বুধবার, ৫ মার্চ, ২০১৪

কান পাতুন, শুনতে পাবেন গণতন্ত্রের আর্তনাদ


১৯ ফেব্রুয়ারির সব জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। বাসস সরকারি সংস্থা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সংবাদটি উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে। সংবাদটি হলো, কাতারের ঢাকায় নিযুক্ত নতুন রাষ্ট্রদূতকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তার নবনিযুক্ত সরকার মুসলিম দেশগুলোর সাথে ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক আরো জোরদার করার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।

সংবাদটা পড়ে প্রথম হোঁচট খেলাম। তারপর বিস্মিতও হলাম। হোঁচট খেলাম এ জন্য, প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন- এটা অনেকের মতো আমারও কল্পনাতীত। বিস্মিত হলাম কটি শব্দচয়ন দেখে। নবনির্বাচিত সরকার’, ‘ভ্রাতৃপ্রতিমসর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে’- এই তিনটি শব্দ অনেকটা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। নবনির্বাচিত সরকার- বলার পর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে আলোকপাত করার দায় বাড়ে। প্রধানমন্ত্রীর অতি ভক্তরা তাকে গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলেই জানেন এবং মানেন। গলা উঁচু করে তা বলেনও। এরশাদের পাতানো ৮৬ সালের নির্বাচনে যাওয়ার পর দীর্ঘ দিন তার গণতান্ত্রিকরাজনীতির ধরন বুঝতে পারিনি। বিশেষত তিনি আগের দিন বলেছিলেন- স্বৈরাচারের পাতানো নির্বাচনে যারা যাবে, তারা হবে জাতীয় বেঈমান বা বিশ্বাসঘাতক। অথচ তিনি পরদিন নির্বাচনে চলে গেলেন। রাজপথে রেখে গেলেন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তৎকালীন সাতদলীয় জোটকে। এরশাদের পাতানো নির্বাচনে একা গেলেন না। সাথে নিলেন জামায়াতকে। তাতে অবশ্য এরশাদ বৈধতা পাননি। বিশ্ববেহায়ার খেতাবও মুছে ফেলতে পারেননি। শেখ হাসিনা নিজেও কম আক্কেল সেলামি গোনেননি। এরশাদের প্রতি অনেকেরই সহমর্মিতা আছে। মানবিক বিবেচনায় কারো কারো কিছু অনুরাগও থাকতে পারে; কিন্তু তার কথা, কাজ ও রাজনীতির সাথে মানুষের কোনো আস্থার সম্পর্ক নেই। শেখ হাসিনা তাকে বিশেষ দূত, তার স্ত্রীকে গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা, তার দল থেকে কজনকে মন্ত্রী-এমপি বানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করলেও জাতি কৃতার্থবোধ করেনি। বরং এরশাদ-শেখ হাসিনার পাশা খেলা দেখে অনেকেই মনের দুঃখে গান গেয়েছেন- আজ পাশা খেলবো রে শাম।

৫ জানুয়ারির ভোটারহীন একটি প্রহসনের নির্বাচনকে যখন প্রধানমন্ত্রী একটি সরকার গঠনের জন্য বৈধ ভাবেন, সেই সরকারকে নির্বাচিত বলেন, তখন বাংলাদেশের মানুষ বোবাকান্নায় গুমরে মরেন। গণতন্ত্রও আর্তনাদ করে ওঠে। বিদেশীরা আমাদের গণতন্ত্র প্রেমের নমুনা দেখে কখনো হাসেন, কখনো ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে মন্তব্য করেন- গণতন্ত্র বটে! ভ্রাতৃপ্রতিমশব্দটি নাকি শতভাগ মৌলবাদী, কথিত প্রগতিশীলদের ভাষায় সাম্প্রদায়িক চিন্তার নামান্তরও। প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি মৌলবাদমুক্ত, সাম্প্রদায়িক ভাবনার ঊর্ধ্বে। তার মদিনা সনদও আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ। সজ্ঞানে এই শব্দটি তিনি বলতে পারেন না। তার ওপর মুসলিম বিশ্বের সাথে একটা বিশেষ সম্পর্ক রাখার বিষয়টি সংবিধান থেকে তিনিই ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছেন। বলা চলে ক্ষমতার জোরে উপড়ে ফেলেছেন। এখন কেন তার নতুনসরকার ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে যাবে! এটা তো মূর্তিবাদের বিষয় নয়, কিছুক্ষণ পূজা করে আবার পরক্ষণেই ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। আবার মওকা বুঝে বুকে টেনে নিতে হবে। এটা পুতুল খেলাও নয়, মন চাইলে ছুড়ে ফেললাম, আবার মিছামিছি ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ালাম।

রাষ্ট্রের অত্যন্ত মূল্যবান তহবিল খরচ করে দীপু মনিকে দিয়ে কত সফরই না করালেন। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে শনৈঃশনৈ এত তরক্কি দেয়া হলো। তাহলে সব কি ঝুটা হ্যায়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা কেউ একজন বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, এ মুহূর্তে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মৌল বৈশিষ্ট্য কী? বলা হতো- বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে, প্রভু নেই। আরো বলা হতো- কারো সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্বই আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা। কার্যত বিদেশে আমাদের কোনো বন্ধু নেই। কেউ হয়তো শত্রু হয়ে যায়নি; কিন্তু বন্ধু আছে, সেটা কিসের জোরে বলব। একমাত্র বন্ধু বলি, মিত্র বলি, পড়শি ভারত আমাদের জনগণের সাথে না থাকলেও এই সরকারের সাথে আছে। কোমর বেঁধেই আছে। একমাত্র ভারতের সাথে সখ্য বাড়ানোর জন্য এই সরকার অনেক দেশের সাথে দূরত্ব বাড়িয়েছে। এটাকেও একটা অর্জনই বলব; কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় পররাষ্ট্রনীতিকে এভাবে একঘরে করার জন্য কোনো রাষ্ট্রের কোনো সরকারই রাজি হয় না। আমাদের সরকার রাজি হলো কেন! ভারত নিঃসন্দেহে আমাদের বন্ধু ও পড়শি। সব বন্ধু কি কৃতজ্ঞ হয়, সব পড়শি কি নিরাপদ থাকে। আমরা পড়শি ও বন্ধু পাল্টানোর কথা বলছি না। কখনো বলব না। তবে জানতে চাইব, কাউকে একতরফা প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে অন্য সবাইকে বিগড়ে দেবো কোন ধরনের জাতীয় ও কূটনীতির স্বার্থে।

বিগত সরকার এমন একজনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তুলে দিলো- তিনি রাষ্ট্রাচার জানেন না। বাফার স্টেটকাকে বলে না জানার কথা বলে তিনি শিক্ষিত মহলে হাসির খোরাক হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল তিনি আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে একরাশ হতাশার জন্ম দিয়ে বিদায় হয়েছেন। হয়তো ঠাণ্ডা মাথায় তাকে বিদায় করা হয়েছে। যা-ই করা হোক দায়টা তো সরকারের, প্রধানমন্ত্রীর। এবার আরেকজনকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, যাকে নবীন বলে ঢাকায় বিদেশী রাষ্ট্রদূতরা বেকায়দায় ফেলার কথাটা খোদ জাঁদরেল আওয়ামী লীগাররাই প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন। যেকোনো দেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ দেয় ঝানু কূটনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কাউকে। নয়তো এমন কোনো সিনিয়র রাজনীতিবিদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান যিনি জ্ঞানী, অভিজ্ঞতায় এবং ব্যক্তিত্বের কারণে রাষ্ট্র ও সরকারকে অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন।

শেখ হাসিনা পর পর দুইবার মন্ত্রিসভা গঠনের সময় কিছু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছেন, যারা যোগ্যতায় অনুগত। ধরনে হাইব্রিড। আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুনাম ও সুখ্যাতি কিছুই নেই। এটা রাজতান্ত্রিক ভাবনার আধুনিক সংস্করণ। নির্ভরতা যেকোনো একনায়ক পছন্দ করেন।

প্রধানমন্ত্রীর হাল আমলের গুণবন্ধুরা বলছেন, শেখ হাসিনা নাকি অতীতের অভিজ্ঞতা সামনে রেখে ভুলত্রুটি সংশোধন করে কিছু ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে চান। তাতে নাকি ইতোমধ্যে গলে যাওয়া বরফ আবার জমাট বাঁধবে। দেশেও আস্থার সঙ্কট কাটবে। বিদেশেও নো কনফিডেন্সঅবস্থা থাকবে না। এবার নাকি তিনি ক্ষমতা চান না, জনগণের খেদমত করে দল ও সরকারকে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চান। সে লক্ষ্যে এমন সব কর্মকাণ্ড করে দেখাতে চান যাতে বিরোধী দল কপালে হাত দিতে বাধ্য হয়। নয়তো আঙুল চুষে সময় কাটায়। একটা ফেয়ারনির্বাচন হলেও জনগণ তাকে পছন্দ করে চল্লিশ সাল পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে যাবে। তা ছাড়া সরকার একটা উইন উইন অবস্থা সৃষ্টি করে এমনিতেই ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করে তাজ্জব বানিয়ে দিতে চায়।

আমরা সরকারের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচক, নিন্দুক নই। একটি গণনন্দিত সরকার জনগণের প্রত্যাশা। একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি আমাদের জনগণের চাওয়া। মুসলিম বিশ্বের সাথে বিশেষ সম্পর্ক কোনো ঈমানের বিষয় নয়; কিন্তু নাড়ির টানের বিষয়। মুসলিম রাষ্ট্র তথা ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো মুখ ফিরিয়ে নেয়ার একটু ভাব দেখালে আমাদের কী হয়, বোঝার মতো ক্ষমতা সবার আছে। ভারতের সাথে সম্পর্কটা শুধুই ভারসাম্যহীন দেয়া-নেয়ার। তাই প্রতিবেশীর সাথে বন্ধুত্বের একটা বিষয় অবশ্যই আছে। তবে অভিজ্ঞতা বলে, মুসলিম বিশ্ব নেয় না বললেই চলে, যা দেয় তা অন্য কেউ দেয় না। বিলম্বিত বোধোদয়ও মন্দ কী!

মানুষ নাকি দেখে শেখে। ঠেকেও শেখে। হারিয়ে শেখে। অবস্থা দেখেও শেখে। আমরা সংবিধান তছনছ করেছি। নির্বাচনকে খেলো বানিয়েছি। সংসদকে বানিয়েছি অদ্ভুত ও কিম্ভূতকিমাকার। আইন-বিচারও প্রশ্নবিদ্ধ, তার ওপর বিচারবহির্ভূত হত্যার মাধ্যমে বিরোধী দলকে সবংশে নিধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গণতন্ত্র আর্তনাদ করে বলছে- আমার কফিনটা দ্রুত মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো। কান পাতুন, গণতন্ত্রের এই আর্তনাদ আপনিও শুনতে পাবেন।

মাসুদ মজুমদার


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads