মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০১৪

সব লাশের দায় সরকারের উপরই বর্তায়


দেশে যেন লাশের মিছিল শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নাম পরিচয়হীন মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। লাশ পড়ে থাকছে সড়ক -মহাসড়কের পাশে, সেতু বা ব্রিজের নিচে, ক্ষেতের আলে, নদীর তীরে এবং বনে-জঙ্গলে। কখনো আবার বাসা-বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকেও উদ্ধার করা হচ্ছে লাশ। গতকালের সংবাদপত্রেও ডজনখানেক লাশ উদ্ধারের খবর প্রকাশিত হয়েছে। নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার পশ্চিম দেলিয়ার গ্রামের খাল ও পুকুর থেকে হাত-পা বাঁধা দুই যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। চট্টগ্রামের একটি সেপটিক ট্যাঙ্কে পাওয়া গেছে দু’জন কলেজছাত্রের লাশ। ওদিকে হাতিয়ায় মেঘনা নদীতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেছে বেশ কয়েকটি লাশ। কারো কারো মতে, এসবের সংখ্যা অন্তত ২০। বামপন্থী একটি রাজনৈতিক দলের এক নেতা জানিয়েছেন, তিনি নিজে কয়েকটি লাশের ছবি তুলেছেন। পুলিশের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে নিহত কয়েকজনের নাম-পরিচয়ও জানানো হয়েছে। দেখা গেছে, নিহতদের অধিকাংশই বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী দলের কিংবা তাদের ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী। এদের সবাইকে বিভিন্ন সময়ে গুম করা হয়েছিল। তারপর আর তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত লাশ হয়ে এসেছে তারা। সবচেয়ে বেশি রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে মেঘনার বুকে পাওয়া লাশগুলোকে ঘিরে। সাধারণ মানুষের মুখে অনেক কথাই শোনা যাচ্ছে। তাদের অনুমান, গুম করা কর্মীদের নিষ্ঠুর নির্যাতন করে প্রথমে মেরে ফেলা হচ্ছে। তারপর হেলিকপ্টারে করে এনে ফেলে দেয়া হচ্ছে মেঘনার বুকে। সাধারণ মানুষের এই অনুমান সত্য হলে হত্যার জন্য কারা দায়ী, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বরং ভয়ে-আতঙ্কে শিউরে উঠতে হয়। মানুষ এরই মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছেও। একই কারণে লাশের বিষয়টি গতকাল জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রধান শিরোনাম হয়েছে।
লাশের এই মিছিলের খবরে সকলের সাথে আমরাও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। উদ্বেগের আরও কারণ হলো, সাধারণ মানুষের আলোচনায় শুধু নয়, অনুসন্ধানেও এগুলো রাজনৈতিক হত্যাকা- হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এর কারণ বর্তমান সরকারের আমলে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার ও বন্দুকযুদ্ধ ধরনের নানা নামের আড়ালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- অনেক আগেই কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো এসব হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছে। দল দু’টির নেতারা অনেক উপলক্ষেই অভিযোগ করেছেন, সরকার বেছে বেছে বিএনপি ও জামায়াতের সেইসব নেতা-কর্মীকে হত্যা করছে, নিকট অতীতে যারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন এবং আগামীতেও যাদের নেতৃত্ব দেয়ার সম্ভাবনা ছিল। এভাবে রাজনৈতিক দলগুলো শুধু নয়, সাধারণ মানুষও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে কোনো দল বা মহলের প্রতিবাদেই কান দিচ্ছে না সরকার। এজন্যই একের পর এক লাশ পাওয়া যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে র‌্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলে বেড়াচ্ছে, নিহত যুবকরা নাকি পুলিশের গ্রেফতার চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে গিয়ে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে! উল্লেখ্য, দেশের ভেতরে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন, দেশের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থাও তেমনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়ে চলেছে। কিন্তু কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না হত্যাকা-। বরং দিন দিন লাশের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, জনগণ ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করায় ক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষমতাসীনরা গুপ্তহত্যার ভয়ঙ্কর পন্থা বেছে নিয়েছেন। প্রতিটি হত্যাকা-ের পর্যালোচনায়ও এ সত্যই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। দেশের এমন কোনো এলাকার কথা বলা যাবে না, যেখানে বিএনপি-জামায়াত এবং দল দু’টির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা গুপ্তহত্যার শিকার না হচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, প্রতিটি হত্যাকা-ের পরই পুলিশ ও র‌্যাব-এর পক্ষ থেকে একই ভাষায় জানানো হচ্ছে, আসামী ধরতে গিয়ে প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল বলেই তারা নাকি ‘বাধ্য হয়ে’ গুলী ছুঁড়েছে এবং এতেই মৃত্যু ঘটেছে ওই নেতা-কর্মীদের! বলাবাহুল্য, এই কাহিনী সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না।
দ্রুত বেড়ে চলা গুম ও খুনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি, সভ্যতা, গণতন্ত্র কিংবা আইনের কোনো ব্যাখ্যাতেই এইভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চলতে পারে না। এ বিষয়টি এখন পরিষ্কার যে, সরকার পুলিশ ও র‌্যাবকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হত্যার কাজে ব্যবহার করছে। সুতরাং সরকারের জন্য দায় এড়ানোর সুযোগ কমই কম। সরকারের উচিত, যত বড় সন্ত্রাসী, খুনি বা অপরাধীই হোক না কেন, তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করা এবং আইনানুযায়ী বিচারের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। আমরা আশা করি, বিচারবহির্ভূত হত্যার ভয়ঙ্কর পথ ছেড়ে সরকার অনতিবিলম্বে আইনসম্মত পথে পা বাড়াবে এবং জনগণকে আর নাম-পরিচয়হীন ও হাত-পা বাঁধা লাশের মিছিল দেখতে হবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads