যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে গ্রামগঞ্জ থেকে ঠেলে শহরে আবদ্ধ করে ফেলেছিল, তখন বিজয় নিজেদের কব্জায় নিতে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
তা নিয়ে আমাদের একশ্রেণীর সেবাদাস রাজনীতিক ও বৃদ্ধিজীবীদের আদিখ্যেতার অন্ত নেই।
এ কথা
সবাই অবহিত আছেন যে, ১৯৭২-৭৫ সালে সেভাবে ভারতের স্বার্থে এ দেশের স্বাধীনতা
ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল, এবারে সে ধারার পুনরুত্থান ঘটেছে।
এ সরকার দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়ার খেলায় মত্ত হয়েছেন। ২০০৮ সালের
আঁতাতের নির্বাচনে ভারত মার্কিন ষড়যন্ত্রকারীরা শেখ হাসিনাকে যে ক্ষমতায়
বসিয়েছিল, সেটি এখন আর অ¯পষ্ট নেই। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
হিলারি কিনটন সে কথা শেখ হাসিনাকে স্মরণও করিয়ে দিয়েছিলেন ড. ইউনূস ইস্যুতে। জনগণ সম্ভবত
তা ভুলে যায়নি। ভারতীয় পত্রপত্রিকাও লিখেছে যে, শেখ হাসিনা সরকার ভারত না চাইতেই
তাদের অনেক কিছু দিয়ে দিয়েছেন; যা আমাদের দেশের স্বার্থের কোনো মতেই অনুকূল নয়।
ভারত খুব স্পষ্ট করেই বাংলাদেশকে জানিয়ে দিয়েছে যে, তিস্তার পানি দেয়া সম্ভব নয়।
নতজানু চুক্তি অনুযায়ী গঙ্গার পানিও পাচ্ছে না বাংলাদেশের মানুষ। এতে লাখ লাখ মানুষের
জীবন-জীবিকা হুমকির সম্মুখীন। শস্য উৎপাদন বিপর্যস্ত। কৃষিজমি ফেটে চৌচির। এ বিষয়ে
সরকার টুঁ শব্দটি না করে বরং ওকালতি করতে শুরু করেছেন যে, ভারতকে ট্রানজিট, করিডোর অবশ্যই দিতে হবে। এসব উকিলকে কেউ যদি রাষ্ট্রদ্রোহী
বলে চিহ্নিত করেন, তবে কি তাকে খুব বেশি দোষ দেয়া যাবে?
এদের হাতে
স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এখন সম্পূর্ণ বিপন্ন। যে জনগণ অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার
করে এই স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়তে হবে তাদেরই। তার
জন্য চাই জাতীয় ঐক্য। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে সেই ঐক্য প্রতিষ্ঠাই আজকের
মহান স্বাধীনতা দিবসে হোক আমাদের অঙ্গীকার। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন