মঙ্গলবার, ১১ মার্চ, ২০১৪

তৃতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনের প্রাক্কালে ভয়াবহ সন্ত্রাস


আগামী ১৫ মার্চ অনুষ্ঠেয় তৃতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী-ক্যাডাররা ভয়ংকর মারমুখী হয়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গে শুধু যৌথ বাহিনীর অভিযানই যুক্ত হয়নি, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও নীরবতার আড়ালে ন্যক্কারজনক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছেন বিরোধী সকল দলের প্রার্থীরা। দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, যে ৮৩টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে সে উপজেলাগুলোর কোনো একটিতেই বিরোধী দলের প্রার্থীরা প্রকাশ্যে প্রচারণা ও তৎপরতা চালাতে পারছেন না। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ প্রধান পদের প্রার্থীদের প্রায় সকলের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করা এবং আদালতকে দিয়ে রাতারাতি গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করানো হয়েছে। বেশকিছু প্রার্থীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অন্যরা গ্রেফতার এড়াতে গিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফলে তাদের পক্ষে স্বাভাবিক নির্বাচনী কার্যক্রম চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যৌথবাহিনী তাদের বাসাবাড়িতে যখন-তখন তল্লাশি চালাচ্ছে। এই সুযোগে হামলা চালাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী-ক্যাডাররা। অবস্থা এমন হয়েছে যে, প্রার্থীরা দূরে থাকুন, তাদের সমর্থক নেতা-কর্মী ও স্বজনেরাও নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারছেন না। সবাইকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। সব মিলিয়েই উপজেলাগুলোতে ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে ক্ষমতাসীন দল। উদ্বেগের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো, নির্বাচনকে সুষ্ঠূ, নিরপেক্ষ এবং প্রভাবহীন ও বাধাহীন করা যে প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক কর্তব্য, সে নির্বাচন কমিশনকেও এখনো তৎপর হতে দেখা যাচ্ছে না। অধিকাংশ এলাকায় কমিশন বরং ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ভূমিকা পালন করছে বলে অনস্বীকার্য অভিযোগ উঠেছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, উপজেলার নির্বাচন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে লিখিত অভিযোগ পেশ করেও কোনো সুফল পাচ্ছেন না নির্যাতিত প্রার্থীরা। দায়িত্ব যেখানে ছিল প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে সরকারকে গ্রেফতার ও নির্যাতন করা এবং প্রভাব বিস্তার থেকে নিবৃত্ত রাখা, কমিশন সেখানে উল্টো ক্ষমতাসীন দলের জন্য যা ইচ্ছা তাই করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। অথচ আইনানুযায়ী উপজেলা নির্বাচন শুধু নির্দলীয় ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা নয়, কমিশনেরও সর্বাত্মকভাবে নিরপেক্ষ থাকার কথা। কিন্তু তৃতীয় দফার নির্বাচনকে সামনে রেখে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন রকম পরিস্থিতি। প্রতিটি এলাকাতেই পুলিশ ও প্রশাসন অনেকটা ঘোষণা দিয়েই সরকারী দলের প্রার্থীদের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছে। প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই বিরোধী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের মামলায় জড়ানো, গ্রেফতার করা এবং গ্রেফতারের নামে তাড়িয়ে বেড়ানোসহ সবকিছু প্রকাশ্যে ঘটানো হলেও কোনো ব্যাপারেই নির্বাচন কমিশনকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ আইন হলো, নির্বাচনের সময় কমিশনের নির্দেশ ও অনুমতি ছাড়া পুলিশ ও প্রশাসন গ্রেফতার ও হয়রানির মতো কোনো তৎপরতায় জড়িত হতে পারবে না। কিন্তু কর্মকর্তাদের নিষেধ করাসহ কোনো ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাকুক, সব বিষয়ে রহস্যময় নীরবতা পালন করছে বলেই নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য ও নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ ভাবতে বাধ্য হচ্ছে যে, এই কমিশনের অধীনে কোনো সুষ্ঠূ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। গত ১৯ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রথম ও দ্বিতীয় দফার নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা গেছে। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, বৃহত্তর বরিশালসহ অনেক এলাকায় ১৯ দলীয় প্রার্থীরা এমনকি নির্বাচন বর্জন পর্যন্ত করেছিলেন। বর্তমানেও পরিস্থিতি অনেকাংশে একই রকম হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন না ঘটলে বিরোধী প্রার্থীদের অনেককেই হয় নির্বাচন বর্জন করতে হবে নয় তো মেনে নিতে হবে বলপূর্বক ঘটানো পরাজয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, নির্বাচন হতে যাচ্ছে এমন উপজেলাগুলেতে ক্ষমতাসীন দলের গুন্ডা-সন্ত্রাসী, যৌথবাহিনী এবং প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের হামলা, গ্রেফতার, সন্ত্রাস ও ধাইয়ে বেড়ানোর মতো কর্মকান্ড কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। এসবের বিরুদ্ধে তো বটেই, আমরা নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নসাপেক্ষ নীরবতা ও সরকারী দলের পক্ষে প্রশ্রয়ের বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানাই। কারণ, সংবিধান ও আইন অনুসারেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সব দলের প্রার্থীর জন্য বাধাহীনভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। অন্যদিকে সে কমিশনের বিরুদ্ধে শুধু পক্ষপাতিত্বের গুরুতর অভিযোগই ওঠেনি, অভিযোগের পক্ষে প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। কমিশন কেবল শ্রীপুরের মতো দু-একটি এলাকায় কিছুটা তৎপরতা দেখিয়েছে যেখানে অস্ত্রহাতে সন্ত্রাসী-ক্যাডাররা প্রকাশ্যে মহড়া দিয়েছে এবং তাদের সে মহড়ার সচিত্র রিপোর্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। বাকি সব এলাকার ব্যাপারে কমিশন এখনো নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংবিধান ও আইনের নির্দেশনার ভিত্তিতেই আমরা মনে করি, কমিশনের উচিত পক্ষপাতিত্ব পরিত্যাগ করে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা, যাতে প্রত্যেক প্রার্থীই বাধাহীনভাবে সভা-সমাবেশ করতে ও নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারেন। সরকার যাতে মিথ্যা মামলা দায়ের করে গ্রেফতারের নামে প্রার্থী ও তার কর্মীদৈর হয়রানি না করতে পারে সে বিষয়েও কমিশনের কঠোর অবস্থান নেয়া উচিত। বর্তমান পর্যায়ে এটা বিশেষভাবে দরকারও। কারণ, ক্ষমতাসীনরা প্রথম ও দ্বিতীয় দফার উভয় উপজেলা নির্বাচনেই লজ্জাকর পরাজয়ের মুখোমুখী হয়েছেন। তারা এমনকি সেই জামায়াতে ইসলামীর কাছেও শোচনীভাবে হেরে গেছেনÑ জনপ্রিয় যে দলটির বিরুদ্ধে সীমাহীন মিথ্যাচার চালানো হয়েছে এবং এখনো চালানো হচ্ছে। প্রধান দল বিএনপির কাছে তো বটেই, ক্ষমতাসীনদের আসলে জামায়াতের কাছেও ভরাডুবি ঘটেছে। সেজন্যই তৃতীয় দফার নির্বাচনে আইনের ধার না ধেরে যে কোনো পন্থায় বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য তারা মরিয়াভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন। অন্যায় ও অনুচিত হলেও ওই ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের দল হিসেবে তেমন চেষ্টা তারা চালাতেই পারেন। এখানেই বহুগুণ বেড়ে গেছে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। কিন্তু দায়িত্ব পালনে কমিশন এখনো যথারীতি ব্যর্থতাই দেখিয়ে চলেছেÑ সার্বিক বিচারে যাকে কেবলই ব্যর্থতা, অবহেলা বা উদাসীনতা বলা যায় না বরং ইচ্ছাকৃত পক্ষপাতিত্ব বলতে হয়। উদ্বেগ ও আপত্তির কারণ হলো, কমিশনের এই পরোক্ষ প্রশ্রয় ও পক্ষপাতিত্বের ফলে বিরোধী দলের প্রার্থীরা যেমন নির্বাচনী কার্যক্রম চালাতে পারছেন না তেমনি ভোট দেয়া সম্ভব হবে না ভোটারদের পক্ষেও। গত দুটি দফার নির্বাচনেও একই অবস্থা দেখা গেছে। এভাবে চলতে থাকলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা যেমন ধ্বংস হয়ে যাবে তেমনি গণতন্ত্রও বিপন্ন হয়ে পড়বে। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই আমরা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিরপেক্ষ হওয়ার এবং সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য কমিশনের প্রতি আবারও উদাত্ত আহবান জানাই। আমরা চাই, প্রত্যেক দলের প্রার্থীই যাতে সমান সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার ভোগ করতে এবং স্বাধীনভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম চালাতে পারেন। মিথ্যা মামলার কারণে যাতে কাউকেই পালিয়ে বেড়াতে না হয়। এ বিষয়ে আইন-শংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সততা ও নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads