সরকার আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাড়ানোর আগে গণশুনানির নামে জনমত যাচাইয়ের নাটকীয়তা করা হলেও বাস্তবে কোনো মহলের আপত্তিকেই গ্রাহ্যে আনা হয়নি। সবচেয়ে মারমুখী অবস্থান নিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিইআরসিও যেখানে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে পিডিবি সেখানে সাড়ে ১৫ শতাংশ হারে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। এ ব্যাপারে ঘোষণা আসতে পারে যে কোনোদিন। শুধু তা-ই নয়, বর্ধিত মূল্য কার্যকর হবে পেছনের তারিখ তথা মার্চের প্রথম থেকে। দাম বাড়ানোর কারণও জানিয়েছে পিডিবিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চার সংস্থা। বলেছে, প্রতি ইউনিটে উৎপাদন খরচ যেখানে ছয় টাকা সেখানে বিক্রি করতে হচ্ছে চার টাকায়। এই মুহূর্তে তাদের নাকি প্রতি মাসে সাড়ে সাতশ’ কোটি টাকার ঘাটতি পূরণ করা দরকার। অতএব সহজ বুদ্ধি হলো জনগণের ওপর সব দায় চাপিয়ে দেয়া। পিডিবিসহ চার সংস্থাকে সামনে রেখে সে সিদ্ধান্তই কার্যকর করতে যাচ্ছে সরকার। আপত্তি ও প্রতিবাদ উঠেছে সঙ্গত কিছু বিশেষ কারণে। একটি প্রধান কারণ হলো, দাম বেশি বাড়ানো হয়েছে সাধারণ গ্রাহকদের ওপর। প্রতি মাসে যারা সর্বোচ্চ ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন তাদের ক্ষেত্রে এক টাকা ৪৯ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পিডিবি। এর ফলে বর্তমান তিন টাকা ৩৩ পয়সার স্থলে প্রতি ইউনিটের জন্য দাম গুণতে হবে চার টাকা ৭০ পয়সা। কৃষি ক্ষেত্রেও একইভাবে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পিডিবি। সেচপাম্পের জন্য বর্তমানে যেখানে দুই টাকা ৫১ পয়সা দিতে হয় সেখানে নতুন হার অনুযায়ী দিতে হবে চার টাকা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে বাড়বে এক টাকা ৪৯ পয়সা। বিস্ময়ের বিষয় হলো, গরীব ও সাধারণ গ্রাহক থেকে কৃষক পর্যন্ত সকলের বেলায় উচ্চহারে বাড়ালেও ধনিক শ্রেণীর বেলায় একই পিডিবি যথেষ্ট উদারতা দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেসব আবাসিক গ্রাহক ৬০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন প্রতি ইউনিটে তাদের দাম বাড়বে মাত্র দুই পয়সা। বর্তমান নয় টাকা ৩৮ পয়সার স্থলে নতুন হারে দিতে হবে নয় টাকা ৪০ পয়সা। অর্থাৎ সাধারণ ও গরিব গ্রাহকদের বিল যেখানে বাড়বে ১০২ টাকা ৭৫ পয়সা সেখানে ধনী গ্রাহকদের বাড়বে মাত্র ১২ টাকা দুই পয়সা! শুধু ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীদের নয়, ৭৬ থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারী গ্রাহকদের ওপরও যথেষ্ট পরিমাণে বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিডিবি। ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত এক টাকা ২৭ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত এক টাকা ৪২ পয়সা এবং ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত এক টাকা ৫৭ পয়সা হারে বিল বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পিডিবি। ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের বাড়বে এক টাকা দুই পয়সা হারে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, পিডিবিসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সামনে রেখে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি আসলে নিয়েছে সরকার। এবারের আগাম ঘোষণাও এসেছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে। শুধু তা-ই নয়, তিনি সেই সাথে হুকুমের সুরে বলে রেখেছেন, দাম বাড়ানোর পর কোনো প্রতিবাদ বা চেচামেচি করা চলবে না! অন্যদিকে জনগণের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোও আপত্তি ও প্রতিবাদ জানিয়েছে খবরটি প্রচারিত হওয়া মাত্র। এর কারণ, সরকারের পক্ষ থেকে অনেক উপলক্ষেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি করার দাবি জানানো হয়েছে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত পাঁচ থেকে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে বলে শোনানোর পর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রাক্কালে হঠাৎ করেই প্রধানমন্ত্রী উৎপাদনের পরিমাণ টেনে তুলেছিলেন ১০ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। অন্যদিকে ভুক্তভোগীরা কিন্তু ভিন্নকথা বলেছেন। বস্তুত একথা অনস্বীকার্যও যে, সরকারের দাবি সত্যের কিছুটা কাছাকাছি হলেও একদিকে সীমাছাড়ানো লোডশেডিং হওয়ার কথা নয়, অন্যদিকে দাম বাড়ানোরও প্রয়োজন পড়তে পারে না। কারণ, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর পর্যায়ক্রমে সরকার ছয় দফায় বিদ্যুতের দামও যথেষ্ট পরিমাণেই বাড়িয়েছে। সর্বশেষ ২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর একবারেই বাড়িয়েছিল ১৭ শতাংশ। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের খাতে বছরে ২২ থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়ার দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানোর ফলে গ্রাহকদের আটশ-এক হাজার টাকার স্থলে আড়াই-তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে।
আমরা মনে করি, জনগণের কষ্ট ও সাধ্যের কথা বিবেচনা না করে এভাবে কিছুদিন পরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ, বিদ্যুতের সঙ্গে কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন থেকে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া পর্যন্ত প্রতিটি বিষয় জড়িত। প্রসঙ্গক্রমে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও যে ১০ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর গালগল্প শুনিয়েছেন সে বিদ্যুৎ তাহলে যাচ্ছে কোথায়? পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বাস্তবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের নামে দলীয় লোকজনকে পকেট ভারি করার ব্যবস্থাই শুধু করা হয়েছে। কারণ, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেখানে ব্যয় হয় দেড় থেকে দুই টাকার মতো সেখানে তেলভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের ব্যয় ১৪ থেকে ১৬ টাকা। এজন্যই একদিকে সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে চলেছে অন্যদিকে দলীয় লোকজনকে বছরে ভর্তুকি দিচ্ছে ২৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়ার পরও সংকটের সমাধান হচ্ছে না। বলা দরকার, এসব কেন্দ্রের জন্য সরকারকে ফার্নেস অয়েলসহ জ্বালানি তেলের দামও বাড়াতে হয়েছে। এর ফলেও ব্যাহত হয়েছে শিল্পের উৎপাদন। তাছাড়া জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পরিবহন এবং চাষাবাদের খরচ। একই কারণে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্যও।
আমরা মনে করি, দলীয় লোকজনের পকেট ভারি করার জন্য বিপুল অর্থের অপব্যয় করার পরিবর্তে সরকারের উচিত জনগণের কষ্ট ও ভোগান্তিকে প্রাধান্য দেয়া এবং রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সম্পাদিত অসম চুক্তি বাতিল করা। সরকারকে একই সঙ্গে গ্যাসভিত্তিক প্রচলিত কেন্দ্রগুলোকে সংস্কার করে সেগুলোর মাধ্যমে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তি তো বাড়বেই, শিল্পায়নের সঙ্গে সামগ্রিক সমৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হবে। সরকারকে বুঝতে হবে, কেবলই দফায় দফায় দাম বাড়ানোর মধ্যে সমস্যার সমাধান নেই। বিদ্যুতের সংকট কাটিয়ে ওঠার পদক্ষেপ নিতে হবে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন