সরকারের নতজানু নীতির ফলে বাংলাদেশ
রাষ্ট্র এখন এক ভয়াবহ সঙ্কটের মুখোমুখি। সে সঙ্কট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক। সরকার বিষয়টাকে
আমলেই নিতে চাচ্ছে না। জাতিসত্তা এখন বিপন্ন। বৈদেশিক সম্পর্কে সহযোগিতার মাত্রা শূন্যের
কোঠায় গিয়ে পৌঁছেছে। মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রফতানির বিপন্ন দশা। সৌদি আরব হাজারে হাজারে
বাংলাদেশী শ্রমিক ফেরত পাঠাচ্ছে। সৌদি আরবই ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। তারপর
সংযুুক্ত আরব আমিরাত। শেখ হাসিনার গণবিরোধী সরকার মস্কোর সাথে সম্পর্ক উন্নতিকল্পে
মতান্তরে রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনার কমিশনের জন্য এক্সপো ২০২০-এর ভেনু দুবাইয়ের বদলে
রাশিয়ায় করার পক্ষে ভোট দিয়েছে। তার পর শুরু হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমিক বিতাড়ন।
পরিস্থিতির
এতই অবনতি হয়েছে যে, সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার বাংলাদেশীদের জন্য এমনকি
ট্যুরিস্ট ভিসা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। আর বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধিত্বহীন ভারতের অনুগত
সরকার আনন্দে গদগদ হয়ে নানা রকম লেকচার মারছে। পত্রপত্রিকার তথ্যানুযায়ী জানা গেছে, বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের রেমিট্যান্স প্রবাহ (অর্থাৎ দেশে টাকা পাঠানোর হার)
অনেক কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান কিছুকাল আগে বড় অহঙ্কার করেছিলেন
যে, তারা একেবারে রেমিট্যান্সের বড় দালান তুলে ফেলেছেন। ব্যাংকে শুধু
বৈদেশিক মুদ্রা জমছেই আর জমছে। ড. আতিউর দীর্ঘকাল ধরে আমার পরিচিত। বন্ধু বলতে সাহস
পাচ্ছি না। কেননা আমি অতি সাধারণ নাগরিক। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। কিন্তু যখন
তিনি এই রেমিট্যান্স নিয়ে দারুণ উৎফুল্লতা প্রকাশ করেছিলেন, তখনো আমি পত্রিকায় লিখে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম যে, এই উৎফুল্ল ভাব অচিরেই দূর হয়ে যাবে। অর্থনীতির ছাত্র না হলেও আমি রাজনৈতিক
অর্থনীতি বিষয়ে বিদেশে অধ্যয়ন করেছি। আমি দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিলাম যে, ড. আতিউর কী ভয়াবহ পথে যাত্রা করেছেন! কারণ রেমিট্যান্স প্রবাহ বলি, রফতানি বলি, সব কিছুই রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। এই
শিক্ষা আমি গ্রহণ করেছি হল্যান্ডের ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস থেকে। তার আগে
বিষয়গুলো আমার কাছে খুব বেশি স্পষ্ট ছিল না। ফলে আমি গভর্নর আতিউরের আহাদিত জবানে উদ্বিগ্ন
হয়েছি। আমি নগণ্য লেখক-সাংবাদিক। আতিউর যেমন অকপটে স্বীকার করেছেন যে, তিনি গরুর রাখাল ছিলেন, আমি অবিরাম অকপটে স্বীকার করি যে, আমি প্রেসে হ্যান্ডকাস্টিং কম্পোজিটর ছিলাম।
কিন্তু
আমার অপদার্থ পরামর্শ সম্ভবত আতিউর গ্রহণ করতে চাননি। কিংবা মনেই করেছেন যে রেজোয়ান
অর্থনীতির কী বোঝে? কিন্তু আশা করি আমার বর্তমান বিবৃতির পর আতিউর দয়া
করবেন এবং বুঝবেন, আমি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে অনেক দিন পড়াশোনা
করেছি আইএসএসে। সত্যি বলতে কি তার আগে এ সম্পর্কে আমার ধারণা খুব বেশি স্পষ্ট ছিল না।
রাজনীতির
সাথে অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনীতির গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভর করে একটি দেশের অর্থনীতির
অবস্থা কী দাঁড়াবে। যখন আতিউরের ব্যাংকের আমানত কেবলই নিচে নেমে আসছে, আশা করি, তখন তিনি পুরো মাত্রায় তা উপলব্ধি করছেন। এখন তার সঞ্চয়ের পারদ
কেবলই নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। অর্থনীতিবিদ হিসেবে ড. আতিউর আশা করি এর মাজেজা
উপলব্ধি করতে পারছেন। আর সম্ভবত সেই কারণেই তিনি এ দিকে খুব একটা উচ্চবাচ্য করছেন না।
ড. আতিউর
অর্থনীতির চৌকস ছাত্র। এখন খানিকটা চুপ মেরে গেছেন। সরকার বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে সঞ্চিত ডলার দিয়ে কোনো বিদেশী সাহায্য ছাড়াই তারা পদ্মা সেতু
নির্মাণকাজ শুরু করবে। এর যৌক্তিকতা বিষয়ে আতিউর কোনো প্রশ্ন তোলেননি। কিন্তু আমরা
দেখতে পাচ্ছি এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশের দিকে যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ। দেশীয় ব্যাংকগুলো
টাকার পাহাড় কাঁধে নিয়ে অতিষ্ঠ। তারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, দয়া করে আমাদের ঋণ গ্রহণ করুন। পরিস্থিতি এমনই ভয়াবহ। কেউ ঋণ গ্রহণ করছে না।
সরকার দেশীয় ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে। কিভাবে শোধ দেবে তার
কোনো গতিপথ নেই। আর অনির্বাচিত ও মনোনীত সংসদ সদস্য তথা মন্ত্রীরা বাগাড়াম্বরে একেবারে
অন্ধ হয়ে গেছেন। এর মধ্যে মুহিত, হানিফ, নাসিম, এদের আমলে না নিলেও চলে। কিন্তু তোফায়েল আহমেদকে তো আমলে নিতে হয়। আমি আমার
একাধিক লেখায় লিখেছি যে, ১৯৬৯ সালে তোফায়েল আহমেদকে দেখার জন্য এবং তার বক্তৃতা
শোনার জন্য আমি টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা এসেছিলাম।
অথচ এক
দারুণ ব্যাপার ঘটল। এক দিকে মনমোহন সিং যখন শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দিলেন যে, তিস্তার পানিচুক্তি অসম্ভব, তখন তোফায়েল আহমেদ জোর গলায় চিল্লিয়ে
বললেন যে, ভারতকে আমাদের ট্রানজিট দিতেই হবে। তাহলে কী দাঁড়ালো? দাঁড়ালো এই যে, ভারত তিস্তায় পানি দেবে না। কিন্তু ভারতকে আমাদের
করিডোর দিতেই হবে। ভারত সীমান্তচুক্তি করতে চায় না। আমরা ছিটমহলগুলো তাদের বুঝিয়ে দিয়েছি।
তারা দেবে না। তবু ভারতকে আমাদের ট্রানজিট করিডোর দিতেই হবে। তোফায়েল আহমেদের প্রতি
আমার শ্রদ্ধাবোধ ছিল। কিন্তু এই বক্তব্যের পর সেটি আমার নিঃশেষ হয়ে গেল। ভারতের অনুগত
থেকে ধন্য মনে করা নিয়ে যাদের দুর্নাম আছে, শেখ হাসিনার পর তোফায়েল আহমেদ
সেই কাতারে এক নম্বরে যেতে চান বলে আমার মনে হচ্ছে। তোফায়েল আহমেদ মুজিব বাহিনী বা
বিএলএফ ছিলেন। তাদেরকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল যে, যুদ্ধ করতে করতে স্বাধীনতা যোদ্ধারা যখন কান্ত হয়ে যাবে, তখন স্বাধীনতা যোদ্ধাদের প্রত্যাহার করে তোফায়েল আহমেদের মুজিব
বাহিনীকে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক
কর্নেল ওসমানীর জন্য তা সম্ভব হয়নি। ওসমানী ক্ষতবিক্ষত বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা নিয়েই বাংলাদেশে
ঢুকতে চেয়েছিলেন। আর ওসমানী যাতে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না
পারেন, সে জন্য ভারতীয় বাহিনী তাকে সিলেটে নামতে বাধ্য করেছিল। তিনি সত্যি
সত্যি আসতে পারেননি। আর ভারত দেশের লাখো মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসকে ম্লান করে দিয়ে
বলতে চাইছে যে, তারাই বাংলাদেশের ত্রাতা। তোফায়েল আহমেদ সেই গোষ্ঠীরই সদস্য। ফলে
এখন যে নির্লজ্জ ভাষায় তিনি কথা বলছেন, সেটি অস্বাভাবিক কিছু নয়।
জনগণের
রায় নয়, আওয়ামী লীগের মনোনীত হিসেবে এমপি হয়েছেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম।
দারুণ মজা! তিনি বলেছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের হাত-পা কেটে দেয়া হবে।
এই লোকের শিক্ষাদীক্ষার বিষয় আমার জানা নেই। কিন্তু কোনো শিক্ষাদীক্ষাসম্পন্ন লোক এ
ধরনের কথা বলতে পারেন এটি অকল্পনীয়। তিনি লাখ লাখ মানুষকে হত্যার হুমকি
দিয়েছেন। কেউ কি কোথায়ও আছেন যে তিনি হত্যার হুমকির জন্য শেখ সেলিমের বিরুদ্ধে গণহত্যায়
উসকানির মামলা দায়ের করতে পারেন। অথচ তাই করা উচিত।
এর আগে
মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী প্রায় একই ভাষায় কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যারা আন্দোলন করবে তাদের ঘর থেকে বের করে শেষ করে দেয়া হবে। আর বাদ পড়া হানিফ, তার বাগাড়ম্বরের তো শেষই নেই। এত সব বাগাড়ম্বর করে তিনি কার্যত শেষ হয়ে গেছেন।
এখন আশা, বিএনপিবিরোধী গালি দিয়ে যদি আবার স্ট্রিম লাইনে ফিরতে পারেন। শেখ
হাসিনা তার সে আশা পূরণ করবেন কি না বলতে পারি না। তবে তার বাকোয়াজি চলছে। কারণ বাকোয়াজির
মাধ্যমে কামরুল ইসলাম তো মন্ত্রী রয়েই গেছেন। বাকোয়াজির মাধ্যমে তাহলে তিনি কেন মেইন
স্ট্রিমে ফিরতে পারবেন না? কিন্তু রাজনীতির যে ভাষা তারা উপহার দিয়ে যাচ্ছেন, তা যদি এক দিন প্রত্যুত্তর হিসেবে তাদের নেতা আর তাদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হতে
থাকে তাহলে সমাজ কোথায় দাঁড়ায়, ভবিষ্যৎ বংশধরেরা কী শেখে? কুছ পরোয়া নেহি। সমাজ গোল্লায় যাবে। দেশ গোল্লায় যাবে। যাক। ভারতের দাসত্বের
কাছে আত্মসমর্পণের জন্য যা করা দরকার সবই এরা করে যাবে। আর তার যাবতীয় খেসারত দিতে
হবে জনগণকে। এতটা আশা করা বোধ হয় কোনো মতেই সুবিবেচনাপ্রসূত নয়।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন