স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেশের
সব ক’টি সিটি করপোরেশনে বিএনপি প্রার্থীরা মেয়র নির্বাচিত হয়ে একটি
প্রবণতার সৃষ্টি করেছিলেন। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দুই ধাপে সেই প্রবণতাকে অব্যাহত
রেখে দু’টি ধাপের ফলাফলে এবার বিএনপিই তাদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাকে
অুণœ রেখেছিল। ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে নীতির প্রশ্নে প্রধান
বিরোধী দলবর্জিত ভোটারবিহীন এক সংসদ নির্বাচনে স্বভাবতই জেদি, ক্ষমতা প্রলম্বনলিপ্সু এবং জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ মনের হরষে দেশী ও বিদেশী
কোনো মহলের তোয়াক্কা না করেই তড়িঘড়ি করে পঁচাত্তর-উত্তর সময়ের তৃতীয় মেয়াদের সরকারও
গঠন করে ফেলে; কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ এমন একটি সরকার গঠন করা অব্দি আওয়ামী লীগ অবশ্যই
স্বস্তিতে ছিল না।
যেকোনো
অপরাধী কোথাও কখনো স্বস্তিতে থাকতে পারে না। এই অস্বস্তি থেকে রেহাই পাওয়া তো দূরের কথা, পাঁচ ধাপবিশিষ্ট উপজেলা নির্বাচনের
প্রথম দুই ধাপে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরাই এগিয়ে থেকে আওয়ামী লীগের জনবিচ্ছিন্নতাকে
স্পষ্ট করে তোলে। অপর দিকে, অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে নির্বাচন করেও বিএনপির
জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে। আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে।
ফলে আওয়ামী লীগকে নৈতিকতা বর্জিত পথ অবলম্বন করতে হলো। এর জন্য মোক্ষম সময় ছিল তৃতীয়
ধাপের উপজেলা নির্বাচন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিদেশে। ফলে এত বড় একটি নির্বাচনে
কর্মযজ্ঞও নড়বড়ে। বিষয়টি বিএনপি টের পেলেও এবং এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেও কোনো
ফল হয়নি। এ মুহূর্তে সরকারে বা প্রশাসনে বিএনপির কোনো ক্রেডেনশিয়াল নেই। আছে শুধু দলটির
নির্বাচন করার অধিকার।
সেই অধিকারটুকু
অনিয়েই কর্তৃপক্ষকে কাকুতি মিনতি করার পর তৃতীয় ধাপের নির্বাচন হতে পেরেছে। তবে নির্বাচনে
ব্যাপক সঙ্ঘাত, গোলযোগ, বোমা হামলা, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, জালভোট প্রদান, পোলিং এজেন্ট বহিষ্কারসহ নানা
নিয়ম ঘটেছে। তাই এটিকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলা যায় না। আওয়ামী লীগের এইচ টি ইমাম যথারীতি
প্রশাসনের প্রশংসা করেছেন এই বলে যে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ নির্বাচনে নিরপেক্ষ
ভূমিকা পালন করেছে। অপর দিকে এই নির্বাচন নিয়ে জেল জুলুমে ক্ষতবিক্ষত বিএনপির যুগ্ম
মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর উদ্বেগ, আওয়ামী লীগ তার পরাজয়ের গ্লানি
মুছে ফেলতে যেকোনো বৈধ বা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে ভোট কারচুপি করবেই।
বিএনপির
সাংগঠনিক অবস্থা, অনৈক্য এবং অনেক ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তার জন্য প্রতিপক্ষ এই তৃতীয়
ধাপের নির্বাচনে যা ইচ্ছা তাই করেছে এবং বিএনপিকে ফলাফলে পেছনে ফেলেছে যদিও তা অস্বাভাবিক।
কেননা প্রবণতা একবার স্থিতাবস্থায় থাকলে প্রবল জনপ্রিয়তা ছাড়া এটাকে ভাঙা যায় না। আওয়ামী
লীগ এবার ফলাফল ভালো করে এটাই প্রমাণ করেছে যে, এই ফল অর্জনে দলটির অদৃশ্য কালো
হাত অবশ্যই সক্রিয় ছিল। আরো ছিল কেন্দ্র দখলের কদর্য উৎসব।
তৃতীয়
ধাপের উপজেলা নির্বাচনটি যে যথার্থই সহিংস কারচুপিতে কলঙ্ক প্রলেপিত হয়েছে, তা ১৬ মার্চের প্রায় সব সংবাদপত্রের শিরোনামে প্রতিফলিত।
ভোটাররা হতাহত হয়েছেন, ৪২ জন প্রার্থী আতঙ্কে নির্বাচন বর্জন করেছেন। ছড়াছড়ি
হয়েছে অর্থের। সরকারি দলের ‘অর্থের জোর’ একটি বাড়তি শক্তি।
উপজেলা
পরিষদ নির্বাচনের আরো এক ধাপ বাকি আছে। বিএনপি তার বর্তমান বিশৃঙ্খল অবস্থায় এবং সরকারের
হুমকি ধমকি, কটাক্ষ এবং ধরপাকড়ে কি আর তাতে অংশ নিতে ভরসা পাবে? প্রথম দুই ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ভোট প্রাপ্তির অনুপাত দর্শনে দেশের দুই প্রধান
রাজনৈতিক শক্তির অবস্থান মোটামুটি স্পষ্ট হয়েছে। বাকিগুলোতে বিএনপি যেমন নির্বাচন করতে
ক্রমেই উৎসাহ হারিয়েছে, আওয়ামী লীগের এমন এত সহজে ‘জনপ্রিয়তা’ দেখাবার সুযোগ নিতে উৎসাহ বেড়েছে।
তা ছাড়া
নির্বাচন জেতার সব তুরুপের তাস সরকারের কাছে । এ নিয়ে সরকারে যদি কখনো কোনো বিবেকের
দংশন অনুভূত হয়, তাদের পরিচালনায় রয়েছে দল। সরকারের মধ্যে যদি এসব অপকর্ম করতে
দয়া-মায়ার উদ্রেক না হয়, ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগে তা কেন হবে। মহাজোটের মহাপরিকল্পনার
কাছে গণতন্ত্র বড় জোর ‘বলির পাঁঠা’। দেশব্যাপী নির্বাচন করায় অভ্যস্ত।
তা-ও আবার গণতন্ত্রের নামাবলি সর্বাঙ্গে জড়িয়ে সে নির্বাচনের ছক অনেক আগেই অনেক সুকৌশলে
কাটা হয়েছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন