বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০১৪

অকাল মৃত্যুর মিছিল আর কত দীর্ঘ হবে?


আধুনিক বিজ্ঞানের যন্ত্র বিপ্লবের কারণে বর্তমান পৃথিবীর ওজন কত? এটা জানা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র! কিন্তু পিতার কাঁধে সন্তানের লাশের ওজন কত ভারি? যন্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে কোন বিজ্ঞানীর জানা নাই। একমাত্র হতভাগ্য পিতাই বলতে পারেন পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ কত ভারি। সেইসব হতভাগ্য পিতা-মাতার শোকাহত অন্তরের প্রতি গভীর সমবেদনা ও শোক-শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার আজকের লেখাটি শোকাহত পিতাদের উৎসর্গ করছি।
জীবনে অনেক লেখা লিখেছি, লিখছি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ নিবন্ধ কত কি! কিন্তু কখনো এতটা আহত হইনি। আজকের এ লেখাটি যখন আমি লিখেছি, তখন যেন আমিও আমার মধ্যে নেই। শঙ্কা আর শঙ্কা। আমি শুধু আমার জন্য শঙ্কিত নই আমার দেশের মানুষের অকাল মৃত্যুর জন্য, আমার সমাজের মানুষের অকাল মৃত্যুর জন্য, আমার পরিবারের সদস্যদের অকাল মৃত্যুর জন্য, সর্বশেষ আমার অনাগত দিনের জন্য। আমি আজ বড়ই শঙ্কিত। কারণ দেশে যে হারে অকাল মৃত্যুর হার বেড়ে গেছে তা নিয়ে জানি না, সমাজ বিজ্ঞানীরা কী ভাবছেন? তবে এটা জানি, আমার দেশের বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা দেশ ও জনগণ নিয়ে তেমন একটা ভাবেন না। রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজের সর্বক্ষেত্রে দুর্বৃত্তায়নের কারণে প্রকৃত সমাজ ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা আড়ালে চলে গেছেন আর যেন কয়জন আছেন, তারাও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। বর্তমান সমাজে যেন নিজে বাঁচলেই বাপের নাম অবস্থা।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে জন্মগ্রহণ করলেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। চিরসত্য মৃত্যুকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। মুসলমানদের প্রতিদিন মৃত্যুকে স্মরণ করার জন্য বলা হয়েছে। জীবনের আত্মশুদ্ধির জন্য তাই মৃত্যু চিরসত্য। কেননা আজকের শিশু আগামী দিনের বৃদ্ধ অতঃপর মৃত্যু এবং জীবনের পরিসমাপ্তি। স্বাভাবিক মৃত্যু সুন্দর পৃথিবীর অংশ। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হলো, দেশের সংবাদপত্রগুলোতে চোখ রাখতেই গা শিউরে উঠে! মানুষের নানা অকাল মৃত্যুর খবর বর্তমান সময়ের ধারাবাহিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন মানুষ মরছে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায়, রাজনৈতিক সহিংসতায়, পারিবারিক কলহে, প্রেম-পরকীয়ায়, চুরি-ছিনতাই, জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধ ইত্যাদি। তবে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। ১২ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকের সূত্রে প্রকাশ, গত দুই মাসে ৭৩১ জন মানুষ হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে আর ১১ মার্চ একদিনে ১০ জন বিভিন্ন কারণে হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। একদিনে ১০ জন আর দুই মাসে ৭৩১ জন মানুষ যদি হত্যাকা-ের শিকার হয়, তাহলে গোটা বছরে এই অকাল মৃত্যুর হার যে কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। তাই বাংলাদেশের মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করতে কীভাবে অকাল মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে এখনই। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ১৭ মার্চ সোমবার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দেশের মাটিতে পা রেখে ঘরে ফেরার আগে ফটিকছড়ি উপজেলার কাজিরহাট সড়কে সোয়াবিল ইউনিয়নে প্রবাসী শফির পরিবারে নেমে আসে অকাল মৃত্যুর আরেক মর্মান্তিক ঘটনা। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফেরার পথে একেবারে বাড়ির কাছাকাছি এসে মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটলে ঘটনাস্থলে ৪ জনের মৃত্যু হয়। একই দিন নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেট এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে দুইজনের লাশ পাওয়া যায়। অনাকাক্সিক্ষত এইসব মৃত্যু বড়ই নির্মম ও বেদনাবিধুর। ফটিকছড়ির মাইক্রোবাসে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় আতঙ্কিত নগরবাসী। কেননা চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলরত ৪০ হাজারের অধিক সিএনজির গ্যাস সিলিন্ডার মেয়াদোত্তীর্ণ। বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে কেবল আমরা তৎপর হই। দুর্ঘটনার আগে সজাগ ও সচেতন থাকলে জানমালের ক্ষতি অনেক কমানো সম্ভব। তাই জাতীয় জীবনের প্রয়োজনে দলমত নির্বিশেষে অকাল মৃত্যুরোধে আমাদের অবশ্যই এক হতে হবে। কারণ দল যার যার, কিন্তু দেশ সবার। তাই আসুন, দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসি আর দায়িত্বশীল হই।
তা না হলে একের পর এক দুর্ঘটনা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে পিছিয়ে দেবে। ১১ মার্চ মঙ্গলবার চট্টগ্রামের সংবাদপত্রগুলোতে যখন চোখ রাখি, ত্রিভুজ প্রেমের বলি ইউসুফ নবীর মর্মান্তিক অকাল মৃত্যুর ঘটনা পড়ে চোখের জল মুছতে না মুছতে টেলিফোনে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে ফোনে করে জানাল, আপনার পাশে নাকি ট্রেন-মিনিবাসে অনেক মানুষ মারা গেছে, জানেন নাকি? এমন মর্মান্তিক প্রশ্নবোধক ফোন পেয়ে ঘটনাস্থলে (বাহির সিগনালে) গিয়ে দেখি হাজার হাজার মানুষের ভিড়। সবার চোখে-মুখে বিষাদের ছাপ। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশ ঘরের সামনে গিয়ে জানতে পারি ৪ জনের মৃত্যুর কথা। লাশ ঘরের সামনে যেন আর্তনাদের জনসমুদ্র। ৫ বছরের জেরিনের আর্তচিৎকার। মা, মা কথা বলো, মা কথা বলো। মা কথা বলছো না কেন? মা-মা-মা করে যখন জেরিন কাঁদছে, তখন সবার চোখে পানি আর পানি। যে দেহের ওপর জেরিন উঠে খেলত-হাসত, সেই দেহ রক্তে রক্তাক্ত। নিথর মায়ের শরীরে হাত রেখে অবুঝ জেরিন কাঁদছে, মায়ের কি হলো? মা ইয়াছমীন কেন কথা বলছে না। পাশে ইয়াছমীনের পিতা বুক ছাপড়িয়ে কাঁদছে, নানা-নাতনীর বুক ফাটা কান্নায় নির্বাক-নিস্তব্ধ হয়ে উঠে পরিবেশ। একটু আগে যারা প্রাণচঞ্চল ছিল, তারাই এখন প্রাণহীন মানুষ। ১১ মার্চ মঙ্গলবার নগরীর বাহির সিগনালে রেলক্রসিং-এ আটকে পড়া মিনিবাসের ওপর ট্রেনের ধাক্কায় যে ৪ জন মারা যায়, তাদের  মধ্যে ইয়াছমীন (২৫) একজন। জানা যায়, ইয়াছমীনের বাড়ি কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায়। স্বামীর সংসার হারিয়ে নিঃস্ব ইয়াছমীন জীবনের প্রয়োজন বাদ দিয়ে মেয়ে জেরিনের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শহরে ফুফাতো বোনের হাত ধরে কয়েক মাস আগে বেইজ গার্মেন্টসে কাজ নেয়। মেয়ে জেরিন নানার বাড়িতে নানা-নানীর সাথেই থাকতো। গার্মেন্টেসে চাকরির ছুটি নেই তাই মেয়েকে দেখতে খুব ইচ্ছে করেছিল ইয়াছমীনের।
ইয়াছমীনের ইচ্ছায় মেয়ে জেরিনকে নিয়ে নানা-নানী শহরে এসেছিল ৪ দিন আগে। কে জানতো, ১১ মার্চই জীবনের শেষ দেখা ইতি হয়ে যাবে? মেয়ে ইয়াছমীন পিতার কাছে বাজারের জন্য ৩০০ টাকা দিয়ে তাড়াহুড়ো করে জেরিনকে শেষবারের মতো আদর করে বের হয়ে আর ঘরে ফিরলো না। পিতা নুরুল আলম (৫৫) মেয়েকে হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নানা-নাতীর স্বজনদের কান্নায় ঘোটা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠে। যেন গাছ-পালা পর্যন্ত নিস্তব্ধ। সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর চট্টগ্রামে গার্মেন্টস কর্মীদের অকাল মৃত্যুর সবচেয়ে মর্মান্তিক এ ঘটনা চট্টগ্রামবাসীকে শোকাহত করে তুলেছে। জানা যায়, চালক দিদারুল আলমের (২৪) কানে হেডফোন থাকায় রেলের বিকট হর্ণ তার কানে আসেনি। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাহির সিগনালের রেলক্রসিংয়ে ট্রেন এসে মিনিবাসকে ধাক্কা মারে এ ঘটনায় মুহূর্তেই ৪ জনের মৃত্যু এবং ২০ জনের অধিক আহত হয়। লাশ ঘরের সামনে শোকাহত মানুষের ভিড়ে ছুটে আসেন অপর নিহত ৩ জনের আত্মীয়-স্বজনরা। আজাদ-রিয়ার ভালোবাসার সংসার ছারখার হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত পছন্দ থেকে প্রণয় এবং শুভ পরিণয়ের মাঝে সংসারে স্বামী আজাদের বেকারত্বের অভাব ঘুচাতে স্ত্রী রিয়ার গার্মেন্টসে চাকরি জীবনের অবস্থানের শেষ মুহূর্তে জীবনটাই শেষ হয়ে গেল তার।
জানা যায়, স্বামীর এক সময়ের অভাব ঘুচাতে রিয়া গার্মেন্টেস চাকরি নেয়। বর্তমানে স্বামী আজাদ সচ্ছল, তাই সুখের সংসারে রিয়ার আর চাকরির প্রয়োজন নেই, বেতন পেলেই আজ (ঘটনার দিন) চাকরি ছেড়ে দেবে রিয়া। বেতন নিতে গিয়েই রিয়া এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় না ফেরার দেশে চলে গেল। রিয়ার জন্য আজাদের আর্তনাদ স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আজাদ জানান, যার কারণে এতগুলো প্রাণের অকাল মৃত্যু হয়েছে, তার বিচার কী এদেশ করবে? আর কত মৃত্যু হলে এদেশের মানুষের অকাল মৃত্যু বন্ধ হবে? নিরাপদ সড়ক নিশ্চিন্ত গন্তব্য আমাদের সবার কাম্য। তারপরও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সড়কপথে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। অথচ সামান্য সচেতন হলেই অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশ থাকলেও, সড়ক নিরাপদ রাখতে হাইওয়ে পুলিশের ভূমিকা চোখে পড়ে না। চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানো, মোবাইলে কথা বলার অভিযোগের পর এবার হেডফোনে ড্রাইভারের গান শোনার অভিযোগ যোগ হয়েছে। একের পর এক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের সব সড়কপথকে নিরাপদ করতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরাকান সড়কটি শরৎকাল এলে বাংলাদেশের সব রাস্তার প্রবেশমুখ হয়ে উঠে। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, এ সড়কে ৫৫টি বাঁক মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে আছে দীর্ঘদিন থেকে। অথচ সরানোর কোন উদ্যোগ নেই। দেশের পর্যটন খাতের বিকাশে অচিরেই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কপথকে নিরাপদ সড়কে পরিণত করতে হবে। একই সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের দ্রুত নির্মাণ কাজ শেষ করে ওয়ান ওয়ে সড়ক তৈরি করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা জোরদার করতে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। প্রয়োজনে দেশের সব জনকল্যাণমূলক কাজে জনগণকে দলমত নির্বিশেষে সম্পৃক্ত করে নাগরিক জীবনে শুভ কাজে সূচনা করতে পারলে বাংলাদেশ বিশ্বের মডেল রাষ্ট্রে পরিণত হবে। নারীর ক্ষমতায়ন ও আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়ার পিছনে এদেশের পোশাক শিল্পের অবদান অনেক বড়। আর পোশাক শিল্পের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অর্ধকোটি শ্রমশক্তির ৩৫ লাখই নারী। তাই নারী শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা স্বাস্থ্য উন্নয়ন যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর নয় অকাল মৃত্যুর মিছিলÑ এটাই আজকের বাংলাদেশের প্রত্যাশা।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads