এই লেখা যখন প্রকাশিত হবে ততক্ষণে
তৃতীয় ধাপের ৮১ উপজেলায় ‘নির্বাচন’ হয়ে যাবে এবং তার একটা ফলাফলও
প্রকাশিত হবে। বলা যায় না, কত লোক নিহত হবে, কত শত লোককে গ্রেফতার করা হবে
এবং কত হাজার মানুষকে অযথা হয়রানির জন্য তাড়া করা হবে। সে ‘নির্বাচনে’র ফলাফল যাই হোক, নির্বাচন যে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না, সেটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। এতে ফলাফল কী হলো, সেটি বড় কথা নয়। মানুষের ভোটাধিকার তথা গণতন্ত্রের অবস্থা কী দাঁড়াল, সেটাই বড় কথা। এখন স্বাধীনতাযুদ্ধে নানা চেতনার কথা শুনি। কিন্তু স্বাধীনতাযুদ্ধে
মূল চেতনা ছিল গণতন্ত্র, সেটি আওয়ামী লীগের হাতে বারবার পরাভূত ও পর্যুদস্ত
হচ্ছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে
এ দেশে সরকার গঠন করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার সারা জীবনের আন্দোলন, লড়াই, সংগ্রাম ছিল গণতন্ত্রের জন্যই। গণতন্ত্রের সে আন্দোলন করতে গিয়ে
তিনি বারবার জেল খেটেছেন। গণতান্ত্রিক সে সংগ্রাম থেকে পাকিস্তান শাসনামলে কোনো কিছুই
তাকে বিরত রাখতে পারেনি। শেখ মুজিব যে এ দেশের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন, তার পেছনেও কাজ করেছিল তার গণতন্ত্রের প্রতি দৃঢ় আস্থা। তিনি যদি তখন স্বৈরতান্ত্রিক
মানসিকতা প্রকাশ করতেন, তাহলে তার পক্ষে এ দেশের সর্বস্তরের মানুষের সমর্থনের
কোনো প্রশ্নই উঠত না। মানুষের এই বিশ্বাস শেখ মুজিবকে অত বড় নেতা করেছিল।
কিন্তু
স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েই আওয়ামী লীগ অনেক স্বৈরাচারী শাসকরূপে আবির্ভূত
হয়। জনগণের ভোট বা সমর্থনের ওপর আস্থা হারিয়ে দলটি এক জবরদস্তির শাসন চালু করার চেষ্টা
করে। যেন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগাররা ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর মনে এমন
একটা ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে শুধু আওয়ামী লীগই বোধ করি এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে
অংশ নিয়েছিল, আর কেউ নয়। অথচ তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধের গোটা সময় পাকিস্তানের বিশেষায়িত
কারাগারে বন্দী ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে কী ঘটছে-না-ঘটছে, সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না। আর পাকিস্তান খণ্ডিত হোক, এমন চিন্তা শেখ মুজিব করেছেন, তারও কোনো প্রমাণ নেই। তার অসমাপ্ত
আত্মজীবনীতে আছে, পাকিস্তান ছাড়া ভারতের মুসলমানদের শোষণমুক্তি ও বঞ্চনার অবসান
ঘটানো কিছুতেই সম্ভব নয়। সম্ভবত সে কারণেই ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন
আহমদের ক্যাসেট প্লেয়ারে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে অস্বীকৃতি জানান।
১৯৭৩ সালে
দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান অধীর আগ্রহে ঘর-বারান্দা হাঁটাহাঁটি করছিলেন, কখন পাকিস্তানি মিলিটারি এসে গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যাবে। তিনি তার হোল্ডঅলও
গুছিয়ে রেখেছিলেন। অবশেষে যখন পাকিস্তানি মিলিটারিরা এলো; দু’জন সিপাহি তার হোল্ডঅল মাথায় তুলে গাড়িতে নিয়ে গেল। ছোট্ট শিশু
শেখ রাসেলকে আদর করে, বেগম মুজিবকে আশীর্বাদ করে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের
হাতে ধরা দিয়েছিলেন। সে সময়কার ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব ও শেখ ফজলুল হক মনিসহ
কয়েক ছাত্র রাত ৮টায় ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে এসেছিলেন। আ স ম আবদুর
রব টেলিভিশন টকশোতে আমাকে জানিয়েছিলেন, তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে ভারতে
পালিয়ে যাওয়ার জন্য ছয়টি রুটের প্রস্তাব করেছিলেন। মুজিব তাদের বলেছিলেন, তোরা দ্রুত পালা। তখন ওই নেতৃবৃন্দ জানতে চেয়েছিলেন, আপনার কী হবে? তিনি বলেছিলেন, আমার ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি।
তোরা পালা। আওয়ামী লীগ নেতারা পালিয়ে গিয়েছিলেন। শেখ মুজিব পালাননি। আপাতত আত্মসমর্পণ
করেছিলেন। কেন, সে বিশ্লেষণও এখন বিপজ্জনক।
আটক হয়ে
শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তান যাওয়ার সময় সেই সফরে তার সঙ্গী ছিলেন ড. কামাল হোসেন।
কামাল হোসেন এ পর্যন্ত কোনো দিন মুখ খোলেননি, কেন শেখ মুজিব আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
আর কিভাবেই বা তিনি তার পাকিস্তান যাত্রায় সহযাত্রী ছিলেন। ইতিহাসে এসব প্রশ্নের মীমাংসা
জরুরি ছিল, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। প্রশ্নগুলো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। ভারতের স্বাধীনতা
আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ আবুল কালাম আজাদ একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’। সেই বইয়ে ভবিষ্যতে সংযোজনের জন্য কিছু তথ্য ছিল, যা তিনি তার মৃত্যুর প্রায় তিন দশক পর প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। আর সংরক্ষিত
রেখে গিয়েছিলেন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হুমায়ুন কবীরের কাছে। সেটি পরে প্রকাশিত
হয়। সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়, যা মূল বইতে ছিল না। ড. কামাল
হোসেন এমন কোনো বই লিখে রেখে যাচ্ছেন কি না, তা আমাদের জানা নেই।
যা হোক, আমি বলতে চাই স্বাধীনতাযুদ্ধকালে এ দেশে কী ঘটেছিল, কী ঘটেনি সেই বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের অভিজ্ঞতায় অর্জিত ধারণাই ছিল না। লন্ডনে
আসার পর তিনি প্রথম বুঝতে পারেন যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং তিনি সে দেশের রাষ্ট্রপতি।
পৃথিবীর ইতিহাসে এটাও খুব বিরল ঘটনা যে, যারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেন, তারা অন্য কারো হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। পৃথিবীতে স্বাধীনতাযুদ্ধের
মাধ্যমে যেসব দেশ সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে, তারা নিজেরাই সরকার গঠন করেছে।
কিন্তু শেখ মুজিবের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে এ দেশে সে কাজটি করার কথা কেউ কল্পনাও
করেনি। ফলে শেখ মুজিব ফিরে এসে নির্বিঘেœ প্রথমে রাষ্ট্রপতি ও পরে প্রধানমন্ত্রীর
দায়িত্ব নেন।
আর দায়িত্ব
নেয়ার পরপরই এক ভিন্ন চেহারায় আবির্ভূত হন তিনি। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক নিয়মে জনগণের
ভোটের ওপর আস্থা রাখার কথা ছিল তার। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা, ক্ষমতায় আসীন হয়েই তিনি বিরোধী দল ও মতের প্রতি ভয়াবহ রকম অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন।
প্রথমে শুরু করলেন রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর নির্মম নির্যাতন। তারপর দ্রুতই হরণ করে নিলেন
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তার লোকদের বিশাল দুর্নীতির কাহিনী মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল সারা
দেশে। ওইসব দুর্নীতিবাজকে তিনি ডিফেন্ড করতে শুরু করলেন। গঠন করলেন রক্ষীবাহিনী। এখন
যেমন বর্তমান সরকারের পুলিশ, র্যাব, যৌথবাহিনীকে এই জনপদের মানুষ
বলেই মনে হয় না; তখনো রক্ষীবাহিনীর কর্মকাণ্ডে তাদের এই জনপদের মানুষ বলে মনে হয়নি।
জনমনে সন্দেহ বিশেষভাবে ঘনীভূত হচ্ছিল যে, এরা বোধ করি দূরাগত ভিনদেশী।
তা না হলে রক্ষীবাহিনী এ দেশের মানুষের ওপর যে নির্যাতন করেছে, তা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। ওই ধরনের নির্যাতনের আগে তাদের দশবার ভাবতে হতো, কিন্তু ভাবতে হয়নি। তারা নির্বিবাদে, নির্বিচারে সে কাজ করেই গেছে।
এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের অভিযোগ, তাতে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, এরা এ দেশের সন্তান। কিংবা আমার
ভাই-ভাতিজা কেউ। মনে হয় ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে আমরা বন্দী হয়ে পড়েছি।
মরহুম
সাংবাদিক সাপ্তাহিক হলিডে সম্পাদক ‘শেখ মুজিবের উত্থান-পতন’ শিরোনাম একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন। তাতে সময় চিত্র পাঠ।
এনায়েতউল্লাহ
খানের সেই বিশ্লেষণ নিয়ে কারো প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু ইতিহাস এমন নিষ্ঠুরই। যুগে
যুগে পৃথিবীর শাসকদের শেষ পরিণতি সম্ভবত এমনই দাঁড়ায়। বর্তমান শাসকরাও সেই পদচিহ্নে
পা রেখেই এগিয়ে যাচ্ছেন।
জনগণ কেন
ভোট দেবে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কাউকে। যেন সে অধিকারই জনগণের নেই। ভোট যদি দিতে হয়, তাহলে আওয়ামী লীগকেই দিতে হবে। নতুবা কেড়ে নেব। সেভাবেই কিছু মেরুদণ্ডহীন, আত্মমর্যাদাহীন লোক দিয়ে সাজানো হয়েছে নির্বাচন কমিশন। এরা হাঁ করে সরকারের
মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সরকার চাকরি দিয়েছে, তারা কী চায় সেটা খেয়াল রাখতে
হবে না? এখন কেউ কেউ জেনারেল মইনের নির্বাচন কমিশনের গীত গাইবার চেষ্টা
করেন। কিন্তু সেই কমিশনও একই রকম আজ্ঞাবাহী অপদার্থ ছিল। সামরিক শাসন ছিল বলে তারা
একটি পাতানো ভোটের আয়োজন করতে পেরেছিল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে।
এখন উপজেলা
নির্বাচন নিয়ে যা চলছে, সেও এক বলিহারি অবস্থা। এক বশংবদ প্রধান নির্বাচন
কমিশনার নিজের হাত কেটে তার অধিকার সরকারের পদতলে সমর্পণ করেছেন। আর এত বড় নির্বাচনীযজ্ঞ
সামনে রেখে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে প্রমোদ ভ্রমণে গিয়েছেন। এ রকম মেরুদণ্ডহীনকে
ধিক্কার দিতেও লজ্জা হয়। অন্য যারা আছেন, তারা যেসব কথা বলছেন, সেগুলো টোকাইদের ভাষা। এসব টোকাই বা পথকলিরাই এখন প্রায় সর্বক্ষেত্রে কর্ণধার।
ভোটকেন্দ্র দখল হচ্ছে। পোলিং এজেন্টদের আটক করা হচ্ছে। বিরোধীদের নির্বাচন সমন্বয়কারী
হারিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী প্রার্থীদের আগের রাতে গ্রেফতার করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনে
আসা-যাওয়া করে তারা বলছে, এগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। আমাদের
কাজ নির্বাচন করা, আমরা করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করছে। এরপর
আর বলার কী থাকে? কিছু বলতেও ঘৃণা হয়। গণতন্ত্রের কবর রচনায় এরা সহযোগীমাত্র।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন