বিশ্বের যেকোনো দেশের সংস্কৃতি
সে দেশের মানুষের জন্য অহঙ্কার ও গর্বের বিষয়। একটি দেশের ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, ক্রীড়া, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি সংস্কৃতির অংশ। একটি দেশ সংস্কৃতির দিক থেকে
কতটুকু সমৃদ্ধ সে বিষয় সভ্যতা নিরূপণের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের
মাধ্যমে ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে আমাদের বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত রচিত হলেও
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সে ভিত আরো দৃঢ়তর হয়।
ব্রিটিশ
শাসনামলে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত বাংলায় হিন্দু ও মুসলিম এ দু’টি সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস ছিল। বাংলার পূর্বাংশের মুসলমানেরা শিক্ষা ও
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসর বিবেচনায় তাদের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ
শাসকেরা বাংলাকে বিভাজন করে আসাম সমন্বয়ে একটি পৃথক শাসনতান্ত্রিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা
করে। তবে এটি বাংলার পশ্চিমাংশে বসবাসরত বর্ণ-হিন্দুদের তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষের কারণ
হয়ে দাঁড়ায়। বর্ণ-হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের সূচনালগ্ন থেকেই এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন
এবং তাদের আন্দোলনের মুখে ছয় বছরের মাথায় ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদের মাধ্যমে
বাংলাকে তার আগের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোয় ফিরিয়ে নেয়া হয়। বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে পূর্ব
বাংলার মুসলমানদের ক্ষত প্রশমনে ব্রিটিশরা পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে আবারো বর্ণ-হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টি
প্রতিষ্ঠাপরবর্তী সময়ে দেখা যায় শিক্ষকতার চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে হিন্দুরা মুসলমানদের
চেয়ে অনেক এগিয়ে।
বিশ্বের
যেকোনো দেশের জন্য যেকোনো ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রীড়ানুষ্ঠান অথবা যেকোনো ধরনের আন্তর্জাতিক
সম্মেলনের আয়োজন দেশটির জন্য এক দিকে অশেষ সম্মানের এবং অপর দিকে দেশীয় সংস্কৃতি তুলে
ধরার বিরল সুযোগ এনে দেয়। বিশ্বের কোনো দেশই এ ধরনের সুযোগের হাতছাড়া করে না।
বাংলাদেশ
ইতঃপূর্বে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক ক্রীড়ানুষ্ঠান ও আঞ্চলিক সম্মেলন আয়োজনের সুযোগ লাভ
করলেও এবারই প্রথম এককভাবে রক্তঝরা স্বাধীনতার মার্চ মাসে টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা
আয়োজনের সুযোগ লাভ করে। জমকালো উদ্বোধন ও সমাপনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক
অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে থাকে। উদ্বোধন ও সমাপনী উভয় অনুষ্ঠানে আয়োজক দেশ নিজস্ব সংস্কৃতি
বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকে; কিন্তু গত ১৩ মার্চ ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে
টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের যে উদ্বোধন অনুষ্ঠান বিসিবির (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) উদ্যোগে
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছে তা সমগ্র দেশবাসীকে ব্যথিত, মর্মাহত, হতবাক ও বিস্মিত করেছে। প্রায় ৮ ঘণ্টা ব্যাপ্তিকালের অনুষ্ঠানটির
শুরুতে আমাদের দেশের স্বনামধন্য চারটি ব্যান্ডসঙ্গীত দলকে সঙ্গীত পরিবেশনের সুযোগ দেয়া
হলেও এরপর একনাগাড়ে ভারতীয় শিল্পীদের হিন্দি ভাষায় পরিবেশিত নাচগান চলতে থাকে। অনুষ্ঠানের
একদম শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রথম সারির শীর্ষে থাকা তিনজন শিল্পীকে একটি করে গান
গাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়।
উদ্বোধন
অনুষ্ঠানে আমাদের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং সরকারের
শীর্ষ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটিতে আমাদের সংস্কৃতি
তুলে ধরা হলে তাতে স্বাধীনতার মাসে আমাদের দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটত এবং আমাদের শিল্পীরাও
বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরে সক্ষমতার প্রমাণ রাখতে সমর্থ
হতেন; কিন্তু কার স্বার্থে এবং কী বিবেচনায় আমাদের শিল্পীদের অবহেলায়
ভারতীয় শিল্পীদের প্রাধান্য দিয়ে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছে তা সচেতন দেশবাসীকে ভাবিয়ে
তুলেছে। অনেকের প্রশ্ন অনুষ্ঠানটি এভাবে আয়োজনে কে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল এবং আমাদের
প্রধানমন্ত্রীকে এ ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত রেখে হিন্দি সংস্কৃতির বরণ ও দেশীয় সংস্কৃতির
হরণ দেশের জন্য সম্মান নাকি অসম্মান বয়ে নিয়ে এলো।
অনুষ্ঠানটি
রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম বিটিভি (বাংলাদেশ টেলিভিশন) ও আরো দু-একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল
সরাসরি সম্প্রচার করায় সমগ্র দেশবাসী উপভোগ করতে সমর্থ হয়। অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেছেন
এমন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, বিজাতীয় হিন্দি সংস্কৃতি পরিবেশনের জন্য ভারতীয়
শিল্পীদের পেছনে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে? তাদের আরো প্রশ্নÑ ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন ভারত কি এর শত ভাগের এক ভাগ অর্থ ভারতের
অভ্যন্তরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমাদের শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাদের সংস্কৃতি তুলে
ধরার পেছনে ব্যয় করবে?
বাঙালি
জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পাকিস্তান
সরকারের শীর্ষ নির্বাহীর মুখ থেকে যে মুহূর্তে উচ্চারিত হয়েছিল ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, তখন স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত বাংলার ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-জনতা প্রতিবাদমুখর হয়ে
উঠেছিলেন; কিন্তু আজ হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসনের কারণে আমাদের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে
দেশীয় সংস্কৃতি যখন কোণঠাসা, তখন কোথায় আগের সেই প্রতিবাদ?
টি-২০’র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমরা যেভাবে ভারতীয় শিল্পীদের সম্মান দেখিয়েছি, তারা কি কখনো আমাদের শিল্পীদের সেভাবে সম্মান দেখিয়েছে? আর ভারতীয় শিল্পীদের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হলো, এর সিকি ভাগ অর্থও যদি আমাদের শিল্পীদের পেছনে ব্যয় করা হতো তাতে তারা সম্মানিত
হওয়ার পাশাপাশি আমাদের সংস্কৃতিও বিকশিত হতো। অস্কার খ্যাত ভারতের যে শিল্পীকে এনে
অনুষ্ঠানটির আকর্ষণ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে, আমাদের শীর্ষস্থানীয় শিল্পীদের
মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যাদেরকে একাধিক গান ও নাচ পরিবেশনের সুযোগ দেয়া
হলে তারা অনুষ্ঠানস্থলে দর্শক হিসেবে আগত সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিমোহিত করে রাখতে
পারতেন। আমাদের শিল্পীরা আমাদের গুণীজন। যে জাতি বা দেশ নিজ গুণীজনদের প্রতি সম্মান
দেখায় না, সে জাতি বা দেশের ভবিষ্যৎ খুব একটা সমুজ্জ্বল নয়Ñ অন্তত এ কথা বিবেচনায় নিয়েও সবার উচিত আমাদের যেকোনো ধরনের অনুষ্ঠানে দেশীয়
সংস্কৃতি তুলে ধরায় সচেষ্ট থাকা।
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন নারী থ্রিডি অ্যানিমেশন চিত্র ধারণে
অস্কার পুরস্কার লাভ করেছেন। আমরা কি আমাদের এ অস্কারপ্রাপ্ত শিল্পীকে সম্মান দেখানোর
ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়েছি? অনুরূপভাবে বলা যায়, আমাদের নোবেল জয়ীকে আমরা যতটুকু না সম্মান দেখিয়েছি, তা থেকে কি বেশি সম্মান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতভুক্ত পশ্চিম বাংলার নোবেল
বিজয়ীকে দেখাচ্ছি না? এভাবে আমাদের দ্বারা আমাদের গুণীজনেরা যদি অবহেলিত
হয়, তাতে আমাদের সম্মান বাড়বে নাকি কমবেÑ এ উপলব্ধি আমাদের সবার মধ্যে বিশেষ করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত আছেন
তাদের মধ্যে থাকলে আমাদেরকে হয়তো অপসংস্কৃতি এভাবে গ্রাস করার সুযোগ পেত না।
ভূ-উপগ্রহের
বদৌলতে ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক ও ডিশ এন্টিনা দেশব্যাপী বিস্তৃত হওয়ায় দেশের দূরবর্তী
অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজন দেশ ও বিদেশের টিভি চ্যানেল থেকে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান দেখার
সুযোগ পাচ্ছেন। বর্তমানে আমাদের দেশে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ত্রিশের কাছাকাছি। তা ছাড়া
আমাদের দর্শকেরা বিদেশের ৬০টির মতো চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। এ ৬০ চ্যানেলের
বেশির ভাগই ভারতীয় টিভি চ্যানেল। আবার ভারতীয় চ্যানেলের বেশির ভাগই হিন্দি ছায়াছবির
নাচগানে ভরপুর। হিন্দি ছায়াছবির এসব নাচগান আমাদের শিশু-কিশোরদের এমনভাবে প্রভাবিত
করেছে যে, তাদের অনেকেই হিন্দি কথোপকথনে পারদর্শী। তা ছাড়া এসব শিশু-কিশোর
কোনো অনুশীলন ব্যতিরেকেই শুধু অবলোকন ও অনুসরণের মাধ্যমে হিন্দি ছবির নায়ক-নায়িকাদের
অনুরূপ যে নাচগান পরিবেশন করে তা অনেকটা অবাক করার মতো। আমাদের দেশে অধুনা বিয়ের আগের
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যে নাচগানের ব্যবস্থা করা হয়, তাতে আমাদের বাংলা ব্যান্ডসঙ্গীত
বা বাংলা অন্য কোনো গানের চেয়ে হিন্দি গান ও নাচের পরিবেশনা অধিক পরিলক্ষিত হয়। এটি
অপসংস্কৃতির আগ্রাসন বৈ অন্য কিছু নয়। অপসংস্কৃতির এ ধরনের লালন হীনম্মন্যতার পরিচায়ক।
আমাদের
ক্যাবল টিভি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানগুলো যখন ৫০টিরও বেশি ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা টিভি
চ্যানেলের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে, তখন আমাদের বাংলাদেশের একটি টিভি
চ্যানেলও ভারতে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সুযোগ
পাচ্ছে না। ভারতের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী আমাদের টিভি চ্যানেলের সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান
দেখার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী; কিন্তু ভারত সরকার বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেলের
অনুষ্ঠান সে দেশে সম্প্রচারে অনীহ বিধায় তারা আমাদের টিভি চ্যানেলে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান
দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান আমাদের দেশে সম্প্রচারের
কারণে তারা আমাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করছে। অনুরূপ রাজস্ব আমাদের টিভি
চ্যানেলের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের বদৌলতে আমরাও আহরণের দাবিদার; কিন্তু অর্থনৈতিক শক্তিধর ভারত নিজেদের সংস্কৃতি উৎকৃষ্টতরÑ এ কথাটি ভেবে পাশের রাষ্ট্রগুলোর সংস্কৃতি সম্প্রচারে অপারগ। আমাদের বিভিন্ন
বেসরকারি টিভি চ্যানেল প্রায়ই ভারতীয় শিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।
এসব অনুষ্ঠানের জন্য সম্মানী বাবদ ভারতীয় শিল্পীদের মোটা অঙ্কের টাকা প্রদান করতে হয়।
এ বিষয়ে আমাদের শিল্পীদের অনুসন্ধিৎসু প্রশ্ন তাদের দ্বার আমাদের জন্য যখন
রুদ্ধ, তখন কেন তাদের জন্য আমাদের দ্বার উন্মুক্ত করে দিচ্ছি? আজ এ প্রশ্ন শুধু আমাদের শিল্পীদের নয়, এ দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীরও।
টি-২০
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের একক আয়োজক হওয়ার সুবাদে আমরা উদ্বোধন অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে
আমাদের সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার যে বিরল সুযোগ লাভ করেছিলাম, তা হাতছাড়া করে নিজ সংস্কৃতি হরণ ও ভারতীয় হিন্দি সংস্কৃতি ধারণের যে মন্দ
নজির আমরা সৃষ্টি করেছি, তাতে জাতি ও আয়োজক দেশ হিসেবে লজ্জা ছাড়া আমাদের
প্রাপ্য আর কী হতে পারে? আর তাই সমাপন অনুষ্ঠানে এ ধরনের আয়োজনের পুনরাবৃত্তি
না ঘটিয়ে কিছুটা হলেও লজ্জা প্রশমনে উদ্যোগী হতে পারি; কিন্তু সে উদ্যোগ আদৌ নেয়া হবে কি না সে বিষয়ে দেশবাসী সন্ধিহান।
ইকতেদার আহমেদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন