গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ১১৪টি উপজেলায়
অনুষ্ঠিত হলো দ্বিতীয় দফা উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এর আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম দফায়
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৯৭টি উপজেলায়। প্রথম দফা নির্বাচনে দখলবাজি কতটুকু চলেছে, তা নিয়ে নির্বাচনের পরের ক’দিন গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা
চলেছে বিস্তর। এসব আলোচনা-সমালোচনা থেকে এটি স্পষ্ট, ওই প্রথম দফার নির্বাচনে তুলনামূলকভাবে
অনিয়ম কিছুটা কম চললেও তা কোনো মতেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ছিল না। যদিও
মুখ রক্ষার জন্য সরকারি দলের নেতারা বলছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলেই সরকারি দলের প্রার্থীরা হারছেন, আর বিএনপি ও জামায়াত প্রার্থীরা জয় লাভ করছেন; কিন্তু দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভোটকেন্দ্র
দখল ও ব্যালটবাক্সে সিল মারার মচ্ছব যেন আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারি দলের পত্রপত্রিকায়
যেসব অনিয়মের খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে এর যথার্থ প্রমাণ মেলে।
দ্বিতীয়
দফার উপজেলা নির্বাচন নিয়ে নির্বাচনের পরদিন ‘দখল উৎসব’ শিরোনামের এক রিপোর্টে দৈনিক মানবজমিন লিখেছে ‘ভিন্ন চেহারার ভোট দেখল দেশবাসী; কিন্তু দখল, ব্যালটবাক্স ছিনতাই ও জালভোটের রীতিমতো উৎসব হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার
সদস্যদের চোখের সামনেই সরকারদলীয় কর্মীদের হামলায় রক্তাক্ত হয়েছেন বিরোধী প্রার্থী।
আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের কর্মীদের হামলায় আহত হয়েছেন পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার
সদস্যরাও। লাঞ্ছিত করা হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত
কর্মকর্তাদের। ভোটকেন্দ্রে হামলা হয়েছে এবং ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া হয়েছে বিভিন্ন
স্থানে। কেন্দ্র দখল ও হামলার প্রতিবাদে দুপুরের মধ্যেই অন্তত এক ডজন উপজেলা বিএনপি
সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায়
নোয়াখালী সদর উপজেলার নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। গোলযোগের কারণে বিভিন্ন উপজেলায় নির্বাচন
স্থগিত করা হয় ৪৩টি কেন্দ্রে। দিনভর বিক্ষিপ্ত নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে নির্বাচন শেষ হয়
১১৪টি উপজেলায়।’
একই দিনে
দৈনিক কালের কণ্ঠ প্রথম পৃষ্ঠায় দু’টি ছবি ছাপে। একটির ক্যাপশন :
‘যশোরের চৌগাছায় বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী জহুরুল ইসলামের
ওপর আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকদের হামলা।’ এ হামলার শিকার ওই চেয়ারম্যান
পদপ্রার্থীর রক্তাক্ত ছবি ওই দিন আরো বেশ কয়েকটি দৈনিকে ছাপা হয়। দৈনিক কালের কণ্ঠে
প্রকাশিত অপর ছবির ক্যাপশন : ‘মুন্সীগঞ্জ সদরে কেওয়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
কেন্দ্রের এই মহিলা বুথে কোনো নারী ভোটার নেই। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর কয়েকজন
কর্মীর অবাধে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ঢোকানোর দৃশ্য গতকাল দুপুরের।’ এই পত্রিকাটি ‘মুন্সীগঞ্জে সিল মারার মচ্ছব!’ শিরোনামে নির্বাচনের একটি সরেজমিন প্রতিবেদন ছাপে। এই সুদীর্ঘ প্রতিবেদনের
শুরুটা এরূপ : ‘সকাল ১০টা। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার কেওয়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
ভোটকেন্দ্র। কেন্দ্রের ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, মাঠের এক কোণে তিন পুলিশ সদস্য
বসে খোশগল্প করছেন। ভোটারদের কোনো লাইন নেই। কেন্দ্রে ছয়টি বুথ। একটি বুথের সামনে ছয়
যুবকের জটলা। কাছে গিয়ে দেখা গেল, একটি টেবিলের ওপর ছড়ানো ব্যালটপেপারে ওদের চারজন
মনোযোগ সহকারে সিল মারছে, মুখে সিগারেট। অন্য দু’জন ব্যালট ভাঁজ করে ব্যালটবাক্সে ঢোকাচ্ছে। বাকি বুথগুলোর (দু’টি নারী বুথসহ) প্রতিটির সামনেও পাঁচ-ছয়জন করে যুবককে দেখা গেল একই কর্ম করে
যাচ্ছে। জানা গেল, এই যুবকদের সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আনিসুজ্জামান
আনিসের কর্মী। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পুলিং এজেন্টরা তাদের পাশে বসে আছেন। ওই
সময় কালের কণ্ঠের ফটোসাংবাদিক শেখ হাসান যুবকদের ছবি তোলেন। তখনো যুবকেরা নির্বিকার।
এরপর হাসান যখন বেরিয়ে আসছিলেন, তখন যুবকেরা তাকে ও তার সাথে থাকা এই প্রতিবেদকের
পথ আটকায়। ছবি ডিলিট করার জন্য বারবার চাপ দেয়। একজন নিজেকে পুলিং এজেন্ট দাবি করে
হুমকি দেয় ‘দেখি তোমরা ছবি ডিলিট করা ছাড়া ভোটকেন্দ্রের বাইরে
যাও কিভাবে?’ এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয় কালের
কণ্ঠের এই দুই সাংবাদিককে। এরই মধ্যে কেন্দ্রে একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেট আসেন। তিনি
নারী বুথে পুরুষ দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। সাথে সাথে পুলিশ ডাকেন; কিন্তু তখনো পুলিশ সদস্যদের গা-ছাড়া ভাব। এরা বুথে প্রবেশের আগেই যুবকেরা সটকে
পড়ে। ওই ম্যাজিস্ট্রেট ভোটকেন্দ্রের এই পরিস্থিতির কারণ জানতে চাইলে প্রিজাইডিং অফিসার
সাঈদ মোস্তফা হাসান খান বলেন, ‘ম্যাডাম, আমি কী বলব? আপনি নিজেই তো স্বচক্ষে দেখলেন। আমার কিছুই করার নেই।’
পরদিন
দেশবাসী জানল মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীই
জয়ী হয়েছেন। এ ঘটনার রেফারেন্স টানলে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা হয়তো বলবেন ‘এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, শুধু মুন্সীগঞ্জেই নয়, সারা দেশের বহু উপজেলায় এ ধরনের দখল উৎসবের মধ্যেই
অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় দফার উপজেলা নির্বাচন। সরকারি দল আওয়ামী লীগের নীতি-সমর্থক গণমাধ্যমে
ছিটেফোঁটা যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা এর জায়মান প্রমাণ। তার পরও
সরকার ও সিইসির নির্লজ্জ উচ্চারণ ‘উপজেলা নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হচ্ছে।’
কিন্তু
জনগণ কি তা মনে করে? নিশ্চয়ই না। কারণ দেশবাসী এরই মধ্যে গণমাধ্যমের
সুবাদে জেনে গেছে, ১৩টি উপজেলায় অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে জানা
গেছে দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে অন্তত ১৩টি উপজেলায় ভোট বর্জন
ও পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। এসব উপজেলায় বিএনপি সমর্থিত
প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করে কেন্দ্র দখল, জাল ভোট দেয়া ও ভোটারদের কেন্দ্রে
যেতে বাধা দেয়ার অভিযোগ আনেন। এসব স্থানে বড় ব্যবধানে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত
প্রার্থীরা। এসব উপজেলায় সরকারি দলের প্রার্থীদের পক্ষে অস্বাভাবিক মাত্রায় ভোট পড়েছে।
ফরিদগঞ্জে ভুতুড়ে ভোট পড়েছে। এক কেন্দ্রে রেকর্ড কাস্টিং ১২৭.৪৩ শতাংশ ভোটের ফলাফল
ঘোষণার পর এ নিয়ে আলোচনার ঝড়।
ক’জন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও ব্যক্তিবর্গ নির্বাচন বিষয়ে কাজ করছেন, তাদের অভিমত নির্বাচনের মান ক্রমেই নিচের দিকে নেমে আসছে। ইচ্ছেমতো
সিল মেরে ব্যালটবাক্স ভর্তি করার সেই পুরনো দিন ফিরে এসেছে। এমনটি উল্লেখ করে গত ১
মার্চ ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম : ‘এক্সপার্ট সে ডিকাইন ইন কোয়ালিটি অব ইলেকশনস, কালচার অব ব্যালট স্টাফিং রিভাইভস, দে সে’। এতে বলা হয়, উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনের
ওপর পর্যালোচনা শেষে বলেছেন ভোটকেন্দ্র দখল এবং ইচ্ছেমতো সিল মেরে ব্যালটবাক্স
ভর্তি করার পুরনো দিন আবারো ফিরে এসেছে। তারা বলেছেন, প্রথম দফার নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হলেও দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনের মানের
অবনতি ঘটেছে। অনিয়ম ঠেকাতে নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপের অভাব দেখা গেছে। ছিল প্রশাসনের
নিষ্ক্রিয়তা। আর এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে অতিরিক্ত মাত্রায় রাজনীতিকায়ন করা হয়েছে, একতরফা একদলীয় একটি সংসদীয় নির্বাচনের পর। তাদের অভিমত, আওয়ামী লীগ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল প্রথম দফা নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের অবাক করা
সাফল্যের পর দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে যথাসম্ভব সর্বাধিকসংখ্যক উপজেলায় বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা, সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রি. এম সাখাওয়াত হোসেন ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের
লোকপ্রশাসনের সাবেক অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ এ ধরনের অভিমত প্রকাশ করে বলেছেন, নির্বাচনে মানের এই অবনতির দায়দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে এবং এ ধরনের অনিয়ম
ঠেকাতে নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর সক্রিয় হতে হবে।
আসলে ১৯
ফেব্রুয়ারির প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনে কিছু অনিয়ম ঘটলেও তা ছিল অনেকটা গা-সহা। কারণ
দেশের মানুষ ধরে নিয়েছেন অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিবেশে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায়
না, যেখানে ক্ষমতায় রাজনৈতিকভাবে চরম অসহিষ্ণু দল আওয়ামী লীগ; কিন্তু সে নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী সাফল্য দেখে অনেকটা
হতাশ হয়ে পড়ে শাসক দল আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে প্রথম দফা নির্বাচনের পর এবং দ্বিতীয় দফা
নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী এলাকা পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে
সরকারদলীয় প্রার্থী বিএনপিদলীয় প্রার্থীর কাছে পরাজিত হলে তাদের এই বিচলিত হওয়ার মাত্রা
আরো শত গুণ বেড়ে যায়। বস্তুত এরই জেরে বিষয়টি নিয়ে বিচলিত হয় আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক
মহল। বিএনপি-জামায়াতকে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না, এমন বার্তাটিই কার্যত নীতিনির্ধারক
মহল থেকে পৌঁছানো হয় তৃণমূলপর্যায়ে। এরই জেরে ২৭ ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে
৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের মতো ১১৪টি উপজেলার কোথাও না কোথাও গায়েবি ভোট পড়ে। গণমাধ্যমের
রিপোর্টে আসে অন্তত ১৩টি উপজেলায় অস্বাভাবিক হারে ভোট পড়েছে। কমপক্ষে ১০টি উপজেলায়
বিএনপি প্রার্থীরা ভোটের দিন দুপুরের আগেই ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। উপজেলা নির্বাচনে
সব ক’টিতে বিএনপি-জামায়াত প্রার্থীরা জয়ী হলেও রাষ্ট্রক্ষমতায় কোনো
পরিবর্তন আসত না। এর পরও এ নির্বাচনে যে দখলের উৎসব চলেছে তা থেকে অনুমেয়, ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে কেমনটি ঘটত। আজকের উপজেলা নির্বাচন
পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে, আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় বেগম জিয়ার সিদ্ধান্ত শতভাগ সঠিক ছিল।
দ্বিতীয়
দফা উপজেলা নির্বাচনে সরকারি দলের কেন্দ্র দখল, ভোট ডাকাতি, ইচ্ছেমতো সিল মেরে ব্যালটবাক্স ভর্তি করা, ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা
দেয়া, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, প্রার্থীদের মারধর করা, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অনিয়মে সহায়তা করতে বাধ্য
করাসহ নানাধর্মী অনিয়মের মধ্যেও বলা যায় প্রথম দফার মতোই দ্বিতীয় দফার নির্বাচনেও বিএনপি-জামায়াত
তাদের নির্বাচনী সাফল্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বিএনপি ৫১টি, আওয়ামী লীগ ৪৫টি ও জামায়াতে ইসলামী আটটি উপজেলায় জয়ী হয়। জাতীয় পার্টি পেয়েছে
একটি চেয়ারম্যান পদ। সাধারণ মানুষ মনে করে, এবারের উপজেলা নির্বাচনে শাসক
দলের দখল উৎসব না চললে আওয়ামী লীগ ১০ শতাংশ আসনেও বিজয়ী হতে পারত কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ জাগে।
এ পর্যন্ত
২০৮টি উপজেলার নির্বাচনী ফলাফল মতে, চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ জয়ী
হয়েছে ৭৮টি উপজেলায়। ২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল ১৪৭টিতে। অর্থাৎ চেয়ারম্যান
পদে আওয়ামী লীগের আসন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। অপর দিকে বিএনপি এ পর্যন্ত পেয়েছে
৯৩টি চেয়ারম্যান পদ, ২০০৯ সালে তা ছিল মাত্র ৩৪টি। অর্থাৎ চেয়ারম্যান
পদে বিএনপি আগের তুলনায় প্রায় তিনগুণ আসনে বিজয়ী হয়েছে। একইভাবে চেয়ারম্যান পদে ২০০৯
সালে জামায়াত জয় পেয়েছিল ১৩টি উপজেলায়। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০টিতে। একইভাবে এবার
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান পদে জয়ের সংখ্যা আগের চারটি থেকে নেমে এসেছে দু’টিতে। এবার ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিএনপি বিজয়ী ১৬১টিতে, আওয়ামী লীগ ১৪৭টিতে, জামায়াতে ইসলামী ৬৬টিতে। ডেইলি স্টারে প্রকাশিত
পরিসংখ্যান মতে, ২৭ ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে সাধারণ ভাইস চেয়ারম্যান
পদে জামায়াত বিজয়ী ৩২টিতে, বিএনপি বিজয়ী ৩২টিতে এবং আওয়ামী লীগ বিজয়ী ৩০টিতে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো যেসব বামপন্থী বর্তমান সরকারি জোটে আছেন এবং আগের পাঁচ বছরেও
মহাজোটে ছিলেন, সেসব দলের অনেকেই এখন অটো এমপি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
কৃপায় মন্ত্রী। এসব মন্ত্রী-এমপি বেগম জিয়াকে সকাল-বিকেল একবার করে পাকিস্তানে পাঠান, তাকে জনবিচ্ছিন্ন নেত্রী, স্বাধীনতাবিরোধী ইত্যাদি নানা ধরনের অভিধায় আখ্যায়িত
করেন। তাদের দলের একজনকেও কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে বিজয়ী হতে দেখা যায়নি। এই হচ্ছে
তাদের জনসংশ্লিষ্টতার কিংবা জনপ্রিয়তার মাত্রা।
প্রথম
দুই দফা উপজেলা নির্বাচনে সরকারি দলের নেতানেত্রীদের কাছে একটি সুস্পষ্ট বার্তা জনগণ
দিয়েছে তৃণমূলের ম্যান্ডেটে বিএনপি এগিয়ে। অথচ আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা
বলছেন, বেগম জিয়ার সাথে জনগণ নেই; কিন্তু দলটির নেতৃত্বে ১৯ দলীয়
জোট সমর্থিত চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপের
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ব্যবধান কমাতে পারলেও দখল ও ভোট জালিয়াতির কলঙ্কতিলক পড়েছে তাদের
কপালে। ফলে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যেমনটি ঘটেছে ৫ জানুয়ারির
ভোটারবিহীন ও প্রার্থীবিহীন একতরফা নির্বাচনের বেলায়ও। তা ছাড়া এ নির্বাচন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ
বার্তাও আওয়ামী লীগ ও এর মিত্রদের দিয়েছে। বার্তাটি হচ্ছে সরকার যেভাবে চলছে, তা জনগণের পছন্দ নয়। বিএনপি-জামায়াতবিরোধী যেসব
প্রচার-অপপ্রচার ও বিষোদগার সরকারি দলের নেতারা সকাল-বিকেল করেন তার সবটুকু দেশের মানুষ
মেনে নিচ্ছে না। বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন ও নির্যাতন-নিপীড়ন তাদের পছন্দ নয়। সর্বোপরি
৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন করে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার সরকারদলীয় আস্ফালনকেও
দেশের মানুষ মেনে নিতে পারছে না। তারা চায় যত দ্রুত সম্ভব নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি
অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সংসদ নির্বাচন।
সেই সাথে চায় অবশিষ্ট দফায় উপজেলা নির্বাচনগুলোও হোক অবাধ ও সুষ্ঠু। এসব বার্তার প্রতি
সরকারি দলের নেতা-নেত্রীরা কতটুকু গুরুত্ব দেবেন, সেটাই এখন প্রশ্ন।
গোলাপ মুনীর
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন