শনিবার, ২২ মার্চ, ২০১৪

এই নির্বাচন কমিশনের কী প্রয়োজন


উপজেলা নির্বাচন নিয়ে ধারাবাহিকভাবে যে কীর্তি ঘটে চলেছে, তাতে যেকোনো সাধারণ মানুষের মনে এ প্রশ্নের উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক যে, নির্বাচনের নামে দেশব্যাপী এক ধরনের মশকারা চলছে। পাঁচ সিটি নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবিতে সরকারের টনক তো নড়েইনি, বরং দ্বিগুণ উৎসাহে তারা প্রচারণা চালাতে থাকে, উপজেলা নির্বাচন জনমতের বা জনসমর্থনের কোনো মাপকাঠি নয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রীরা তারস্বরে এই বলে চেঁচাতে থাকেন যে, জাতীয় ট্রেন মিস করে, বিএনপি এবার উপজেলা ট্রেনে উঠেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আর এক কাঠি সরেস। টিটকারি, ঠাট্টা, মশকারায় তার জুড়ি মেলা ভার। কখনো কখনো এই ভেবে লজ্জা হয় যে, একটি প্রাচীন, সুসভ্য দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধিদের মুখ থেকে এসব শুনতে হয়। যে দল থেকেই হোন না কেন, কেউ যখন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তিনি শুধু তার নিজ দলের প্রতিনিধিত্ব করেন না, গোটা দেশের জনগণের, তথা জাতিরই প্রতিনিধিত্ব করেন। তার আচরণ, ভাষা, বাক্যবিন্যাসে তখন মানুষ সুরুচি আশা করতে থাকে। 

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের েেত্র স্থূল দুটি বিষয় সব সময়ই লণীয়। তা হলো, জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে কটূক্তি করতে তিনি বড় ভালোবাসেন। সেটা শোভন হলো কি না, কিংবা সে রকম মন্তব্যে জনগণ খুশি কি না বা দুঃখ পেল কি না, সে বিষয় কখনোই ধর্তব্যের মধ্যে নেয়া হয় না। এ দেশের তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গ এলেই নানা রকম কটু কথা বলাতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্য দেখা যায়। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে দিয়ে যেন বিশাল এক অপরাধ করে ফেলেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিয়েই পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন, সেখানে জিয়া কেন স্বাধীনতার ঘোষণা করে হিরো হতে গেলেন?
ফলে যখন যা খুশি তাই বলা হচ্ছে। জিয়া পাকিস্তানের চর ছিলেন। জিয়া স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন। জিয়া ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন’Ñ এমন সব উদ্ভট ও আজগুবি বক্তব্য আওয়ামী নেত্রী সব সময়ই দিয়ে থাকেন। আর বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কেও হামেশা কটূক্তি করতে তার বাধে না। সে রকম উক্তি তারা সংসদে দাঁড়িয়ে করতে পারেন। জনসভায় করতে পারেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে করতে পারেন। যেমন, গোলাপি। ক্ষমতাসীন নেতানেত্রীরা টিপ্পনি কেটে বারবার বলেছেন, জাতীয় ট্রেন মিস করে, গোলাপি এখন উপজেলা ট্রেনে উঠেছে। তারা হয়তো এ রকমটিই আশা করছিলেন, বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নিলে তার দল সব আসনে এমনি এমনি জিতে যাবে। তাহলে কী মজাই না হতো!
জাতীয় নির্বাচন আর উপজেলা নির্বাচনের মধ্যে গুণগত পার্থক্য আছে। সে পার্থক্য যারা উপলব্ধি করতে পারেন না, তারা বলতে চান, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি মারাত্মক ভুল করেছে। সেখানেও তাদের ফল উপজেলার মতো অনুকূল হতে পারত। এই ধারণা মারাত্মক ভুল। দু-তিনটা উপজেলা নিয়ে এক একটি সংসদীয় আসন। এই বিশাল এলাকায় কোনো একজন প্রার্থীর পে মনিটর করা সহজ নয়। তার ওপর সরকার তার পেটোয়া বাহিনী, পুলিশ-বিজিবি, এসব ব্যবহার করে যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করত, তা মোকাবেলা করা কঠিন। তবে স্থ্নাীয় সরকার নির্বাচনে সে কাজ ততটা কঠিন নয়। উপরন্তু নির্দলীয় ভিত্তিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বলে, এক একটি পদে চার-পাঁচজন করে প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকেন। তাদের এজেন্ট থাকে। প্রচার-প্রচারণা চলে। ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। সে কারণেই প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে এবং আওয়ামী লীগের এক ধরনের ভরাডুবি হয়েছে।
ফলে এরপর সরকার আর উপজেলা নির্বাচনকে স্বাভাবিক গতিতে প্রবাহিত হতে দেয়নি। নির্বাচনের আগে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিরোধীদলীয় প্রার্থী ও তার সমর্থকদের পাইকারিহারে গ্রেফতার করে ওই এলাকা থেকে আগত জাতীয় নেতাদেরও জেলে পুরতে থাকে যাতে তারা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে না পারেন। তারপর, নির্বাচনের দিন কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন প্রভৃতি অপকর্ম ব্যাপকভাবে করেছে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার নির্বাচনে। সেখানে পছন্দমাফিক দলীয়, অনুগত লোকদের পোলিং ও প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের অনেকে নিজেরাও সক্রিয়ভাবে জাল ভোট অভিযানে অংশ নেন। দেখা গেছে, পোলিং অফিসারেরা নিজেরাই শত শত জাল ভোট দিচ্ছেন। এমনকি, কোথাও কোথাও জাল ভোট দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীও। আর জাল ভোট তো দিয়েছেই আওয়ামী সমর্থক মাস্তান বাহিনী। দু-এক দিন আগে এমনকি ভোটের দিনও বিরোধী দলের অনেক প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের পোলিং এজেন্টদেরও। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নেয়া হয়েছে যে, ভয়ে, আতঙ্কে, বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এই লেখা যেদিন প্রকাশিত হবে, সেদিন চতুর্থ দফায় উপজেলা নির্বাচন। এ চরিত্র কী হবে, তা ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। সরকারসমর্থক প্রার্থীরা ইতোমধ্যেই এমন সব বক্তব্য দিয়েছেন যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ন্যূনতম সম্ভবনাও এখন আর নেই।
সাতীরার কলারোয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী প্রতিপরে সমর্থকদের ওপর হামলা ও তাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে ভোট দেয়ার নামে যদি কারো খায়েশ হয় ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার, আর ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পর আমার কর্মীরা তাদের দেখে মাথা গরম হয়ে যায়, আর মাথা ফাটিয়ে দেয় এবং মারতে মারতে মেরেও ফেলে তাহলে আমরা কিছু করতে পারব না। আমার পোলিং এজেন্টদের সামনে প্রকাশ্যে সিল মারতে হবে।তিনি প্রকাশ্য জনসভায় বলেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকেরা ভোট দিতে গেলে আঙুলে কালির ছাপ দেখে দেখে আঙুল কেটে ফেলা হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এজেন্ট ও নির্বাচনী কর্মীরা যদি লাশ হয়ে ফেরে, এর দায়িত্ব কেউ নেবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এ অবস্থায় ওই এলাকার ভোটার ও অন্য প্রার্থীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ের ভোটগ্রহণ সামনে রেখে বেশির ভাগ নির্বাচনী এলাকায় প্রতিপ ভোটারদের এভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন মতাসীন দলের প্রার্থীরা। কোথাও কোথাও প্রতিপ প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর হামলা হচ্ছে। এসব বিষয় উল্লেখ করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে বহু অভিযোগ দাখিল হচ্ছে। আওয়ামী লীগের ওই প্রার্থী আবার ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারকের কাছে কলারোয়া উপজেলার ২১ জন প্রিজাইডিং অফিসারকে পরিবর্তন করার তালিকা দিয়েছেন। তালিকা অনুযায়ী প্রিজাইডিং অফিসার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানায় ইসি সূত্র।
যশোর সদর উপজেলার নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট নির্বাচন কমিশনে এসে সরকারসমর্থিত প্রার্থীর হুমকি ও পুলিশি হয়রানির অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগে তিনি বলেন, সরকারসমর্থিত প্রার্থীর কর্মীরা বিএনপি সমর্থিত প্রার্র্থীর কর্মী ও সম্ভাব্য পোলিং এজেন্টদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা চালিয়ে কুপিয়ে জখম করেছে। এ ছাড়া বোমা হামলার নাটক সাজিয়ে তার কর্মীদের গ্রেফতারসহ বিভিন্ন পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কোর্টে চালান দিচ্ছে। বাগেরহাটের মোল্লার হাট উপজেলার বিরোধীদলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী শেখ হাফিজুর রহমান কমিশনে অভিযোগে জানিয়েছেন, আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী তার নির্বাচনী কাজে বাধা সৃষ্টি করছেন এবং হামলা ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। নির্বাচনী এলাকায় সরকার দল সমর্থিত ওই প্রার্থীর কর্মীরা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, টেবিলে সিল মারতে হবে। বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা ভোটকেন্দ্রে এলে তাদের হাত-পা কেটে নেয়া হবে। মামলা দিয়ে গ্রেফতার করানো হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইসিকে জানিয়েছে, চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে আরো বেশি সহিংসতা হতে পারে। একই ধরনের অভিযোগ এসেছে বড়াই গ্রাম, দৌলতপুর, ময়মনসিংহের গৌরীপুরসহ বহু এলাকা থেকে।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় নির্বাচনী প্রচার, মাইক ভাঙ্চুর করে কর্মী, সমর্থক ও সাধারণ ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সরকারসমর্থক প্রার্থী। জাসদসমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী সেখানকার সংসদ সদস্য ও তার ছেলের বিরুদ্ধে নিজের বাড়ির আঙিনায় সংবাদ সম্মেলন করে বক্তব্য দিয়েছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) অবিলম্বে সবার অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু একটি নতুন নির্বাচন দাবি করেছেন। কারণ যে নির্বাচনে ৩০০ আসনে জাতীয় সংসদে ১৫৩ জনই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতহয়ে যান, তা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। টিআইবি, সুজন কেন এমন কথা বলল? তাতে আওয়ামী নেতা-মন্ত্রীরা বড়ই গোসসা হয়েছেন। তারা এখন টিআইবি ও সুজনের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেছেন।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ২০ মার্চ জরুরি ভিত্তিতে এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সার্বিক নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন কমিশন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। নিজেদের ওপরও তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। কোথাও ইসির কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরা মানেনি। সব জায়গাতেই সরকারের কথামতো কাজ হয়েছে। সরকারই সর্বেসর্বা ছিল। সারা দেশে ভয়াবহ সহিংসতার মধ্যেও নির্বাচন কমিশন ছিল নীরব ভূমিকায়। এ কারণে কমিশনকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলা যায়। এই ব্যর্থতার দায় অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। তিনি বলেন, এতগুলো মানুষ হতাহত হওয়ার পরও কমিশনের প থেকে দাবি করা হয়েছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। সরকার বলেছে, হতাহতের ঘটনা বিচ্ছিন্ন।
কমিশন যে ব্যর্থ এ বিষয়ে সম্ভবত কারো মনে কোনো প্রশ্ন নেই। এত বড় নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রমোদ ভ্রমণে আমেরিকা রয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বলেছেন, আল্লাহর মেহেরবানি, নির্বাচনে মাত্র তিনজন খুন হয়েছেন। কমিশনার শাহনেওয়াজ বলেছেন, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আর পুলিশ গ্রেফতার করলে তাদের কী করার আছে। এত সব ঘটনায় যদি সব কিছু সরকার নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে এই কমিশনের দরকারই বা কী? সে জন্যই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তোমার পতাকা যারে দাও, /তারে বহিবারে দাও শকতি।এই কমিশন পতাকা পেয়েছে, কিন্তু সে পতাকা বইবার শক্তি তাদের নেই। 

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads