বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ, ২০১৪

তথাকথিত আধুনিকতায় নির্যাতিত নারী


নারীরা এদেশে নেতৃত্ব দিচ্ছে বটে; আশানুরূপ অবস্থানে নেই তারা। সংসদেও নারীরা অধিকহারে আসছে; কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে না। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-গণতান্ত্রিক অবস্থার মতোই পশ্চাৎপদ নারী সমাজ। তাদেরকে আধুনিকায়নের কথা বলা হলেও সঠিক উন্নয়ন হচ্ছে না তাদের ক্ষেত্রে।
২০১১ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত আদমশুমারির প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের নারীর সংখ্যা ৭ কোটি ১০ লাখ ৬৪ হাজার। পুরুষ ও নারীর সংখ্যার অনুপাত ১০০:১০৩। এদেশে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের গড় আয়ু ৬৩ বছর। কিন্তু বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে-দেশে আধুনিকতার বাতাবরণে নারীর দুঃখ ভারাক্রান্ত নিয়তি নিবর্তিত, নির্যাতিত। রাজনৈতিক ডামাঢোল, কোলাহল, আধুনিকতার সাফাই ইত্যাদির তলে চাপা পড়ে আছে সহস্র নারী দুঃসহ মর্মবেদনা। শুধুু বাংলাদেশ নয়, উন্নত দেশেও নারীর অবস্থা ভালো নেই। বস্তুতান্ত্রিক ও ভোগবাদী সমাজে নারীরা হচ্ছে ভোগ ও নির্যাতনের সামগ্রী। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৮টি সদস্য রাষ্ট্রে প্রতি ৩ জনে ১ জন নারী যৌন বা শারীরিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। ‘দ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এজেন্সি ফর ফান্ডামেনটাল রাইটস’- এর দেয়া পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে,  ১৫ বছর বয়স থেকে এ ধরনের ভয়াবহ ও অকথ্য অভিজ্ঞতার সম্মুখীন নারীর সংখ্যা ৬ কোটি ২০ লাখ। সর্ববৃহৎ এ জরিপটি পরিচালিত হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৪২,০০০ নারীর ওপর। ১৫ থেকে ৭৪ বছর বয়সী ৪২ হাজার নারীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। এতে যে তথ্য ওঠে এসেছে, তা আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের উন্নত ২৮টি দেশের ১৮ কোটি ৬৬ লাখ নারীর মধ্যে ঠিক কতজন যৌন সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হচ্ছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানতেই জরিপটি চালানো হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এর মধ্যে ১০ কোটিরও বেশি নারী যৌন হয়রানির শিকার। প্রতি ৭ জনে মাত্র একজন নারী পুলিশের কাছে তার ওপর ঘনিষ্ঠ পুরুষের যৌন নির্যাতনের ব্যাপারে রিপোর্ট লিখিয়েছেন। প্রায় ১০ শতাংশ নারী ১৫ বছর বয়স থেকে কোন না কোন ধরনের যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার বিষয়ে রিপোর্ট করেছেন। এর মধ্যে ২০ জনে একজন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে রিপোর্ট করেছেন, যার অর্থ ৯০ লাখেরও বেশি নারী ধর্ষিত হয়েছেন। বিভিন্ন পেশায় কর্মরত নারীদের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ নারীই জীবনের কোন না কোন সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। আর এ জরিপটি চালানোর মাত্র ১২ মাস বা ১ বছর আগে ৭৫ শতাংশ কর্মজীবী নারীর প্রতি ৪ জনে ১ জন যৌনভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন।
নারী নির্যাতনের বিচিত্র সংবাদ দেশে ও বিদেশে নতুন নয়। সাম্প্রতিক একটি কেস স্টাডি তুলে ধরি: বিয়ের  মেহেদীর রং শুকায়নি এখনো নববধূ কণার। সুখের স্বামী-সংসারও করা হলো না তার।  অনেক রঙিন স্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে যৌতুকের বলি হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে তাকে পরপারে। ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায়। আঞ্জুমান আক্তার কণা নামে এক গৃহবধূকে হত্যার অভিযোগ ওঠেছে। যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে হত্যা করেছে বলে ওই গৃহবধূর মা মঞ্জুরা বেগম বাদী হয়ে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িকে আসামী করে মিরসরাই থানায় একটি মামলা করেছেন। গত বৃহস্পতিবার [১৯ সেপ্টেম্বর] রাতে উপজেলার খৈয়াছরা ইউনিয়নের উত্তর আমবাড়ীয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ কণার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠিয়েছে। তবে পুলিশ তদন্তের আগে এ বিষয়ে কোন ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। কণার মা সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, তার মেয়েকে যৌতুকের জন্য হত্যা করা হয়েছে। তবে পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত পরিবারের লোকজন পুলিশের কাছে দাবি করেছে কণা গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
কণার মতো বহু মেয়ে মারা যাওয়ার পর হত্যা না আত্মহত্যার চক্করে আবর্তিত হয়। সঠিক ঘটনা কখনই জানা যায় না। এইসব ধূম্রজালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিহত মেয়েটি। কারণ সে সঠিক বিচার ও ক্ষতিপূরণ পায় না। সে তখন থাকে পরপারে। সকল চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। পেছনে পড়ে থাকে তার নির্যাতিত-নিপীড়িত জীবনের দুঃসহ প্রতিচ্ছবি।
আভিধানিকভাবে, নারী বলতে পৃথিবীর অন্যতম প্রাণী মানুষের স্ত্রী-বাচকতা নির্দেশক রূপটিকে বোঝানো হয়। এর বিপরীত পুরুষ, নর প্রভৃতি। সংস্কৃত নৃ শব্দটি থেকে নারী শব্দটির উৎপত্তি (নৃ+ঈ=নারী)। বিভিন্ন আসমানী/ধর্মীয় কিতাব যেমন বাইবেল, কুরআন ইত্যাদি অনুসারে মা হাওয়া (আ.) পৃথিবীর প্রথম নারী বা মানবী। ‘নারী’ শব্দটি সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী-মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়, যেখানে ‘মেয়ে’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় স্ত্রী-শিশু বা কিশোরীর ক্ষেত্রে। তাছাড়া বয়সের বাধা ডিঙিয়েও ‘নারী’ শব্দটি সমগ্র স্ত্রী-জাতিকে নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হতে পারে, যেমন: ‘নারী অধিকার’ দ্বারা সমগ্র স্ত্রী জাতির প্রাপ্য অধিকারকে বোঝানো হয়। প্রসঙ্গত নারী অধিকার পরিভাষাটি বলতে বোঝায় এক ধরনের স্বাধীনতা, যা সকল বয়সের  মেয়ে ও নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এই অধিকার হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক, আইনানুগ, আঞ্চলিক সংস্কৃতি দ্বারা সিদ্ধ, বা কোনো সমাজের আচরণের বহিঃপ্রকাশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই অধিকারকে অস্বীকার করতেও দেখা যায়। সীমান্ত পেরিয়ে বিভিন্ন দেশে এই অধিকারের বিভিন্ন রকম সংজ্ঞা ও পার্থক্য লক্ষণীয়।  কারণ এটি পুরুষ ও ছেলেদের অধিকারের থেকে ভিন্ন। এবং এই অধিকারের সপক্ষে আন্দোলনকারীদের দাবি হলো: নারী ও  মেয়েদের অধিকারের প্রচলনের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দুর্বলতা রয়েছে; রয়েছে রাজনৈতিক ও আইনগত বিঘœ। বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল দেখতে পান যে, নারীসংক্রান্ত বিষয়াবলী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি নারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে লিখতে শুরু করেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি প্রারম্ভিক নারীবাদী হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। ১৮৬১ সালে লিখিত ও ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সাবজেকশন অব উইমেন’ শীর্ষক নিবন্ধে নারীদের বৈধভাবে বশীভূতকরণ বিষয়টিকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা করেন তিনি। এর ফলে  সঠিকভাবে সমতাবিধান প্রসঙ্গটি প-িতদের আলোচনায় স্থান পায়। উদাহরণস্বরূপ, যেসব বিষয়ের ক্ষেত্রে নারী অধিকার প্রযোজ্য হয়, তা সুনির্দিষ্ট না হলেও এগুলো মূলত সমতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতাকেন্দ্রিক। যেমন: আইনের চোখে সমানধিকার, সামাজিক সম্মান ও মর্যাদা প্রাপ্তিতে সাম্যতা, ভোটদানের অধিকার, অফিস-আদালতে একসাথে কাজকর্ম করার অধিকার, কাজের বিনিময়ে ন্যায্য ও সমান প্রতিদান (বেতন ও অন্যান্য সুবিধা) পাবার অধিকার, সম্পত্তি লাভের অধিকার, শিক্ষার্জনের অধিকার, সামরিক বাহিনীতে কাজ করার অধিকার, আইনগত চুক্তিতে অংশগ্রহণের অধিকার, বিবাহ, অভিভাবক, ও ধর্মীয়গত অধিকার। নারী ও তাদের সহযোগীরা কিছু স্থানে পুরুষের সমান অধিকার আদায়ের স্বপক্ষে বিভিন্ন প্রকার ক্যাম্পেইন ও কর্মশালা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের নারীরা, বিশেষত গ্রামীণ নারীরা অগ্রসর অধিকার তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার মতো নিরাপত্তাও ক্ষেত্রবিশেষে পাচ্ছে না। কেন এমন বঞ্চনা হচ্ছে, সেটা আঁচ করা যায় সমাজ ব্যবস্থার পেশীবহুল দাপট লক্ষ্য করলে।
প্রসঙ্গত, পিতৃতন্ত্র পুরুষকে শিখিয়েছে সব বিষয়ে আপন চাহিদা পূরণে তার পৌরুষগত অধিকার প্রয়োগের বিষয়টি। এমন কি, যৌনতাও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। গবেষণার মাধ্যমে এই একতরফা পুরুষতন্ত্রীয় আগ্রাসনের তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের একটি সমীক্ষা সম্প্রতি সম্পন্ন হয়েছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার ছয়টি দেশে: বাংলাদেশ যার মধ্যে অন্যতম। অন্য পাঁচটি দেশ হলো: শ্রীলঙ্কা, পাপুয়া নিউগিনি, কাম্বোডিয়া, চিন ও ইন্দোনেশিয়া। দশ হাজার পুরুষের অভিমত নিয়ে সম্পন্ন এই সমীক্ষার ফল বলছে, তাদের সিকিভাগ পুরুষ এক বা একাধিক নারীকে ধর্ষণ করেছে। এবং, যারা ধর্ষণ  করেছে, তাদের অর্ধেক পুরুষ মনে করে, আপন যৌনকামনা পূরণের জন্য একটি মেয়েকে ব্যবহার করার অধিকার তার ‘স্বত্বাধিকার’ বা ‘সেকশুয়াল এনটাইট্লমেন্ট’! পরিসংখ্যানগুলোর  বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় স্বাভাবিক। কিন্তু স্বত্বাধিকারের ধারণাটি তাৎপর্যপূর্ণ। এই ধারণার মর্ম বুঝতে পারলে ধর্ষণের প্রাদুর্ভাব এক ভিন্নমাত্রা পায়। যে পুরুষ মনে করে, নারীর ওপর তার যৌনস্বত্ব আছে, নারীকে সে প্রকৃতপক্ষে আপন সম্পত্তি হিসেবে  দেখে থাকে। নিজের সম্পত্তি ভোগ করার  সময় কেউ সম্পত্তির অনুমতি গ্রহণ করে না। অনুমতি  নেয়ার প্রয়োজনই যদি না থাকে, তবে ধর্ষণের কথা ওঠে কীভাবে? এই হলো গবেষণায় মতামত প্রধানকারী পুরুষদের সোজা যুক্তি। এই ধারণায় পিতৃতন্ত্রের উগ্র প্রকাশ স্পষ্ট।
জাতিসংঘ পরিচালিত এই সমীক্ষা হতে আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ হিসাব পাওয়া গেছে। অন্তত অর্ধেক ধর্ষণ হয়ে থাকে, যখন ছেলেটি প্রাপ্তবয়স্ক নয়, এমন অবস্থায়। এর একটি কারণ অনুমেয়। মেযেদের ওপর স্বত্বাধিকারের ধারণাটি পুরুষ তার বড় হওয়ার  সঙ্গে সঙ্গেই, বড় হওয়ার  প্রক্রিয়াতেই আত্মস্থ করে নেয়। অর্থাৎ সেই পুরুষ বড় হয়, নারীর ওপর নির্যাতন ও ভোগদখলকে একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে গণ্য করে, যা তাকে শিক্ষা দেয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোজাতব্যবস্থা।  পরবর্তী জীবনেও এই ধারণাই তাকে চালনা করে। বস্তুত, শিশুবয়স হতে পুরুষ এই ধারণা নিয়েই বড় হয় যে, বাড়ির  ছোট  ছোট দাবি-দাওয়া হতে শুরু করে বৃহৎ বিশ্বের যে কোনও কিছুতেই তার অধিকার প্রশ্নাতীত। সে শিখে নেয় যে,  কোনও কিছুর সাপেক্ষে পুরুষ নয়, বরং পুরুষের প্রয়োজন সাপেক্ষে সমস্ত নিয়ম ও আচরণবিধি। এবং পিতৃতন্ত্র মেয়েদেরও শিক্ষা দেয় যে, পুরুষ মুখ্য, নারী গৌণ। নারী প্রচলিত মূল্যবোধ ও সমাজব্যবস্থা থেকে জানতে পারে যে, তার  জীবন-যাপন পুরুষের সাপেক্ষে। পুরুষ যেমনটি চায়, তাকে সেই অনুসারেই জীবন ধারণ করতে হবে। সে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় যে, তার ওপর পুরুষের স্বত্বাধিকার আছে। আধিপত্যের ধারণা এইভাবেই নারীমনে প্রোথিত হয় এবং নির্যাতনের বিষয়টি অনেক নারীর কাছেও স্বাভাবিক ঘটনা বলেই চিহ্নিত ও প্রতীয়মান হয়। তারা এটাও ভাবতে পারে না যে, ধর্ষণ একপ্রকার যৌন অত্যাচার। বরং তারা  সেই সব অত্যাচার সহ্য করে পুরুষকে সুখী ও সন্তুষ্ট করার জন্য। এমন কি, বিশ্বের দেশে দেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা ও বিচারিকব্যবস্থাও এক রকম নয়। ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশ, বিচার ও অভিযুক্তের শাস্তিপ্রদানের হার বিভিন্ন বিচারব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিচার পরিসংখ্যান ব্যুরো’র  হিসাব অনুসারে সেদেশের ধর্ষিতদের মধ্যে ৯১% মহিলা ও ৯% পুরুষ এবং ৯৯% ক্ষেত্রেই অপরাধী পুরুষ। মহিলাদের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, যারা তাদের ওপর যৌন অত্যাচারের কথা স্বীকার করেন, তাদের মাত্র দুই শতাংশ বলেন যে তারা  কোনও  অপরিচিত ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষিত  হয়েছেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে কারাগারে পুরুষ কর্তৃক পুরুষের ধর্ষণ একটি গুরুতর সমস্যা। একাধিক গবেষণা থাকে জানা যায়, ‘পুরুষ-পুরুষ বন্দী ধর্ষণ’ ধর্ষণের সর্বাধিক পরিচিত একটি ধরন। অথচ এই ধর্ষণের সংবাদই সবচেয়ে কম প্রকাশ্যে আসে। কয়েকটি গবেষণা থেকে আরও জানা যায় যে, এই ধরনের ধর্ষণের সংখ্যা সাধারণ জনসংখ্যায় পুরুষ-নারী ধর্ষণের মাথাপিছু ও আনুমানিক সংখ্যার  চেয়েও বেশি। ধর্ষণ ও যৌন ক্রীতদাসত্ব বহুপরিচিত ও বহু-অনুশীলিত অভ্যাস হলেও এটি মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হয়। এছাড়াও ধর্ষণ গণহত্যা অপরাধের একটি উপাদান; বিশেষত যখন কোনও  জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণত বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নিয়ে ধর্ষণ সংঘটিত হয়। এখানে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পুরুষের বিকৃত কাম ও রাজনীতি ও সমাজের প্ররোচনা কাজ করে। যখন  পৌরুষে হিংস্রতা অন্তর্লীন হয়, তখন নারীর ওপর নির্বিচারে ধর্ষণ বা অন্য আক্রমণ হয়। তখন এই হিংস্রতার রূপ প্রকট হয়। অন্যান্য সময় তা হয়তো প্রকাশ পায় না।  কিন্তু সুপ্তভাবে পুরুষ-আধিপত্যের বিভিন্ন রূপের মধ্যে সেটা  নিহিত থাকে, যে আধিপত্যকে সতত স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেয়া হয়। বহু পুরুষের ‘যৌন স্বত্বাধিকার’-এর ধারণাটি এরই এক অঙ্গ। হিংস্রতাকে যখন সাদা চোখে  দেখা যায় না, তখন তা দ্বিগুণ বিপজ্জনক, কারণ না চিনলে তাকে  মেনে নেয়াই স্বাভাবিক, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সম্ভাবনা ক্ষীণ। পৌরুষের এই ধারণাকেই প্রশ্ন করা জরুরি। জরুরি তার পশ্চাদ্বর্তী সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন। পুরুষকে তার আধিপত্যের ও স্বত্বাধিকারের ধারণা হতে সরিয়ে এনে সমাজ যদি মেয়েদের সমানাধিকারকে যথার্থ মর্যাদা দিতে না পারে, তবে নারীর বিরুদ্ধে হিংসার উৎসমুখ বন্ধ হবে না। যদিও সামাজিক গবেষণা ও সমীক্ষার সংখ্যাগত নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সর্বদাই প্রশ্ন থাকে, কিন্তু সংকেতটি সুস্পষ্ট। জাতিসংঘ পরিচালিত জরিপ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার নারী ও পুরুষদের এই সতর্ক বার্তাই দিয়েছে। আর এখানেই সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে ইসলামে নারীর মর্যাদার বিষয়টি। যারা মুক্ত মনের মানুষ ও যুক্তিবাদী মানসিকতা পোষণ করেন, তারা ইসলামের সঙ্গে তথাকথিত আধুনিকতার তুলনা করলেই প্রকৃত - বাস্তব চিত্রটি বুঝতে পারবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads