বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০১৪

এবার হাওয়ার ওপর টোল!


সাদা মনের মানুষ হিসেবে খ্যাত ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়িদ। রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন কদাচিৎ। সারা জীবন শিক্ষকতা করে কাটিয়েছেন। কোনো সময় কলেজে আবার কোনো সময় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। সাহিত্য-সংস্কৃতি তার মূল বিষয় হলেও দেশ-মাটি-মানুষ নিয়ে তার ভাবনা দেশের মানুষ গোগ্রাসে গিলে। এই সাদা মনের মানুষটি বছর দুয়েক আগে হবে হয়তো কোনো এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে কথা বলছিলেন। গাছ ও প্রকৃতি নিয়ে কথা বলছিলেন তিনি। ভদ্রলোক বলছিলেন, আমরা প্রকৃতি থেকে যে অক্সিজেন নিই তার মূল্য কত কোনো সময় সে হিসাব করি না। কিন্তু অসুস্থ হয়ে এই অক্সিজেন যখন হাসপাতালে নিতে হয় তখন এর জন্য কত মূল্য দিতে হয় টের পাওয়া যায়। হিসাবটা এখন মনে নেই, তবে একটি বড় গাছ যে কোটি টাকার অক্সিজেন প্রকৃতিকে দিয়ে যাচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই। এই অক্সিজেন আমরা প্রকৃতি থেকে বিনামূল্যে নিচ্ছি। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়িদের অনুষ্ঠানটি এখন আবার প্রচার হলে সরকার একটা ভালো ধারণা পেতে পারত। যে বাতাস থেকে আমরা এত দামের অক্সিজেন নিচ্ছি তাকে করের আওতায় আনার কথা ভাবতে পারত। এ জন্য প্রস্তাব অনুমোদন করতে পারত মন্ত্রিসভা।

সরকারের ভাণ্ডারে রাজস্বের এখন বড় অভাব। ডিসেম্বর-জানুয়ারি দুই মাসেই আগের বছরের তুলনায় রাজস্ব আদায় কমে গেছে। আর মূল বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল, বাস্তব আদায় তার ধারে-কাছেও নেই। এবার জাতীয় বাজেটে সরকার যে অর্থ আয় করবে বলে হিসাব করেছিল, বছরের সাত-আট মাস পর বাস্তব আদায় তার ধারে-কাছেও থাকছে না। করভুক্ত আর করবহির্ভূত দুই ধরনের রাজস্ব আদায়ই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পেছনে। এ কারণে সংশোধিত বাজেটের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ইতোমধ্যে বেশখানিকটা কমিয়ে নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃপক্ষ। সেই নতুন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১১ শতাংশ বাড়তি রাজস্বও আদায় সম্ভব হচ্ছে না। 

রাজস্ব ভাণ্ডারের এই ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করেই চলেছে সরকার। কিন্তু তা দিয়েও তিন টাকা দামের বিদ্যুৎ কুইক রেন্টাল পাওয়ার থেকে ১৮ টাকায় কেনার জন্য যে দাম দিতে হচ্ছে তার উপায় করা যাচ্ছে না। বিদ্যুতের দাম নিয়মিত বিরতি দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে। একই সাথে বাড়ানো হচ্ছে গ্যাসের দাম। কিন্তু কিছুতেই রাষ্ট্রের টাকার ুধা মেটানো যাচ্ছে না। রাষ্ট্র যত বিদ্যুৎ কিনবে; যত রাস্তাঘাট বানাবে; ব্রিজ-কালভার্ট করবে; স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল, ইঞ্জিয়ারিং কলেজের ভবন বানাবে অথবা করবে এর সংস্কার- ততই পয়সা পাবে সমর্থক ঠিকাদার ক্যাডারেরা। উন্নয়নের জন্য এ টাকার পাশাপাশি অনুন্নয়ন খাতের জন্যও দরকার বাড়তি টাকার। পুলিশ-র‌্যাব-বিডিআর ছাড়া সরকারের উপায় নেই। বিরোধী পক্ষ অবাধ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে আন্দোলন-সংগ্রাম, জ্বালাও-পোড়াও করেছিল তা ঠেকানো হয়েছে পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাব দিয়ে। এ জন্য তাদের সংখ্যা আর সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হয়েছে। একতরফা নির্বাচনে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে হলে বিরোধী পক্ষকে সাইজ করতে, অকালে বিদায়ের ঘণ্টা বাজিয়ে দিতে আরো পুলিশ, আরো র‌্যাব, আরো বিজিবি সদস্য নিয়োগ দিতে হবে। কারাগার আর কারারক্ষীর সংখ্যাও বাড়াতে হবে। দলের সমর্থকদের চাকরির জন্যও প্রয়োজন হবে এটি। ইতোমধ্যে ৭২ হাজার পুলিশ-বিজিবি নিয়োগের কথা পত্রপত্রিকায় এসে গেছে। তাদের বেতনভাতা, সুযোগ-সুবিধার জন্যও প্রয়োজন টাকার। প্রয়োজন কর, শুল্ক, রাজস্বের নতুন নতুন ক্ষেত্র বের করে সেখান থেকে টাকা সংগ্রহের। 

কোথা থেকে আসবে সেই টাকা? ভ্যাটের আওতা বাড়াতে বাড়াতে খুব বেশি আর অবশিষ্ট নেই। উন্নয়ন সারচার্র্জ, অগ্রিম আয়কর ইতাদি নানা নামে কর বাড়ানো হয়েছে। জায়গাজমিসহ নানা ক্ষেত্রে নিবন্ধনের খরচ কয়েক বছরের ব্যবধানে দু-তিনগুণ পর্যন্ত হয়ে গেছে। রাজস্ব আদায়ের নানা ক্ষেত্র খুঁজে অবশেষে একটি উপায় বের করা হয়েছে। রাস্তার ওপর টোল। 

রাষ্ট্র বিনামূল্যে কেন সেবা দেবে? এ যুক্তি মোটেই অস্বীকার করা যাবে না। এ যুক্তিতেই দেশের তাবৎ রাস্তাকে টোলের আওতায় আনা হয়েছে। যে রাস্তা যত বড় সে রাস্তার জন্য তত বেশি টোল আদায়ের ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থার জন্য নীতিমালা তৈরি করে সেই নীতিমালা অনুমোদন করে দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ক্যাবিনেট সচিব কোন গাড়িকে কোন রাস্তায় চলতে কত টাকা দিতে হবে তার বিস্তারিত বয়ানও দিয়েছেন। সেই বয়ান অনুযায়ী, জেলা রোডের জন্য যে টোল দিতে হবে আঞ্চলিক রাস্তায় গাড়ি চালানোর জন্য তার চেয়ে একটু বেশি গুনতে হবে। মহাসড়কে গেলে তার জন্য টোল দিতে হবে আরো বেশি। আর সেটি যদি ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে এর জন্য দিতে হবে আরো বেশি। জেলা সড়কের জন্য ১০০ ভাগ ধরে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সড়কের জন্য ৪০০ ভাগ নির্ধারণ করা হয়েছে টোল। সাইকেল থেকে শুরু করে নসিমন-করিমন, চাঁদের গাড়ি অথবা ভারী লরি- মাফ পাবে না কোনো গাড়ি। এবারের মতো পায়ে হাঁটার জন্য কোনো টোল দিতে হবে না। 

এত দিন পর্যন্ত দেশে বড় বড় সেতু থেকে টোল আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য এগুলো ইজারা দেয়া হয়। কোরবানির পশুর হাটের মতো এসব সেতুর ইজারা সরকারি দলের সমর্থকেরা পেয়ে থাকেন। কিন্তু দেশে এ রকম সেতুর সংখ্যাই বা আর কটা। সরকারি দলের সমর্থক তো অগণন। সারা দেশের রাস্তা থেকে টোল নেয়ার জন্য যখন এসব ইজারা দেয়া শুরু হবে তখন আর খুব বেশি ক্যাডার বাদ পড়বে না। সরকারের কাছ থেকে তারা রাস্তা ইজারা নেবে আর মানুষের কাছ থেকে টোল আদায় করবে। কিন্তু দল যেমন বড় হচ্ছে তেমনি সমর্থক ক্যাডারও বাড়ছে। তাদের জন্য একটি ব্যবস্থা তো করা দরকার। এ ক্ষেত্রে মোক্ষম উপায় হতে পারে বাতাসের ওপর টোল। হাসপাতালে অক্সিজেনের জন্য যে টাকা দিতে হয় তত প্রয়োজন নেই। এর ১ শতাংশ টোল নির্ধারণ করলেও হয়ে যাবে। শহরে বড়লোকেরা বসবাস করে। প্রথমে তাদের ওপর টোল বসানো যাবে। এর পর এর আওতা বাড়িয়ে ভ্যাটের মতো পর্যায়ক্রমে গ্রাম-গ্রামান্তর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে। এভাবে ১৫ কোটি মানুষের ওপর প্রতি মাসে বাতাস খাওয়ার জন্য ১০০ টাকা টোল নির্ধারণ করা গেলে বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার মতো এ খাত থেকে আসবে। তার ১০ ভাগ ইজারাদার ক্যাডারদের জন্য রাখা হলে দলের ক্যাডার সমর্থকদের জন্য দুই হাজার কোটি টাকার ব্যবস্থা এই একটি খাত থেকে হবে। রাতে বিদ্যুতের বাতি জ্বালানোর জন্য টাকা দিতে হয়। দিনে সূর্যের আলো বিনা পয়সায় ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ওপরও কোনোভাবে টোল বসানো যায় কি না সেটির সম্ভাব্যতাও যাচাই করা যেতে পারে। 

মাস দুয়েক পরই আসছে জাতীয় বাজেট। বাজেটের আগে সাধারণভাবে উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো সহায়তার প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে সরকারের সাথে বৈঠকে বসে। এবার সে বৈঠক হবে কি না নিশ্চিত নয়। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন শেষে বিদেশী সহায়তাকারীদের সাথে এক ব্রিফিং সভায় মিলিত হয়েছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। সেখানে মে-জুনের মধ্যে আরেকটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলা হয়েছিল কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে। পশ্চিমা দেশগুলো সেই অবস্থান অপরিবর্তিত থাকার কথা কদিন পরপরই জানাচ্ছে। ফলে সবার অংশগ্রহণের নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ না নিলে এসব দেশ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার আশা খুব একটা করা যায় না। শীর্ষ ঋণদাতা আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমএফের এক প্রতিনিধিদল ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সফরে এসে রেয়াতি-অরেয়াতি সব ধরনের ঋণের হিসাব-নিকাশ চেয়েছে। সরকার এ হিসাব দিতে রাজি নয়। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে টানাপড়েন যে শুরু হয়েছিল, সেটির এখনো নিষ্পত্তি হয়েছে বলে মনে হয় না। এখন আইএমএফের সাথে টানাপড়েন শুরু হচ্ছে। আমেরিকান বাজারে জিএসপির বিষয়টি এত দিন ঝুলে ছিল। এখন জিএসপি না দেয়ার বিষয়ে নিষ্পত্তি হতে চলেছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইঙ্গিত মিলছে, একই পথে হাঁটতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর বিপরীতে ভরসা করা হচ্ছে চীনের ওপর। দেশটি কতটা এ সরকারের সাথে আছে আর কতটা নেই তা এখনো স্পষ্ট নয়। ফলে অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না সরকারের জন্য। আর এ জন্য কর, শুল্ক, টোল বাড়ানো ছাড়া উপায় দেখা যাচ্ছে না। 

বিরোধী পক্ষের আন্দোলন ঠেকাতে সরকারি বাহিনী বড় করতে দরকার টাকার। বিচারালয়ে বিচারক বাড়াতে দরকার টাকার। ক্যাডার বাহিনীর চাহিদা পূরণে দরকার টাকার। সেই টাকা পেতে হবে রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে। এখন থেকেই ভাবতে হবে এ জন্য। প্রয়োজনে একটি টোল বা রাজস্ব বাড়ানোর কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এ কমিশন রাস্তাঘাটের মতো বাতাস, সূর্যালোক বা আরো কোন কোন খাতের ওপর টোল বসানো যেতে পারে তার সুপারিশ করবে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা একটি কমিশন থাকবে, যার কাজ হবে এই কর, শুল্ক, টোল বাড়ানোর জন্য যে বিরোধী পক্ষ দায়ী তা প্রচারের ব্যবস্থা করা। এর বিপরীত কোনো বক্তব্য যাতে কোনোভাবেই টিভি, রেডিও বা পত্রিকায় না আসতে পারে সে ব্যবস্থা এই কমিশন করবে। প্রয়োজনে ফেসবুক, টুইটারকে এর আওতায় আনা হবে। মন্ত্রী নিজেই তদারকি করবেন এ কমিশনের কাজ। এভাবে অমিত সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। যারা এই অগ্রগতি বা সম্ভাবনার সাথে মিলে-মিশে থাকতে পারবে না, তাদের জন্য বিদায় স্টোরের দরজা খোলা থাকবে। তারা বিদায় নিতে না চাইলে সে ব্যবস্থা করা হবে জাতীয় স্বার্থে। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads