রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৪

দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চলছে


আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হত্যা, গুম উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ এখন আতঙ্কিত জনপদ। এছাড়া এভাবে এ সরকারের আমলে বিএনপির ১৫৩ জনকে গুম করা হয়েছে। তাদের কোন সন্ধান অদ্যাবধি মেলেনি। দেশে প্রতিদিন একজন করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে জানুয়ারি মাসে দেশে ৩৯টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটেছে। এর মধ্যে ক্রসফায়ারে ২০ জন, গুলীতে ১৮ জন ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে অন্তত একজনকে। এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, যৌথবাহিনী জড়িত। ক্রসফায়ারে ২০ জন নিহত হয়েছে আর পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে এসব ব্যক্তি বন্দুক যুদ্ধে মারা গেছে।  একই সময় রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ৫৩ জন নিহত ও একই সময়ে ৪৭২ জন আহত হয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া একই সময়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী  বিএসএফের হাতে একজন বাংলাাদেশী নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ৪ জন এবং ১৩ জনকে অপহরণ করা হযেছে বলে রিপোর্টে জানা গেছে। রিপোর্টের মতো প্রকাশ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অংশে গত মাসে অন্তত চারজন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে, এ সময় ২ জন আহত এবং একজন পেশাদারিত্বের সময় হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০০৯ ও ২০১৩) বলবত থাকার কারণে প্রতিবাদ হিসেবে প্রতিবেদনটি অধিকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেনি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ওই আইনের ব্যাপারে বলা হয়েছে, এ আইনের ৫৭ ধারায় বর্ণিত ইলেকট্রনিক ফরমে বিশেষ  ধরনের কিছু তথ্যাদি প্রকাশ করা সংক্রান্ত অপরাধ আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ২০১৩ এর সংশোধনীতে এর শাস্তি বৃদ্ধি করে সাত থেকে চৌদ্দ বছর পর্যন্ত করা হয়েছে। রিপোর্টে এই নিবর্তনমূলক আইনটি বাতিলের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপে অংশ নেয়া আলোচকরা বলেছেন, দেশে যৌথবাহিনীর অভিযানের সময় যে সব হত্যাকা- ঘটছে তা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-। তবে সরকারের একজন সাবেক মন্ত্রী বলেছেন, ক্রসফায়ারে যারা মারা যাচ্ছেন তারা  সন্ত্রাসী। এভাবে নিরীহ মানুষদের সরকারি দলের লোকেরা সন্ত্রাসী বানিয়ে দিচ্ছে। মূলত বিরোধী দলকে নির্মূল করার জন্য গুম, ক্রসফায়ার করে হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ ছাড়া কোন পুলিশ কখনো গুলী করতে পারে না। যৌথবাহিনীর অভিযানের সময় যারা মারা যাচ্ছে তারা অধিকাংশ বিরোধী দলের। কারণ বন্দুক যুদ্ধ হলে সরকারি দলের কেউ তো নিহত হয় না। এসব হত্যাকা- আরও নিন্দনীয়। যারা মারা যাচ্ছে কিভাবে, তার  সঠিক ব্যাখ্যা দেয়া হয় না। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে পুলিশ নিজের দেশের নাগরিকদের গুলী করলে নিহত হওয়ার কথা নয়। তাই অবশ্যই বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বলা হবে। ২০১৩ সালে ৩৮২১ জন খুন হয়েছে। জানুয়ারি মাসে খুন হয়েছে ২৫১ জন। ফেব্রুয়ারিতে ২৫১ জন, মার্চে ২১৭ জন, এপ্রিলে ৩০২ জন, মে তে ২৭৬ জন, জুনে ২৭২ জন, জুলাইয়ে ৩১২ জন, আগস্টে ৩২২ জন, সেপ্টেন্বর মাসে ৩৭৬ জন, অক্টোবর মাসে ৩৫৩ জন, নবেন্বর মাসে ৩৫৪ জন আর ডিসেন্বর মাসে ৪০৪ জন। ২০১৪ সালের জানুয়ারির ২১ তারিখ পর্যন্ত খুন হয়েছে ৫৭ জন। এসব হত্যা কা-ের একটিরও বিচার হয়নি। এদিকে প্রতি নিয়ত গুম হচ্ছে। গুম মৌলিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এটা একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ বলে স্বীকৃত। গত এক বছরে সারা দেশে খুন হয়েছে ১২ জন, ইউপি চেয়ারম্যান একজন উপজেলা চেয়ারম্যান ও ২ জন ইউ পি সদস্য। তাদের অধিকাংশ বিএনপি জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত। সব চেয়ে বেশি জনপ্রতিনিধি হত্যার ঘটনা ঘটেছে গত বছরের ১০ মার্চ পাবনার সদর উপজেলার গয়েশপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও বি এন পি নেতা ইব্রাহিম আলীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৪ মার্চ শার্শা উপজেলার পুটখালি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক নিহত হন। ২১ মার্চ হত্যা করা হয় মেহেরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা হামিদুর রহমান হেলালকে। এ সময় পিতাকে বাঁচাতে কলেজ পড়–য়া ছাত্রী সুমি নিহত হয়। ১৭ জুন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান রুহুল আমীন বিশ্বাসকে কুপিয়ে বোমা মেরে হত্যা করে দুর্বৃৃত্তরা। ৮ আগস্ট হবিগঞ্জ সদরের গোপায়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইসহাক মিয়া খুন হন। ১ সেপ্টেন্বর আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার চেয়ারম্যান পাহাড়ি সেলিম নিহত হন। ৫ অক্টোবর নিহত হন যশোর চৌগাছা উপজেলার সিংহঝুলি ইউপি চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান। ৮ ডিসেন্বর কুষ্টিয়া উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান মুন্সী রাশিদুল ইসলামকে গুলী করে হত্যা করা হয়। ১২ ডিসেন্বর রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কোন্ডা ইউপি চেয়ারম্যান আতিকুল্লা চৌধুরীকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। ২০ ডিসেন্বর টাঙ্গাইল সদর উপজেলার দাইন্যা ইউপি চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলার বিএনপি’র সহ সভাপতি রফিকুল ইসলাম ফারুককে গুলী করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ৩০ ডিসেন্বর সাতক্ষীরার আগরদাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান ও বি এন পি নেতা আনারুল ইসলাম যৌথ বাহিনীর গুলীতে নিহত হয়। ১৮ জানুয়ারি নাটোরের সিংড়া উপজেলার কলম ইউনিয়ান পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমানকে গুলী করে হত্যা করা হয়েছিল। ৩ জানুয়ারি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ধামালিয়া ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলামকে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। ২৭ জানুয়ারি সিলেটের জৈন্তাপুর ইউপি সদস্য শামসুদ্দিন দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। ১২ এপ্রিল নাটোরের বড়াই গ্রাম উপজেলার বাগডোর ইউপি সদস্য আব্দুস সালাম প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হয়। ২০১০ সালের ৮ অক্টোবার প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয় নাটোরের বড়াই গ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নুর বাবুকে। এরপর ২০১১ সালে ও ১ নবেন্বর নরসিংদী পৌরসভার মেয়র লোকমান হোসেনকে গুলী করে হত্যা করে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় প্রতিদিন হত্যা হচ্ছে, গুম হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। আর গুম হচ্ছে বিরোধীদল নেতা-কর্মীরা। মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে নদীতে বা খালের পার্শ্বে। এ সব হত্যাকা-ের সাথে পুলিশ র‌্যাব জড়িয়ে পড়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের নিরাপত্তার জন্য সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। দৈনিক আমার দেশের রিপোর্টে জানা গেছে, গত ১৮ জানুয়ারি একদিনে  দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে বেশি আলোচিত হয়েছে নীলফামারী সদর উপজেলার লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম রব্বানীর হত্যাকা-। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ১৪ ডিসেন্বর আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে প্রচারণা চালাতে গিয়ে প্রবল প্রতিরোধের মুখে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন নতুন সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তার গাড়ির বহরে হামলার অভিযোগে তাকে প্রধান আসামী করা হয়ে ছিল। তার স্বজনরা জানায়, কয়েকদিন আগে পুলিশ তাকে পঞ্চগড় থেকে গ্রেফতার করে। পরে তার লাশ একটি বাঁশঝাড় থেকে উদ্ধার করা হয়। সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আরও ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। সাতক্ষীরার ভোমরা ইউনিয়নের ছোটন যৌথবাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছে। ১৮ জানুয়ারি রাজধানীতে আর ও চারটি লাশ পাওয়া গেছে। সীতাকু-ের মীর সরাইল এলাকা থেকে র‌্যাব পরিচয় দিয়ে ১০/১২ জনের সশস্ত্র ক্যাডার দল শিবির কর্মী মোশারফ হোসেনকে ধরে নিয়ে যায়। পরে সীতাকু- টেরিয়াল এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। অভিযোগ উঠেছে র‌্যাব তাকে হত্যা করেছে। ফলে র‌্যাব এক ভয়ঙ্কর বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। প্রশাসন এখন  রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার। গুরুতর অপরাধের দায় রাষ্ট্র সরকার এড়াতে পারে না। হত্যাকা- থেকে গুম আরও ভয়াবহ। মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য যাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছে। সরকার যাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করায় গুম এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটছে। অভিযোগ রয়েছে, গুম থেকে নাগরিকের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদে  রহস্যজনক কারণে স্বাক্ষর করেনি সরকার। সরকার বা শাসকগোষ্ঠী যদি ভেবে থাকে আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর না করে পার পেয়ে যাবে, সেটা ভুল। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে গুম শুরু হয়েছিল। একাত্তরের ১৪ ডিসেন্বর বুদ্ধিজীবীদের গুম করে হত্যা করা হয়ে ছিল। পঁচাত্তর পরবর্তী সময় সন্তু লারমার বোন  অনিমা চাকমা ও বাবু চাকমাকে গুম করা হয়েছিল। গুম একটি অদৃশ্য বিষয়। যে বা যিনি গুম হয়েছেন তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, নজরুল ইসলাম বাছা, হুমাউন, মিজানুর রহমার জমাদ্দার, যুব নেতা শামীম আকতার, মাওলানা শামীম, ছাত্র নেতা মুকাদ্দাস, ওয়ালী উল্লাহ, দেলোয়ার জুনায়েদ, দিনার, শ্রমিক নেতা হাবিবুর রহমান, সাংবাদিক আলতাফ হোসেন,  আনছার আলী এদের পরিবারে নেমে এসেছে অবর্ণনীর্য় দিন যাচ্ছে, মাস যাচ্ছে, বছর চলে যাচ্ছে। কিন্তু ওই পরিবার গুলোর অপেক্ষার প্রহর গোনার পালা এখনই শেষ হ”্ছে না। স্বজনরা আশায় চেয়ে আছেন হয়তো তারা ফিরে আসবেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য,সরকার প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তি এমনকি নিখোঁজ পরিবারের পক্ষ থেকে ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীর  কাছে গিয়ে সকাতরে আকুতি জানিয়েছে। অনেক পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। পরিবারের ছ্ট্টো শিশুটি পিতার জন্য কান্নাকাটি করছে। তাদের আহাজারীতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
এ এইচ এম  আব্দুর রহীম 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads