একমাত্র হতভাগ্য বাবাই বলতে পারেন
বাবার কাঁধে পুত্রের লাশ কত ভারী। সেই সব হতভাগ্য বাবা-মায়ের শোকাহত অন্তরের প্রতি
গভীর সমবেদনা ও শোক-শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের লেখাটি তাদের উৎসর্গ করছি।
সবাই শঙ্কিত
দেশের মানুষের অকালমৃত্যুর জন্য; সেই সাথে সমাজের মানুষের অকালমৃত্যুর জন্য, আমার পরিবারের সদস্যদের অকালমৃত্যুর জন্য, সর্বোপরি আমার অনাগত দিনের জন্য।
আমরা আজ বড়ই শঙ্কিত। দেশে যে হারে অকালমৃত্যুর হার বেড়ে গেছে তা নিয়ে জানি না সমাজবিজ্ঞানীরা
কী ভাবছেন? রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজের সর্বেেত্র অবনতির কারণে
প্রকৃত সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সংখ্যা কি কমে গেছে?
চিরসত্য
মৃত্যুকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ইসলামে প্রতিদিন মৃত্যুকে স্মরণ করার জন্য বলা হয়েছে
পাপপ্রবণ মানুষের আত্মশুদ্ধির জন্য। যা হোক্, সংবাদপত্রে চোখ রাখতেই গা শিউরে
ওঠে! মানুষের নানাভাবে অকালমৃত্যুর খবর বর্তমান সময়ের নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন
বেশ কয়েকজন মানুষ মরছে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায়, রাজনৈতিক সহিংসতায়, পারিবারিক কলহে, প্রেম-পরকীয়ায়, চুরি-ছিনতাই, জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও সড়ক
দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। ১২ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকের সূত্রে প্রকাশ, দেশে গত দুই মাসে ৭৩১ জন মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ১১ মার্চ এক দিনেই
১০ জন বিভিন্ন কারণে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এক দিনে ১০ জন আর দুই মাসে ৭৩১ জন মানুষ
যদি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়, তাহলে গোটা বছরে অকালমৃত্যুর সংখ্যা যে কতটা ভয়াবহ
পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, তা আর বলার অপো রাখে না। তদুপরি সব মৃত্যুর খবর
হয়তো মিডিয়ায় আসে না। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায় বিভিন্ন শ্রেণীপেশার নানা
বয়সী মানুষ। তাই মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করতে কিভাবে অকালমৃত্যুর হার কমিয়ে
আনা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে এখনই। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! গত ১৭ মার্চ
কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দেশের মাটিতে পা রেখে ঘরে ফেরার আগেই ফটিকছড়ি উপজেলার
সুয়াবিল ইউনিয়নের প্রবাসী শফির পরিবারে নেমে আসে অকালমৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনা। চট্টগ্রাম
বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফেরার পথে একেবারে বাড়ির কাছাকাছি এসে মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডার
বিস্ফোরণ ঘটলে ঘটনাস্থলে চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। এই দিন নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর
গেট এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের সেপটিক ট্যাংক থেকে দু’জনের লাশ পাওয়া যায়। অনাকাক্সিত এসব মৃত্যু বড়ই নির্মম ও বেদনাবিধুর। মাইক্রোবাসে
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় আতঙ্কিত নগরবাসী; কেননা চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলরত
যানবাহনের ৪০ হাজারের বেশি সিএনজির গ্যাস সিলিন্ডার মেয়াদোত্তীর্ণ। বড় দুর্ঘটনা ঘটলেই
কেবল আমরা তৎপর হই। দুর্ঘটনার আগে সচেতন থাকলে জানমালের তি অনেক কমানো সম্ভব। তাই দলমত
নির্বিশেষে অকালমৃত্যুরোধে আমাদের অবশ্যই এক হতে হবে।
তা না
হলে একের পর এক দুর্ঘটনা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে পিছিয়ে দেবে। ১১ মার্চ চট্টগ্রামের
সংবাদপত্রগুলোতে যখন চোখ রাখি, ত্রিভুজ প্রেমের বলি ইউসুফ নবীর অকাল মর্মান্তিক
মৃত্যুর ঘটনা পড়ে চোখের পানি মুছতে না মুছতে এক সাংবাদিক বন্ধু ফোন করে জানাল, আপনার পাশে নাকি ট্রেন-মিনিবাসের সংঘর্ষে অনেক মানুষ মারা গেছে, জানেন নাকি? এমন মর্মান্তিক প্রশ্নবোধক ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে
দেখি হাজার হাজার মানুষের ভিড়। সবার চোখেমুখে বিষাদের ছাপ। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ
হাসপাতালে লাশঘরের সামনে গিয়ে জানতে পারি চারজনের করুণ মৃত্যুর কথা। লাশঘরের সামনে
যেন আর্তনাদের জনসমুদ্র। পাঁচ বছরের জেরিনের আর্তচিৎকার। মা-মা, কথা বলো, মা কথা বলো। মা কথা বলছ না কেন, মা-মা-মা করে যখন জেরিন কাঁদছে, তখন সবার চোখে পানি আর পানি। যে দেহের ওপর জেরিন উঠে খেলত, হাসত সেই দেহ আজ রক্তাক্ত। নিথর মায়ের শরীরে হাত রেখে অবুঝ শিশুটি কাঁদছে, মায়ের কী হলো? মা ইয়াছমীন কেন কথা বলছে না? পাশে ইয়াছমীনের বাবা বুক চাপড়িয়ে কাঁদছেন, নানা-নাতনীর বুকফাটা কান্নায়
নির্বাক ও ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। একটু আগে যারা প্রাণচঞ্চল ছিল, তারাই এখন প্রাণহীন দেহ। ১১ মার্চ নগরীর বাহির সিগন্যালে লেভেল ক্রসিংয়ে আটকে পড়া মিনিবাসের ওপর ট্রেনের ধাক্কায় যে চারজন
মারা যায়, তাদের মধ্যে ইয়াছমীন (২৫) একজন। বাড়ি কক্সবাজার জেলার মহেশখালী
উপজেলায়। স্বামীর সংসার হারিয়ে নিঃস্ব ইয়াছমীন মেয়ে জেরিনের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে
শহরে ফুফাতো বোনের হাত ধরে কয়েক মাস আগে বেইজ গার্মেন্টে কাজ নিয়েছিলেন। জেরিন নানা-নানীর
সাথেই থাকত। গার্মেন্ট চাকরির ছুটি নেই, তাই মেয়েকে দেখতে খুব ইচ্ছে করেছিল
মায়ের।
ইয়াছমীনের
ইচ্ছায় মেয়ে জেরিনকে নিয়ে নানা-নানী শহরে এসেছিলেন চার দিন আগে। কে জানত ১১ মার্চই
জীবনের শেষ দেখা হবে? মেয়ে ইয়াছমীন বাবার কাছে বাজারের জন্য ৩০০ টাকা
দিয়ে তাড়াহুড়া করে জেরিনকে শেষবারের মতো আদর করে বের হলেন, আর ঘরে ফেরা হলো না। বাবা নুরুল আলম মেয়েকে হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। স্বজনদের
কান্নায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। যেন গাছপালা পর্যন্ত
শোকাহত। চট্টগ্রামে গার্মেন্ট কর্মীদের অকালমৃত্যুর সবচেয়ে মর্মান্তিক এ ঘটনা চট্টগ্রামবাসীকে
শোকাহত করে তুলেছে। জানা যায়, চালক দিদারুল আলমের (২৪) কানে হেড ফোন থাকায় রেলের
বিকট হর্ন তার কানে আসেনি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রেন এসে মিনিবাসে ধাক্কা মারে। মুহূর্তেই
চারজনের মৃত্যু এবং ২০ জনের অধিক আহত হন। লাশঘরের সামনে শোকার্ত মানুষের ভিড়ে ছুটে
আসেন নিহত অপর তিনজনের আত্মীয়স্বজনেরাও। আজাদ-রিয়ার ভালোবাসার সংসার ছারখার হয়ে গেছে।
স্বামী আজাদের বেকারত্বের অভাব ঘোচাতে স্ত্রী রিয়ার গার্মেন্টে চাকরি জীবনে অশুভ মুহূর্তে
জীবনটাই শেষ হয়ে গেল রিয়ার। বর্তমানে স্বামী আজাদ সচ্ছল। তাই রিয়ার আর চাকরির প্রয়োজন
নেই। বেতন পেলেই সেদিন চাকরি ছেড়ে দেবেন রিয়া। বেতন নিতে গিয়েই এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায়
না ফেরার দেশে চলে গেলেন। রিয়ার জন্য আর্তনাদরত আজাদ জানান, যার কারণে এতগুলো মানুষের অকালমৃত্যু হয়েছে, তার বিচার কি এদেশ করবে? আর কত মৃত্যু হলে অকালমৃত্যু বন্ধ হবে? নিরাপদ সড়ক আমাদের সবার কাম্য।
তার পরও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সড়কপথে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছেই। অথচ সামান্য সচেতন
হলেও অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম
মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশ থাকলেও সড়ক নিরাপদ রাখতে তাদের ভূমিকা চোখে পড়ে না। চোখে ঘুম
নিয়ে গাড়ি চালানো, মোবাইলে কথা বলার অভিযোগের পর এবার হেডফোনে ড্রাইভারের গান শোনার
ঘটনা যোগ হয়েছে। একের পর এক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি ও আইনের শাসনপ্রতিষ্ঠার
মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সব সড়ক পথকে নিরাপদ করতে এখনই উদ্যোগ না নিলে সরকারকে জবাবদিহি
করতে হবে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার
আরাকান সড়কের ৫৫টি বাঁক মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে আছে দীর্ঘ দিন, অথচ সরানোর কোনো উদ্যোগ নেই। দেশের পর্যটন খাতের বিকাশে অচিরেই বিশেষ করে এই
সড়কপথকে নিরাপদ সড়কে পরিণতি করতে হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করে
ওয়ান ওয়ে হিসাবে জানমালের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। নারীর মতায়ন ও আর্থিক স্বাবলম্বী
হওয়ার পেছনে পোশাক শিল্পের অবদান অনেক বড়। এ শিল্পের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অর্ধ কোটি
শ্রমশক্তির ৩৫ লাখই নারী। তাদের জীবনের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন, প্রশিণের মাধ্যমে নারীর মতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। আর নয় অকালমৃত্যুর
মিছিল। এটাই আজকের বাংলাদেশের প্রত্যাশা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন