আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো প্রচার-প্রচারণায় মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। যতই দিন যাচ্ছে, রাজনৈতিক ময়দান ততই উত্তপ্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়বারের ন্যায় ক্ষমতার মেয়াদ ফুরিয়ে আসার সাথে সাথে সর্বভারতীয় কংগ্রেস দলটি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় বৈধ-অবৈধ সকল রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করছে বলে মনে হয়। বিজয়ের ব্যাপারে সন্দিহান হলেও কংগ্রেস তার আচরণে সর্বদা দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টি প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধস্পৃহা নিয়ে গুজরাট রায়টের মহানায়ক নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী করার অঙ্গীকার নিয়ে মাঠে নেমেছে বলে মনে হয়। তবে গুজরাটে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার মহানায়ক প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী কুখ্যাত নরেন্দ্র মোদির অভিষেচন এর সাথে যুক্ত হওয়ায় নির্বাচনী যুদ্ধে বহুমাত্রিক আবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অভিমত প্রকাশ করছেন। মোদির অপবাহ নির্বাচনী প্রচারণা প্রকৃতি ও গতিপ্রবাহকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। সাধারণ নির্বাচনের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিরোধী দল সবসময় সরকারি দলের দুর্বল দিকসমূহের উপর আঘাত করে এবং ঝুলন্ত ভোটারদের কাছে টানার জন্য এই দুর্বলতাসমূহকে পুঁজি করে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী হিন্দুত্ববাদী এবং সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিমবিদ্বেষী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধান অস্ত্র হচ্ছে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি, দুঃশাসন ও পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নস্যাতের অভিযোগ। এই অভিযোগগুলো মোদির নেতিবাচক ইমেজকে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যে রূপান্তরিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এক্ষেত্রে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে ২০ কোটি মুসলমানের ভোট প্রাপ্তির মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণায় একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় ভারতীয় জনতা পার্টির এখন প্রধান টার্গেট হচ্ছে মুসলমান সম্প্রদায়। মুসলিম ভোট যাতে কংগ্রেসের বাক্সে না পড়ে তার জন্য দলটি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি যিনি ভারতীয় মুসলমানদের যেখানে নাম-নিশানা মুছে ফেলাই শুধু নয়, সর্বদা ‘কুকুরের বাচ্চা’ (চঁঢ়ঢ়ু) বলে অভিহিত করতেই অধিকতর স্বস্তি বোধ করতেন, তিনিই এখন তাদের ভোট পাবার জন্য বিভিন্ন রকম প্রলোভন ও প্ররোচনার আশ্রয় নিচ্ছেন। বিজেপির এই রাজনৈতিক কৌশল মুসলিম ভোটারদের অনুপ্রাণিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কেননা, তাদের প্রতি বিজেপির অতীত আচরণ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদির দৃষ্টিভঙ্গি সুখকর নয় যদিও বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের আমলে তাদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল। বর্তমান বিজেপির কট্টর হিন্দুত্ববাদী ও মুসলিমবিরোধী নীতি সারা ভারতের মুসলমানদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিশেষ করে মুজাফফরনগরের সাম্প্রতিক মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা এবং বিজেপি নেতৃবৃন্দের এর সাথে গভীর সম্পৃক্তা তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে আরও বৃদ্ধি করেছে।
এক্ষেত্রে বিজেপির প্রতি চরম সাম্প্রদায়িক দল শিবসেনার অকুণ্ঠ সমর্থন তাদের প্রতি মুসলিম সমর্থনের পথে একটি বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিবসেনার বিকারগ্রস্ত মানসিকতা এবং মুসলিমবিদ্বেষ গোপন কোনও ঘটনা নয়। অতীতে ভারতে যতগুলো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছে তার প্রত্যেকটিতেই শিবসেনার হাত ছিল। শুধু তাই নয়, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তাদের মুসলিমবিরোধী প্রচারণা সকল প্রকার রাজনৈতিক শিষ্টাচারকে অতিক্রম করেছে। নির্বাচনের সময় বিজেপি এবং শিবসেনাকে সবসময়ই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে দেখা যায় এবং ক্ষমতা লাভের পর তারা কি কি এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন সে সম্পর্কে তাদের অভিন্ন কর্মসূচিও থাকে।
সম্প্রতি শিবসেনা নির্বাচনী প্রচারণায় বিজেপির মুসলিম তোষণ নীতির কঠোর সমালোচনা করেছে। শিবসেনার মুখপত্র ‘সামনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ‘ক্ষমতায় যাবার জন্য অনেকেই রামমন্দিরের বিষয়টি ভুলে যান সংখ্যালঘু তোষণ ভারতের জন্য একটি অভিশাপ। অতীতে আমরা দেখেছি যে, ক্ষমতার রাজনীতিতে রামমন্দির ইস্যুটি গৌণ হয়ে পড়েছে। সংবাদ নিবন্ধটিতে মুসলমান মহিলাদের উপহাস করে বলা হয়েছে যে, ভারতের জন্য এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক যে নির্বাচন সংক্রান্ত সমাবেশসমূহে বোরকা পরা মহিলাদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে একটি বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, ভোট সংগ্রহের জন্য বিজেপি তাদের যতই তোষণ করুক না কেন তারা কিছুতেই শিবসেনার সঙ্গ ত্যাগ করবে না। এখানে প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপির এই অবস্থান মুসলিম ভোটারদের কংগ্রেসের দিকে ঠেলে দিবে কিনা? ভারতীয় মুসলমানরা তাদের দৈনন্দিন নাগরিক সুযোগ-সুবিধা এবং দাবি-দাওয়ার প্রতি কংগ্রেসের নির্লিপ্ততা ও নিষ্ক্রিয়তার জন্য তাদের প্রতি রুষ্ট। তাদের প্রধান ক্ষোভ হচ্ছে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার নিছক সন্দেহের বশে মুসলমান যুবকদের গ্রেফতার এবং নির্যাতনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঢালাও অনুমোদন দিয়ে রেখেছে। মুসলমান ছেলেরা যতই শিক্ষিত ও দক্ষ হোক না কেন জনসংখ্যার অনুপাতে সরকারি চাকরি-বাকরিতে তাদের ঠাঁই হয় না। তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করার জন্য এমন কোন প্রচার প্রপাগা-া নেই যা সরকার করছে না।
মুসলিম যবুকদের গ্রেফতার-নির্যাতনের বিষয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদালতের বিচারে মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে এবং আদালত এগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ধর্মীয় বিদ্বেষের অংশ বলে অভিহিত করছেন। কিন্তু তথাপিও এই নির্যাতনের মাত্রা থামছে না। মুসলিম নেতৃবৃন্দের অভিযোগ হচ্ছে, কংগ্রেস, বিজেপি তথা ‘মোদি’ জুজুর ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে ভোট আদায়ের চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের প্রকৃত সমস্যাসমূহের প্রতি কোনপ্রকার নজরই দিচ্ছে না। বাংলাদেশে হিন্দু তোষণ ও ভারতের প্রতি বর্তমান সরকারের নতজানু নীতি মুসলিম নির্যাতনে ভারতকে উৎসাহিত করছে বলেও অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
তৃতীয় শক্তি :
ভারতীয় রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি যদিও এককভাবে টিকে থাকতে সক্ষম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প তথাপিও ১৯৮৮ সালে ভিপি শিং-এর কোয়ালিশনের পর সেখানে তৃতীয় শক্তি একটি শক্তিশালী সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি কংগ্রেস এবং বিজেপিকে নির্বাচনে পরাস্ত করার জন্য ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেস এবং বিজেপি’র বাইরের জোটভুক্ত দলসমূহের সাথে একটি সাধারণ প্লাটফরম তৈরি করার উদ্দেশ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। তবে কম্যুনিস্ট নেতৃত্বাধীন এই উদ্যোগ কতটুকু সফল হয় তা দেখার বিষয়। তবে এটা স্পষ্ট যে, তৃতীয় শক্তি উত্থানের কোনও উদ্যোগ যদি সফল হয় তা হলে কোন কোন নির্বাচনী এলাকায় মুসলিম ভোটাররা কংগ্রেস ও বিজেপি’র পরিবর্তে তৃতীয় শক্তিকে ভোট দেয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতীয় ওয়েলফেয়ার পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল ইতোমধ্যেই অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন যে, যে সমস্ত রাজ্যে শক্তিশালী সেক্যুলার দল গঠিত হয়েছে সেখানে মুসলমানরা কংগ্রেস বলয়ের বাইরে চলে এসেছে। পশ্চিম বাংলা, বিহার কেরালা, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়–, আসাম প্রভৃতি রাজ্যে বিকল্প সেক্যুলার দল গঠিত হয়েছে এবং এ প্রেক্ষিতে এ সমস্ত রাজ্যে মুসলমানদের ঝুলন্ত ভোটের সংখ্যা অনেক বেশি। এসব ক্ষেত্রে বিকল্প দলগুলোর সাথে মুসলমানদের সম্পর্কও অনুকূল। উত্তরপ্রদেশে সাম্যবাদী দলের সাথে মুসলমানদের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক গভীরতর হয়েছে। তবে রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস এবং বিজেপি ছাড়া অন্য দলগুলোর অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল এক্ষেত্রে তাদেরকে হয় কংগ্রেস না হয় বিজেপিকেই ভোট দিতে হতে পারে। এখানে মুসলিম ভোটই জয়-পরাজয়ের নিয়ামক হবে বলে বিশ্লেষকরা অনুমান করছেন।
জাতীয় নির্বাচনে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোকে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর মুখোমুখি হতে হবে। এগুলো হচ্ছেÑ জাতীয় অর্থনীতি, রাজ্যের সাথে কেন্দ্রের সম্পর্ক, বিদেশ নীতি পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি হুমকি, ভারতীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অপরাধপ্রবণতার ঊর্ধ্বগতি। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক নিছক বিদেশ নীতির ব্যাপার নয়, এর সাথে যুক্ত রয়েছে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিভিন্ন দিকও। ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতির যারা শিকার তারা ভারতীয় মুসলমান এবং এদের সংখ্যা কম নয়, ২০ কোটিরও বেশি। ভারতীয় গণমাধ্যম কোন কিছু ঘটলেই তার মধ্যে পাকিস্তান বা আইএসআই-এর গন্ধ খুঁজে পায় এবং জড়ায় ভারতীয় মুসলিম নাগরিকদের। এতে ফল ভালো হয় না, খারাপই হয়। নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গোলাগুলী হলেই মুসলমানদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে। ২০০৯ সালে মুম্বাই হামলার পর ভারতীয় মিডিয়াসহ সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা স্থানীয় মুসলমানদের দমনের জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানি দিয়েছিলেন।
কথা হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনে ভারতে যে সরকারই আসুক না কেন তাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে ভারতবাসীর ঐক্য ও সংহতিকে জোরদার করে মানুষের মর্যাদাকে ফিরিয়ে দেয়া। ভারতীয় মুসলমানদের যত ক্ষোভ বা সমস্যাই থাকুক না কেন তারা ভারতীয় সংবিধানকে সম্মান করে, দেশকে ভালোবাসে। তারা অমুসলমান প্রতিবেশীদের সাথে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের সাথে বসবাস করতে চায়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন