বিষয়টি পুরাতন কিন্তু নতুনভাবে আলোচনা করতে হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতিগত কারণে। বিষয়টি শিষ্টাচারের সঙ্গে জড়িত। যে শিষ্টাচার ধর্ম, সমাজ, নৈতিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতএব, নতুন করে বলার অপেক্ষা নেই যে, শিষ্টাচার তথা ক্ষমা প্রার্থনা, ভুল স্বীকার ও দুঃখ প্রকাশের তাৎপর্য অপরিসীম।। এটি ভদ্রতার অংশ। সরকারি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দায়িত্বেরও অংশ বটে। দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যবোধের সঙ্গে সঙ্গে যদি ভুল হয়, তাহলে ক্ষমা প্রার্থনা, ভুল স্বীকার বা দুঃখ প্রকাশের নজির ইতিহাসে অনেক আছে।
ইতিহাসে, সংবাদপত্রে, রাজনীতিতে, ধর্মে, সমাজে, নানা সময়ে, নানা কারণে ভুল হলে ক্ষমা প্রার্থনা ও দুঃখ প্রকাশের নজির নিয়ে অনেকেই আলোচনা করেছেন সমসাময়িক উদাহরণের মাধ্যমে। প্রসঙ্গত, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক বিনয় লাল বলেছেন, গোটা পৃথিবীজুড়েই একটা ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আর তার পিছনে বিশ্বায়ন এবং বাজার একটা বড় কারণও বটে। জালিয়ানওয়ালাবাগে এসে রানী ক্ষমা চাইছেন বা দুঃখ প্রকাশ করছেন অতীতের বৃটিশ ভূমিকার জন্য। ১৮৪৫ সালের আলুর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের জন্য আইরিশ মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। কালোদের ওপর সাদাদের অত্যাচারের জন্য আফ্রিকার কাছে আমেরিকার আধুনিক প্রেসিডেন্টরা এখন মুহুর্মুহু ক্ষমা চান। এই ক্ষমা চাওয়ার নাম দেয়া হয়েছে আবেগজনিত প্রতীকীবাদ (ইমোশনাল সিম্বলিজম)। এই মুহূর্তে ভারতীয় নেতা রাজনাথ সিংহ মুসলমান সমাজের কাছে ক্ষমা চাইছেন। ১৯৮৪-র শিখদাঙ্গা নিয়ে কী ভাষায় কতটা ক্ষমা চাওয়া হবে আর হবে না, তাই নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। নরেন্দ্র মোদি গোধরার জন্য ভোটের আগে ক্ষমা চাইবেন কি চাইবেন না, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা তুঙ্গে। পৃথিবীর রাজনীতিতে ক্ষমা চাওয়ার কারণ হিসেবে গবেষকরা দেখাতে চেয়েছেন যে, বিশ্বায়নের যুগে অন্য দেশের বাজার তথা উপভোক্তা দখল করার জন্য অতীতে ঔপনিবেশিক শাসকদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়া হল আসলে খুব ভালো জনসংযোগের কৌশল। আসলে ভুল স্বীকার করতেই হবে। ভুল থেকেই ‘ঠিক’-এ যেতে হয়। যেমন অন্ধকার থেকে আমরা আলোর পথযাত্রী। ঠিক সেভাবেই অসত্য থেকে সত্যের পথে যাত্রা। আসলেই ভুল স্বীকার করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক গুণ। কিন্তু বাংলাদেশে এ গুণের এখন প্রচ- কমতি। কোনো কারণে ভুল হলে দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা প্রার্থনা এখানে অকল্পনীয়। ‘সরি’ বলাটাকে সম্ভবত মানুষ পরাজয় বলে মনে করে। পরিবারে, সমাজে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা বা দুঃখ প্রকাশের উদাহরণ এদেশে বিরল। রাস্তায় দু’জন মানুষও লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে যায়; তবু কেউ কোনো ভুল স্বীকার করে না। দুর্নীতির মাধ্যমে অগাধ অর্থ উপার্জন করার জন্য ক্ষমা বা দুঃখ নেই কারও। দেরিতে ট্রেন আসায়, সময়মতো ডাক্তার না আসায়, ঠিকভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায়, ফল প্রকাশে বিলম্ব ঘটায়, ফরিয়াদির দাবি মেটানোয় দীর্ঘসূত্রিতায়, প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করায়, অন্যায়ভাবে নির্যাতিত-লাঞ্ছিত-অপমানিত হওয়ায়, যথাযথ সেবা ও সার্ভিস না পাওয়ায় নাগরিকগণ কি কখনও কর্তৃপক্ষীয় কারও কাছ থেকে দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা প্রার্থনার মতো সুসভ্য আচরণ পেয়েছেন? পাননি। কারণ উচ্চ থেকে নিম্ন স্তরে এখন সবাই হুকুমের ভাষায় কথা বলে। যার যে জায়গা, সেখানে সে মহা-প্রতাপ ও দাপটে সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। নিজের ক্ষমা চাওয়া বা ভুল স্বীকার দূরে থাকুক, প্রতিপক্ষকে শ্লীল-অশ্লীলভাবে আক্রমণ করেই যাচ্ছে। সাংবাদিক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী একদা রাজনীতিবিদদের মিথ্যাচার ও প্রবঞ্চনামূলক বক্তব্য গ্রন্থিত করে ‘কথামালার রাজনীতি’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। কর্তাদের কথামালা এখন কুকথামালায় পরিণত হয়েছে। সেসব কুকথায় ক্ষমা, দুঃখ তো নেইই, বরং হিংস্রতা, অশ্রাব্যতা, উস্কানি, নোংরামি, মিথ্যাচার, বাগাড়ম্বর, বড়াই, ঐতরেয়পনা কিলবিল করছে। তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে-ধ্বনি-শব্দ-বাক্যে-কর্মে আগ্রাসী মনোভাব জ্যান্ত রূপ লাভ করেছে। ফলে একদিকে ভয়াবহ অপকর্ম হচ্ছে; আরেকদিকে নিকৃষ্ট ভাষায় সেগুলোকে জায়েজ করা হচ্ছে। একদা স্বর্গ থেকে বিতাড়িত শয়তান বা ইবলিশ যেমন ক্ষমা প্রার্থনা বা দুঃখ প্রকাশ না করে অপকর্মের জন্য গর্ব করেছিল; আজ তাই করছে অনেকেই। এই সৌজন্যহীনতা, সমবেদনাহীনতা ও মানবিকতাহীনতা মানুষকে অপরাধপ্রবণ ও অনুশোচনাহীন করছে। কর্তব্য-কর্মে-কৃত ভুল বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমা চাইতে হয়, দুঃখ প্রকাশ করতে, সে বোধটুকুই মানুষের মাঝ থেকে লুপ্ত হচ্ছে। অতএব, শিক্ষা-সংস্কৃতি-সমাজ-সংসার-আর্থ-রাজনীতি-আইন-শৃঙ্খলা-বিচার-আচার নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের সবাইকে স্ব স্ব কর্তব্যের পর্যালোচনার মাধ্যমে আত্মসমীক্ষার পথে নিজস্ব ভুলগুলোকে চিহ্নিত করে ক্ষমা প্রার্থনা, দুঃখ প্রকাশ ও ভুল স্বীকারের মানবিক সংস্কৃতিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। শুধু অপরের ভুল ধরে বেড়ালেই চলবে না, আয়নায় নিজেদের কুৎসিত মুখগুলোকে দেখে দেখে সেগুলোকেও সুসভ্য করতে হবে। আমাদের সবাইকেই সেটা পদ-মর্যাদা আর দায়িত্বের প্রয়োজনুসারেই করতে হবে।
নাগরিকগণ সদাচরণ, সাংবিধানিক-আইনানুগ আচরণ প্রত্যাশা করেন। কর্তৃপক্ষ এটা যদি ভুলে যান বা অগ্রাহ্য করেন, তাহলে তারা দায়িত্বের অবহেলারই প্রমাণ দিচ্ছেন। সুশাসন বা ডিজিটাল ব্যবস্থার কথা বলা হবে, কিন্তু যথাযথ আচরণ করা হবে না, তা কাম্য নয়। আধুনিক পৃথিবীতে নাগরিক সমাজকে বিনা বিচারে বা বিনা সার্ভিসে উন্মুখ বসিয়ে রাখার নজির নেই। সেখানে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সকলেই নিজ নিজ দায়িত্ব সচেতনভাবে পালন করছেন। কেবল রাজনৈতিক বাক্যবাগিস হয়ে বসে আছেন না। কিন্তু প্রতিপক্ষকে নোংরা ও নিকৃষ্ট ভাষায় জঘন্যভাবে আক্রান্তও করছেন না। প্রতিপক্ষকে শক্তির দাপটে তছনছ করে দেয়ার কথাও সেখানে অকল্পনীয়।
আমরা তো প্রগতি আর উন্নতির ধারা মেনে সামনের দিকে এবং ভালোর দিকেই এগিয়ে যেতে চাই। আমাদের শাসন-প্রশাসন-সমাজ-সংসার-রাজনীতি-অর্থনীতিকেও উন্নততর করতে চাই। নেতৃবৃন্দও মুখে তেমনটিই বলে থাকেন। এখন বাস্তব আর মুখের কথার তুলনা হওয়া দরকার। কথা আর কাজের মধ্যে মিলও দেখতে পাওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের দুঃখী-দরিদ্র-নির্যাতিত মানুষের জন্য কিছু করা দরকার। করতে না পারলে ক্ষমা প্রার্থনা ও দুঃখ প্রকাশও জরুরি। ভুল হলে সেটাও স্বীকার করা যেতে পারে। কিন্তু কিছুই করব না এবং এজন্য কোনো দুঃখ প্রকাশ, ক্ষমা প্রার্থনা বা ভুলও স্বীকার করব নাÑ এটা কোনো কাজের কথা নয়।
রাজনীতির প্রসঙ্গে আসা যায়। দেখা যাচ্ছে, সেখানে পরিস্থিতি জটিল। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এই মুহূর্তে জরুরি কর্তব্য কী? এ প্রশ্ন নাগরিকগণ করতেই পারেন দৃঢ়, কার্যকর, প্রকৃত ও ফলপ্রসূ গণতন্ত্রের প্রয়োজনে। কিন্তু এ প্রশ্নের এক ও অভিন্ন উত্তর কি পাওয়া যাবে? এক কথায় ‘না’। ব্যারিস্টার রফিক সাহেব বলেছেন, ‘দুই নেত্রীর মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি’। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডা. বি. চৌধুরী কথা বলেছেন শিষ্টাচার নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চেয়ারম্যান প্রফেসর নূরুল আমিন বেপারি বলেছেন, ‘অসম্পূর্ণ নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক’। এসব বক্তব্য ও উদ্ধৃতি বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে মানবজমিন-এর পাতায়। মানুষ বর্তমানে যে ‘গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি’-এর মধ্যে বসবাস করছে, সেটা নিয়ে হররোজ কথাবার্তা চলছেই। দেশে নয়, বিদেশেও একই আলোচনা। তার মানে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য কথা ও কাজের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। কিন্তু এখানকার সমস্যার জন্য কেউ কি দুঃখ প্রকাশ করেছে? ক্ষমা চেয়েছে? বা ভুল স্বীকার করেছে। না। করেনি। বরং যা আছে, তাকেই মেনে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। খারাপকে খারাপ বলার মুখও বন্ধ করা হচ্ছে। ক্ষমা বা ভুল স্বীকার দূর অস্ত, খারাপের সমালোচনাও করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণেই শুরুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষমা প্রার্থনা, ভুল স্বীকার বা দুঃখ প্রকাশের প্রসঙ্গটির অবতারণা করা হয়েছিল। আমাদের মনে হয়, এখনও অনেক কিছু শেখার বাকি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন