অনিশ্চিত গন্তব্যে মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিশ্বাসের দোদুল্যমানতা দি¦ধান্বিত এবং আত্মবিশ্বাসহীন এক ধরনের আপোষকামিতা বড় বেশি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর অসীম সার্বভৌমত্বের মহান চেতনায় উজ্জীবিত মানবসত্তা আজ যেন ভীরুতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কি যেনো উদাসীন জড়তা আর হীনম্মন্যতা যেন তাদের ওপর ভর করে আছে। ইসলামী সভ্যতা শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য আজ সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এসব সমস্যার কারণ কি, যে মুসলিম জাতি এক সময় মানবজাতিকে সকল বিভ্রান্তি, বিপর্যয় ও অজ্ঞতা পংকিল আবর্ত থেকে মুক্ত করে সিরাতুল মুসতাকিমের সোনালী সমাজ গড়েছিল, সে জাতি আজ নিজস্ব জীবনবোধ, আদর্শ ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে নিজেরাই নিজেদের জীবনকে বিলুপ্তি ও ধ্বংসের পথে লিপ্ত হয়েছে।
যে জাতির ধমনিতে তাওহীদের রক্তধারা প্রবাহিত হচ্ছে, এখন সেই জাতি শিরক, কুফর ও জাহেলিয়াতের পংকিল আবর্তে নিমজ্জিত হয়ে মুসলিম উম্মাহকে অপসংস্কৃতির অতল গহীনে নিক্ষেপ করার আত্মঘাতী পথে এই জাতি। পরিবারে, সমাজে এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রে ইসলামী জীবনবোধ, চেতনা ও নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতা এসব বিপর্যয় ডেকে আনছে। নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্তির ধূ¤্রজাল থেকে রক্ষা করতে হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকেই এ দায় নিতে হবে। যাতে তারা অবশ্যই নিজস্ব মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অবশ্যই মূল্যবোধ ধরে রাখতে পারে।
নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ স্থির কোন বিষয় নয়। যুগ ও সভ্যতার পরিবর্তনে সমাজের মানুষের মূল্যবোধেরও পরিবর্তন হয়। একটি সমাজের মানুষের ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা, চেতনা, কৃষ্টি, বিশ্বাস ও সভ্যতার ওপর ভিত্তি করে সমাজের মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। আর এই ধারণাগুলোর অসঙ্গতিপূর্ণ পরিবর্তনের পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রে অবক্ষয়ের আলামত দেয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা সমাজে হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে সুস্থ-সুন্দর সমাজ প্রত্যাশী নাগরিকদের হৃদয়ে। আমরা এ কেমন সমাজ গড়ছি! আর আমরা কোথায়ইবা যাচ্ছি! ছেলে-মেয়ে তার মা-বাবা খুন করছে, পিতৃতুল্য শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ করছে। এতে সমাজ সচেতন মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। অতীতে কদাচিত দেখা যেত এইসব ঘটনা। পরিবার-পরিবারের মধ্যে, সমাজ-সমাজের মধ্যে ও রাষ্ট্র যদি রাষ্ট্রের মধ্যে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে তাহলে এই জাতির আশা কি থাকে। এ নির্মমতা বর্বরতা কেন! ভাবতেও ঘৃণা হয় বর্তমান এই জাতির মূল্যবোধ ও অবক্ষয় দেখে।
রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সরকারি-সাহিত্যশাসিত চাকরিজীবীদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আমরা দেখে অভ্যস্থ, এসব সমাজকে যতোটা বিচলিত করে না, দেখতে দেখতে সমাজে তা সয়ে যায়। সমাজের উচ্চ মূল্যবোধের ধারক সম্মানিত শিক্ষকদের নৈতিক মূল্যবোধের স্খলন দেশ-জাতির জন্য নিশ্চিত বার্তা বহন করে। এটাও ঠিক, সমাজ-রাষ্ট্রের বেশির ভাগ শ্রেণী পেশায় নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয় থাকলে বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষক সমাজ উচ্চ মূল্যবোধ লালন করতে পারে না। বর্তমানে আমরা যা দেখছি নীতি নৈতিকতা মূল্যবোধের অবক্ষয় ধরেছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি শ্রেণী পেশার মধ্যে, কোথাও কম কোথাও বেশি। যদি সবকিছু দেখার পরও পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ভাবে এই তো বেশ ভালো আছি। এমনটা ভাবার আর অবকাশ নেই। যদি অজান্তে পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রের চরিত্রে নৈতিক স্খলন ঘটলে ফিরিয়ে আনা কতোটা যে কষ্টসাধ্য যে জাতি ভুক্তভোগী সেই জাতি জানে। নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সমাজে সংসারে ভাইরাস সদৃশ। উচ্চ মূল্যবোধের চর্চা যেমনি সমাজকে সুন্দর নৈতিক ও মানবিক করে, তেমনি মূল্যবোধের অবক্ষয়কে রোধ না করলে বা প্রশ্রয় দিলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নির্মম ও কলুষিত করে। বিচ্ছিন্নভাবে ভালো থাকার সুযোগ কোথাও নেই।
নৈতিক মূল্যবোধের এই সর্বগ্রাসী অবক্ষয় রোধকল্পে কর্মসূচি গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। নতুবা সমাজ-রাষ্ট্রের নিশ্চত অধঃপতন ঠেকানো যাবে না। এ জন্য জাতির যে বিভ্রান্তির ধূ¤্রজাল থেকে রক্ষা করে ইসলামী জীবন চেতনায়, ধর্মীয় নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কিত বিষয়গুলো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কার্যক্রমে ওতপ্রোতভাবে ধরে রাখতে হবে। মানুষকে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ও উৎসাহদানে পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতিপরায়ণ ও অসৎ ব্যবসায়ীদের মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধকল্পে কার্যকর আইনী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনকে নিশ্চিত করতে হবে।
তবে সাফল্যের জন্য অবশ্যই সর্বপর্যায়ে নেতৃত্ব থাকতে হবে জ্ঞানী ও যোগ্য প্রতিনিধিদের হাতেই। তারাই নির্ধারণ করবেন নীতি-আদর্শ এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্বও থাকবে বিকেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থায় তাদের ও জনগণের ওপরেই। সাফল্য ও ব্যর্থতার দায়-দায়িত্বও বহন করতে হবে তাদেরকেই। এই ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য অস্ত্রের প্রয়োজ নেই। প্রয়োজন সচেতনতা ও আন্তরিক ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। ধোঁকাবাজির ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসে গড়ে তুলতে হবে সভ্যতাভিত্তিক গণআন্দোলন। সেখানে স্থান পাবে না বর্ণচোরারা। এ ধরনের গণজোয়ারে মধ্যে থেকেই সৃষ্টি হবে নতুন প্রজন্মের ত্যাগী নেতৃত্ব। তারা হবেন জনগণের সাথী; মুনিব নয়। নির্ধারিত নীতিমালার বাস্তবায়নের জন্য নিঃস্বার্থ আন্তরিকতায় জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাবেন তারা। তাদের থাকবে স্বচ্ছ জবাবদিহিতার দায়বদ্ধতা। বিকেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় স্থানীয়ভাবে জনগণই হবে প্রগতি ও উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। সরকার হবে তাদের কাজের সহযোগী। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ক্ষমতা হবে সীমিত। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করা, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সামাজিক স্থিতিশীলতার নিশ্চিতকরণ, বৈদেশিক সম্পর্কের নীতি নির্ধারণ, মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ, ডাক ও যোগাযোগ বিভাগকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা এবং সর্বোপরি বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা বহাল করাই হবে মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব। প্রশাসনিক আমলারা সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এ ধরনের বিকেন্দ্রীয়, প্রতিনিধিত্বশীল জবাবদিহিমূলক সরকার ও সমাজকাঠামো যার প্রতিটি পর্যায়ে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত করা সম্ভব হয় তবেই গড়ে উঠবে সুষম সমাজ ব্যবস্থা ও গণমুখী রাষ্ট্রীয় প্রশাসন। আর সে ধরনের রাষ্ট্র ও সমাজেই সম্ভব হবে প্রকৃত অর্থে মানবাধিখার ও গণতন্ত্রসহ অন্যান্য মূল্যবোধের অনুশীলন ও অবাধ চর্চা। যা ক্রমান্বয়ে প্রথিত হবে রাষ্ট্র সমাজের প্রতিক্ষেত্রের সর্বস্তরে। এভাবেই পুনরায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে অতীতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
পরিশেষে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সবাই কত সব উদ্ভট ফর্মুলা দিচ্ছে, তার দিকে এসবও আরও অনেক শুনতে হবে। ঐসব ফর্মুলা বাস্তবায়নে তিক্ত অভিজ্ঞতা অভিশাপও বহন করছেন। আর নয় আপনারা যৌক্তিকতা যাচাই করে দেখুন। ইসলামী সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য আজ সমাজ থেকে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। শুধুমাত্র নিজস্ব জীবনবোধ, আদর্শ ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে। আমরা মুসলমান যদি ইসলামী জীবনবোধ, আদর্শকে ধারণ না করতে পারি বিপর্যয় আমাদের সম্মুখে। এখনই সময় একই গাছের ছায়ায় বসা। জীবন সুন্দর ও আলোকিত করা। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অবশ্যই নিজস্ব মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করে গড়ে তোলা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন