ব্লেমগেম, কৌশল আর চাতুর্য যখন কোনো দেশের রাজনীতিতে প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে, তখন দেশটির সঙ্কট বাড়তে থাকে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এমন বাস্তবতায়ই এখন আমাদের বসবাস। ভুল-ত্রুটি কিংবা পদস্খলন জীবনে কিংবা সংগঠনে কোনো নতুন বিষয় নয়। যারা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ভুল-ত্রুটি ও পদস্খলন সংশোধনের চেষ্টা করেন তারা বেঁচে যান। আর যারা এর পরিবর্তে ব্লেমগেম, কৌশল আর চাতুর্যের মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনে ব্যস্ত থাকেন, তাদের পরিণাম হয় মন্দ। প্রসঙ্গত, এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, যারা অপরের ত্রুটি ও পদস্খলনের নিন্দাবাদে জড়িয়ে যান এবং নিজের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে না তাকায়, তাদের পরিণামও খুব একটা ভালো হয় না। এমন মানসিকতার নেতা-কর্মীরা দেশ ও জাতির তেমন কোনো কল্যাণসাধন করতে পারেন না। যে বিষয়টি উল্লেখ করার আগে এই ভূমিকাটি লিখলাম, এবার সে বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই। ২৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় : ছাত্রলীগের খুলনা মহানগর ও উপজেলা কমিটির অন্তত ১১ জন শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ উঠেছে সংগঠনের ভেতর থেকেই। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন আরও নেতা-কর্মী। শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি ছাত্রলীগের মূলনীতি। কিন্তু খুলনা মহানগর, জেলা ও উপজেলার ছাত্রলীগের নেতাদের নামের সঙ্গে এখন আলোচিত হয় মাদক ব্যবসা, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, লুট এই কটি শব্দ। কেবল পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, ছাত্রলীগের বিবদমান নেতারাই পরস্পরের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুলছেন, সংবাদ সম্মেলনও করছেন। সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুলনা আওয়ামী লীগের নেতাদের দ্বন্দ্বের কারণে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও নানা দল-উপদলে বিভক্ত। ফলে সংগঠনে কোনো শৃঙ্খলা নেই। কেউ কারো কথা শুনছেন না। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উপদলীয় সংঘর্ষ হচ্ছে। গত শনিবারও মাদক ব্যবসা ও কলেজের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই খুলনা আজম খান সরকারি কমার্স কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে।
আমরা জানি, যে কোনো দেশের ছাত্রসমাজ দেশের ভবিষ্যৎ হিসেবেই বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্রসমাজের রয়েছে উজ্জ্বল ভূমিকা। কিন্তু বর্তমান সময়ে ছাত্ররীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা যেসব অনাকাক্সিক্ষত কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন, তা জাতির জন্য এক অশনিসঙ্কেত। এ বিষয় নিয়ে ছাত্রলীগ ও তাদের অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগকে অনেক গালমন্দ করা যায়, কিন্তু তাতে লাভ কী? মাদক ব্যবসা, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, লুট, গুম ও হত্যাকা-ের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে ছাত্রলীগের বাইরেও আরও বহু ছাত্র ও যুবক জড়িয়ে পড়েছে। তাই বিষয়টিকে সঙ্কীর্ণ স্বার্থ ও দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করা এখন সময়ের দাবি। আমাদের সম্ভাবনাময় ছাত্রসমাজ আজ কেন চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও মাদক ব্যবসার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে? এরা তো সমাজের বাইরে থেকে এসে এসব অপরাধে জড়ায়নি। এরা এমন সমাজে বসবাস করছে, যেখানে রাজনৈতিক অভিভাবকরা আছেন, বড় ভাইয়েরা আছেন, আছে আইন-আদালত, পুলিশ-প্রশাসন, শিক্ষাঙ্গন এবং সরকার। এতকিছু থাকার পরও ছাত্র-যুবসমাজ কি করে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে? তাহলে আমাদের পুরো সমাজ কাঠামোই কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে? অসুস্থ সমাজকে সুস্থ করার জন্যই তো প্রয়োজন হয় রাজনীতি, প্রয়োজন হয় সরকার গঠনের। দেশের বর্তমান বাস্তবতায় এ বিষয়টি বেশ স্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করা যায় যে, আমাদের রাজনীতি সঠিক পথে চলছে না। অনেকেই বলছেন, আমাদের রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নের কবলে পতিত হয়েছে। যে রাজনীতি ক্ষমতার মোহে আবর্তিত হয়ে দুর্বৃত্তায়নের কবলে পতিত হয়, সে রাজনীতি তো দেশ ও জনগণকে ভালো কিছু উপহার দেয়ার সামর্থ্য হারায়। খুলনায় মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা যেন আমাদের ভুল রাজনীতির একটি বড় উদাহরণ।
আমাদের ছাত্রসমাজ ও সম্ভাবনাময় যুবসমাজকে সঠিক পথে পরিচালনা করা ছাড়া জাতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে না। এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের জন্য সরকার গঠিত হয়, সরকারের বাইরে অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীদেরও অবদান রাখার কথা। কিন্তু অর্থবহ অবদান রাখতে হলে তো দায়িত্বশীলদের যোগ্যতা থাকতে হয়, থাকতে হয় শপথ ও অঙ্গীকারের প্রতি আন্তরিকতা। এসব বিষয়ে আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদদের এখন আত্মসমালোচনা খুবই জরুরি বিষয় হয়ে উঠেছে। কারণ আত্মসমালোচনার মাধ্যমেই দায়িত্ববানরা তাদের ভুল-ত্রুটি ও সম্ভাবনার বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারেন। আমরা জানি যে, যথার্থ উপলব্ধি ছাড়া সঠিক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই এই মুহূর্তে প্রয়োজন জাতীয় স্বার্থে ব্লেমগেম ও চাতুর্যের পথ পরিহার করে নৈতিক চেতনায় আদর্শের রাজনীতির পথে ফিরে আসা। আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা বিষয়টি উপলব্ধি করেন কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন