প্রাত্যহিক জীবনের অন্যতম সঙ্গী বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ খাত দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। কৃষি বা শিল্পের উৎপাদনের বেলায় বিদ্যুৎহীনতার কথা ভাবা যায় না। দেশের মোট জাতীয় আয় কী পরিমাণ হবে তা এখন নির্ভর করছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাস না যেতেই বছরের শুরুতে জনজীবনে অভিশাপ হয়ে এসেছে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি।
বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুরসহ দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর এবং পৌর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বর্তমানে পিডিবির গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)। ডিপিডিসির গ্রাহক সংখ্যা প্রায় নয় লাখ এবং ডেসকোর ছয় লাখ। দেশের ৪৫৩টি উপজেলার প্রায় ৫০ হাজার গ্রামে ৭২টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিতরণ করে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। এর গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৯৮ লাখ। এর মধ্যে আবাসিক গ্রাহক প্রায় ৮৪ লাখ। বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা বিভাগের ২১টি জেলা ও ২০টি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিডেট (ওজোপাডিকো)। বর্তমান এর গ্রাহক সংখ্যা সাত লাখ ৬১ হাজার।
দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা এখন প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট। আর মোট উৎপাদনের ২০ শতাংশ আসছে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে। কিন্তু সেজন্য যে টাকা লাগছে তা বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক। এই পরিস্থিতি কতোদিন চলবে সে সম্পর্কেও সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কিছু বলা হচ্ছে না।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকে ৪ হাজার ৪৮৩ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ৫৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়েছে। আর ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে ৫০০ মেগাওয়াট। ৬ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট বেড়ে সম্প্রতি ১০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। আর এই বিদ্যুতের ৭০ শতাংশের বেশি আসে গ্যাস থেকে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে এই পরিমাণ আর বাড়ানোর উপায় নেই।
বর্তমানে মোট বিদ্যুতের ৩%ও কম আসছে কয়লা থেকে। এর ব্যবহার বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদন ক্ষমতা ৩৪ হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে যাওয়ার কথা সরকারের মহাপরিকল্পনায় বলা হলেও কয়লা উত্তোলন নিয়েই সরকার এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।
বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ও লোকসান অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির দায় গ্রাহকদের ওপর চাপাচ্ছে সরকার। ফলে ২৬ লাখ ৫৪ হাজার বিদ্যুৎ গ্রাহককে ১ মার্চ থেকেই বিদ্যুতের বর্ধিত দাম দিতে হবে। জ্বালানি নিয়ে সরকারের ভুলনীতির মাশুল ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লোকসানের ঘানি টানতে হচ্ছে গ্রাহকদের। সরকারের আয় কমে গেছে। রাজস্ব আদায় কম। তবে ব্যয় কমেনি। বেড়েছে ভর্তুকি ব্যয়। সরকার এখন বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কিছুটা কমাতে চাইছে।
খুচরা ও পাইকারী পর্যায়ে বিদ্যুতের পাইকারী দাম বাড়ানোর পর মানুষের জীবনযাত্রা নাভিঃশ্বাস ঠিক সে সময়ে ২য় দফায় ক্ষমতায় বসে আরেকবার বিদ্যুতের পাইকারী দাম বৃদ্ধি করেছে সরকার। নতুন সরকারের আমলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটিই প্রথম পদক্ষেপ। ৪ মার্চ থেকে ৬ মার্চ ২০১৪ পর্যন্ত তিন দিন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে কাওরান বাজারের টিসিবি ভবনে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গণশুনানির আগে দেশের পাঁচটি বিতরণী সংস্থা ও কোম্পানি পিডিবি, বিআরইবি, ডিপিডিসি, ডেসকো ও ওজোপাডিকো বিদ্যুতের নতুন মূল্য নির্ধারণের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব জমা দিয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-এর কাছে। বিদ্যুতের দাম ছাড়াও সার্ভিস চার্জ, ডিমান্ড চার্জ, ন্যূনতম বিল ইত্যাদি বাড়ানোর দাবি করেছে বিআরইবি।
শুনানিতে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে উৎপাদন খরচ অতিমাত্রায় বেড়ে যাবে। কৃষকরা নিরুৎসাহিত হলে কৃষিখাত হুমকির মুখে পড়বে।
আরইবি অধীনস্ত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোর গ্রাহকদের জন্য খুচরা মূল্য গড়ে ১২.৫৮% হারে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব রাখে। প্রস্তাবে ক্ষুদ্র শিল্প গ্রাহকদের ১৫.১১%, আবাসিক মধ্যম শ্রেণির গ্রাহকদের ১৭.০২%, সেচগ্রাহকদের ২৩.০৪% মূল্য বাড়ানোর আবেদন জানানো হয় আরইবির পক্ষ থেকে। আরইবি যে প্রস্তাব করে, তাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষিখাত। প্রতি ইউনিট ৭৪ পয়সা হিসেবে দুই লাখ কৃষি সেচপাম্পের জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। সেচে ব্যবহৃত বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের দাম মূল্য বৃদ্ধির পূর্ব পর্যন্ত ৩ টাকা ৯৬ পয়সা, আরইবির প্রস্তাবিত দাম ছিল ৪ টাকা ৭০ পয়সা। আরইবির প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য সাধারণ গ্রাহককে বাড়তি গুণতে হবে ৫৯ পয়সা।
পিডিবি-এর দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে দেখা যায়, সংস্থাটি সবচেয়ে বেশি দাম প্রস্তাব করেছে গরিবের বিদ্যুতের ওপর। সাধারণত শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিটের (এক কিলোওয়াট ঘণ্টা) মধ্যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন অতি সাধারণ পর্যায়ের গ্রাহকরা। ২য় পর্যায়ের গ্রাহক হলো যারা ৭৬ ইউনিট থেকে ২শ’ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। পর্যায়ক্রমে ৩য়, ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ স্তরের গ্রাহক হলো যারা ২০১-৩০০, ৩০১-৪০০, ৪০১-৬০০, ৬০০ থেকে অধিক পরিমাণ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকেন।
পিডিবির প্রস্তাবিত দাম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৭৬ ইউনিটের নিচের গ্রাহকরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল প্রায় ৪২%। সে তুলনায় ধনীদের বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে সবচেয়ে কম। এভাবে অনিয়ম চলতে থাকলে গরিবরা আরো গরিব হবে, আর ধনীরা আরো সম্পদের মালিক হবে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর পক্ষ থেকেও এর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এছাড়াও গণশুনানি চলাকালে ঐ ভবনের সামনে গণসংহতি আন্দোলনের উদ্যোগে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে গণঅবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়।
এর আগে বিদ্যুতের পাইকারী দাম বাড়ানোর ব্যাপারে নিজের অবস্থানও স্পষ্ট করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর পর বিদ্যুতের দাম বাড়বে এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। (সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব ২ মার্চ ২০১৪)
কৃষকের মাঠ থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত একই আলোচনা-কেন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ৫ মার্চ জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির এমপি তাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রেসিডেন্টের ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবে বলেছেন, ‘বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে এখনি ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে।’
জাতীয় সংসদে বিদ্যুতের পাইকারী দাম বৃদ্ধির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে মানুষ অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছে বিদ্যুতের পাইকারী দাম আরেক দফা বাড়ছে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার সংবাদে নিত্যপণ্যসহ মানুষের ব্যয় বেড়ে গেছে। মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সংক্রান্ত বিইআরসির আদেশে নতুন মূল্যহার ‘বিল মাস মার্চ ২০১৪’ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে প্রায় সব গ্রাহক বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, কোনো মাসের ১ তারিখ থেকে ৩০ তারিখের ব্যবহার হিসাব করে ওই মাসের বিদ্যুৎ বিল করা হয় না। যেমন মার্চ মাসের জন্য যে বিল গ্রাহককে দেয়া হয়, তার মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসেরও কিছুদিনের ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত থাকে। তাই ‘বিল মাস মার্চ’ থেকে নতুন মূল্যহার কার্যকর করা হলে প্রায় সব গ্রাহককেই ফেব্রুয়ারি মাসেরও কিছুদিনের বিল বর্ধিত হারে দিতে হবে।
বিইআরসি দেয়া এবার গড়ে দাম বাড়ানো হয়েছে ৬.৯৬%। এর মধ্যে পিডিবির গ্রাহকদের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির গড় হার ৭.১৭%। ডিপিডিসির ৭.৬৯%। ডেসকোর ৭.৩৪%। পল্লী বিদ্যুতের ৫.৪১% এবং ওজোপাডিকোর ৭.১৪%।
২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ছিল গড়ে দুই টাকা, এখন তা ছয় টাকার বেশি। এই তিন গুণেরও বেশি উৎপাদন ব্যয় বাড়ার পেছনে কারণগুলো অনুসন্ধান করলে বিভিন্ন সরকারের ভুলনীতি ও দুর্নীতির খবরই পাওয়া যায়। মোটা দাগে এগুলোর মধ্যে আছে ১. গ্যাসস্বল্পতার অজুহাতে, বিকল্প থাকা সত্ত্বেও, একের পর এক বেসরকারি ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল) তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র চুক্তি। এরা সময়মতো বিদ্যুৎ না দিয়েও বিল পাচ্ছে, অনেকের নবায়ন হচ্ছে। কোনো কোনো কোম্পানির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম কখনো কখনো ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এরাই বিদ্যুৎ ভর্তুকির প্রায় পুরো টাকা খেয়ে ফেলছে। ২. গ্যাসপ্রাপ্তির জন্য, স্বল্প মেয়াদেও বিদেশী কোম্পানি যুক্ত করায় কয়েক গুণ ব্যয়বৃদ্ধি, আবার দীর্ঘসূত্রতা তৈরি। ৩. বেশি দামে বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস ক্রয়, তার অনুপাত ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির ফলে ভর্তুকির চাপ বৃদ্ধি। ৪. বহুজাতিক কোম্পানির হাতে বেশির ভাগ ব্লক তুলে দেওয়ার পর বাজারের অভাবের অজুহাতে তাদের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বন্ধ রাখা গ্যাস-সংকটের অন্যতম কারণ। তার ফলে নতুন যোগান কম। ৫. রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো মেরামত ও নবায়ন করলে বিদ্যমান গ্যাস জোগানেই শতকরা কমপক্ষে আরও ২০ থেকে ৩০ ভাগ উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব ছিল, এর জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করা।
১৩ মার্চ ২০১৪ বিইআরসির বৃদ্ধি করা মূল্যে গ্রাহক শ্রেণী-নির্বিশেষে প্রতি ইউনিট (এক কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের দাম বেড়েছে গড়ে ৬.৯৬%। নতুন দামে বেশি ক্ষতিগস্ত হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। কারণ তাদের প্রতিমাসে গড়ে খরচ হয় ৪ শ’ ইউনিট থেকে ৬শ’ ইউনিটের মধ্যে। এজন্য তাদের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে ৪৪৫ টাকা বেশি। অর্থাৎ যে গ্রাহক ৪০১ ইউনিটের জন্য আগে ২৯৬৭ টাকা বিদ্যুৎ বিল প্রদান করতেন তাকে এখন ৩৪১২ টাকা বিল দিতে হবে। ৪০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর অতিরিক্ত বাড়বে ১৩৫ টাকা, ৩৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বাড়বে ১১১ টাকা ২৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বাড়বে মাসে ৬৮ টাকা ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বাড়বে ৫০ টাকা। এ ছাড়া ১৫০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বাড়বে ৩৬ টাকা, ১০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিল বাড়বে মাসে ২২ টাকা ৭৫ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর বাড়বে ১৫টাকা।
জনগণের বৃহৎ একটি অংশ কৃষক। অধিকাংশ কৃষকের বসবাস পল্লী এলাকায়, আর কৃষকরাই এদেশের প্রাণ। কৃষক মাটিতে সোনা ফলায় বলেই স্বপ্নের বাংলাদেশকে নিয়ে সকলে গর্ব করে। ডিজিটাল বাংলাদেশের নানা বিজ্ঞাপনেও কৃষকরা আজ মডেল হচ্ছেন। অথচ সেই কৃষক আজ বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করতে নতুন করে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাচ্ছেন। পুনরায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে-তাদের কাছে এ যেন সংবাদ নয়, দুঃসংবাদ মাত্র। সাধারণত এ ধরনের সংবাদ শুনতে নারাজ দেশবাসী। তারপরেও সরকার এ ধরনের সংবাদ শুনতে বাধ্য করছেন।
যে কৃষক গরুর দুধ, একটি লাউ, একটি হাঁস কিংবা মুরগি বিক্রি করে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে; বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে তাদের কথা ভাবা হয় নি। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কৃষির ওপর বড় ধরনের আক্রমণ। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর আক্রমণ।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের আমলে মোট ৬ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। প্রথম দফায় ২০১০ সালের ১ মার্চ বিদ্যুতের দাম খুচরা পর্যায়ে ৬.৭% বাড়ানো হয়। এরপর ২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাইকারী পর্যায়ে ১১% এবং খুচরা পর্যায়ে ৫% দাম বৃদ্ধি করা হয়। ২০১১ সালের ১ আগস্ট পাইকারী পর্যায়ে কার্যকর হয় ৬.৬৬%। মাত্র তিন মাসের মাথায় একই বছর ১ ডিসেম্বর খুচরা পর্যায়ে ১৩.২৫% এবং পাইকারী পর্যায়ে ১৬.৭৯% দাম বাড়ানো হয়। ৯ মাসের মাথায় ২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবারও খুচরা পর্যায়ে ১৫% এবং পাইকারী পর্যায়ে প্রায় ১৭% বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়।
২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারিতে বিইআরসিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গণশুনানি শেষে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে এ কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব স্থগিত করা হয়। কিন্তু ২য় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার ৩ মাসের মধ্যে দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় সরকার।
বিইআরসি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে বিতরণ কোম্পানিগুলো বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠায় বিইআরসিতে। পিডিবি বর্তমান দামের ওপর ১৫.৫০ শতাংশ, ডিপিডিসি ২৩.০৫%, ডেসকো ১৫.৯০%, ওজিপাডিকো ৮.৫৯% এবং আরইবি ১২.৫৮%দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়।
২০০৯-১০ অর্থবছরে বিদ্যুৎখাতে সরকারের ভর্তুকি ছিল ৯৯৩ কোটি টাকা, যা ২০১০-১১ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। মূল্য বৃদ্ধির আগ পর্যন্ত প্রতিইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ গড়ে ৬ টাকা। এ বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে বিক্রি হয় ৪ টাকায়।
সবচেয়ে বড় কথা বিতর্ক ও বড় লোকসানের মধ্যেই বেসরকারি খাতের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দগুলো নিয়ে এগিয়ে চলেছে সরকার। বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে দ্রুত পদক্ষেপ হিসেবে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক ১৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমতি দেয়া হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর অনুমতি পায় আরও ২০টি কেন্দ্র। কিন্তু স্বল্প সময়ে চালু করতে গিয়ে একদিকে মূলধনী ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে বেশিরভাগ কেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল ব্যবহারের কারণে বিদ্যুতের দামও পড়ছে কয়েকগুণ বেশি।
শুরুতে তিন থেকে পাঁচ বছরের অনুমতি পেলেও এরই মধ্যে ১০টির চুক্তির মেয়াদ আরও ৩ থেকে ৫ বছর বাড়ানো হয়েছে। অথচ এসব কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে গত চার বছরে সরকারকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশ নিমার্ণ কাজ সম্পূর্ণ করা যায়।
ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, ‘থিওরিটিক্যালি আমরা যদি তাদের কাছ থেকে মূলধনী মূল্য (ক্যাপিটাল কস্ট) কমিয়ে সস্তায় বিদ্যুৎ কিনতে পারি, তাহলে আবার নতুন কেন্দ্রের কন্ট্রাক্ট দিয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ আনার কোনো যৌক্তিকতা নেই।’
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ একটি বার্তা সংস্থার মাধ্যমে সংবাদপত্রে প্রকাশিত অভিমতে তিনি আরো বলেন, বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনায় তরল জ্বালানিভিত্তিক কিছু কেন্দ্র করার কথা রয়েছে। আর ‘রেন্টালগুলো তো’ আছেই।
ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সিদ্ধান্ত নিতে গঠিত সরকারি কমিটি সম্প্রতি তাদের প্রতিবেদনে ২০২০ সাল পর্যন্ত এসব কেন্দ্র চালিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অবশ্য মনে করেন, ২০১৮-১৯ সালের পর ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র রাখার কোনো কারণ নেই। ওই সময় আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার কথা।
পিডিবির হিসাবে ভাড়া বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ার পর গত চার অর্থবছরে তাদের লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা, যা মেটাতে হয়েছে ভর্তুকিতে। উচ্চমূল্য সমন্বয় করতে গিয়ে গত পাঁচ বছরে খুচরা ও পাইকারী পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে সাত বার। সব মিলিয়ে ভয়াবহ নাজুক অবস্থা। একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধি। তারপরও বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানো যাচ্ছে না। তেলের ওপর নির্ভরতা বাড়ালে দাম আরও বাড়বে। স্বাভাবিকভাবেই মূল্য দিতে হবে নাগরিকদের।
পিডিবির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত চার অর্থবছরে ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে পিডিবি কিনেছে মোট বিদ্যুতের প্রায় ২০%। আর এজন্য খরচ হয়েছে বিদ্যুৎ কেনার মোট ব্যয়ের ৪২%। গত চার অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি কেন্দ্র থেকে পিডিবির কেনা প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের গড় মূল্য পড়েছে ৪ টাকা ৫২ পয়সা। এর মধ্যে ভাড়ার কেন্দ্রগুলোর থেকে কিনতে গড়ে খরচ হয়েছে ৯ টাকা ৫০ পয়সা। ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রের কারণেই ভর্তুকি বেড়েছে। ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র চালুর আগে পিডিবির ভর্তুকি কখনো এক হাজার কোটি টাকার ওপরে যায়নি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১১-২০১২ অর্থবছরে দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য জিপিডিতে.৮০% প্রবৃদ্ধি যোগ হয়েছে।
কয়লা নিয়ে সরকারের নীতিতেও ভুল আছে। দেশী কয়লায় এখনও হাত দিচ্ছে না। কয়লা আমদানির বিষয়ও স্পষ্ট না। গত মেয়াদের শেষ বছরে এসে রূপপুরে দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে সরকার, যাতে ব্যয় হবে তিন থেকে চারশ’ কোটি ডলার। এছাড়া ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আমদানি নির্ভর কয়লায় চলবে এমন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভিত্তিও স্থাপন করা হয়েছে বাগেরহাটের রামপালে।
বেসরকারি খাতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতিও গত বছরই দেয়া হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে পিডিবি জানায়, তাদের নিজস্ব উৎপাদন ব্যয় এখনও গড়ে ৩ টাকার নিচে রয়েছে। কিন্তু তেলভিত্তিক কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি ইউনিটের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৮ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মতে, পিডিবি’র নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় ও কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনার ব্যয় যোগ করেই পিডিবির গড় ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। এ কারণে পিডিবির বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় বেড়ে গেছে। এই ব্যয় বৃদ্ধির কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যাপক ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে কোনোভাবেই পিডিবির পক্ষে এই লোকসান বহন করা সম্ভব নয়।
সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ও অর্থনৈতিক চাপ সচল রাখতেই এই দাম বৃদ্ধি। কিন্তু তা মানতে নারাজ জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সরকার বেসরকারি খাতে উৎপাদিত বিদ্যুতের ভর্তুকি ব্যয় সামাল দিতেই এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। অপেক্ষাকৃত বেশি মূল্যের তেলভিত্তিক ভাড়া বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা বাড়ার পর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
১৫ মার্চ ২০১৪ জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ আয়োজিত বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেছেন, রেন্টাল-কুইক রেন্টালের নামে সরকার জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করছে। তিনি বলেন, জনগণের সম্পদকে লুটপাট করার ব্যবস্থা করা হয়েছে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মাধ্যমে।
সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সভাপতি ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আরও বক্তব্য রাখেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ, সাবেক বিদ্যুৎ সচিব প্রকৌশলী আ ন ম আকতার হোসাইন, প্রফেসর সাব্বির মোস্তফা, প্রকৌশলী আতাউল মাসুদ, প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম রিজু ও জাকির হোসেন প্রমুখ।
তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু এবং রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ভর্তুকির চাপ সামাল দিতেই বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। তেলভিত্তিক রেন্টালের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এতে করে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এই ভর্তুকি কমাতেই সরকারকে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে। এই দাম বৃদ্ধির ফলে দ্রব্যমূল্য ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। সেইসাথে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। যার বিরূপ প্রভাবে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যাবে।
বিদ্যুৎ সেক্টরকে পরিপূর্ণভাবে লুণ্ঠনের সেক্টরে পরিণত করা হয়েছে। টেন্ডার ছাড়া বিদ্যুৎ সেক্টরের কাজ কীভাবে হয়। জাতির কাছে এ প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি।
বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ সরবরাহে অব্যবস্থাপনা, চুরি, দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধে সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। নিজেদের ঘনিষ্ঠ লোকদের কুইক পকেট ভরার উদ্দেশ্যেই বিদ্যুৎ ব্যবসায় রেন্টাল কুইক রেন্টাল ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সামগ্রিকভাবে চালু করার কথা বলা হলেও এখন এ ব্যবস্থাই স্থায়ী করা হচ্ছে। এজন্য গা বাঁচানোর লক্ষ্যে ২০১০ সালে সংসদে দায়মুক্তির কালো আইনও পাস করানো হয়েছে। এ বিষয়ে আদালতেও যাওয়া যাবে না। এখানে কোনো জবাবদিহিতা নেই। আইনের শাসনে বিশ্বাসী সমাজে এটা হতে পারে না।
বিদ্যুতের দাম বাড়লে ভোক্তার ওপর চাপ বাড়বে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। এতে উৎপাদকও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে আরও প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে। পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা নষ্ট হবে।
বিশেষজ্ঞ ও পিডিবির দেয়া তথ্য মতে, সরকার রেন্টাল (ভাড়াভিত্তিক) ও কুইক রেন্টাল (দ্রুত ভাড়াভিত্তিক) বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনছে ইউনিটপ্রতি ১০-১২ টাকায়। কিন্তু গ্রাহককে দিচ্ছে ৫ টাকা থেকে সাড়ে ৫ টাকায়। অবশিষ্ট অর্থ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এভাবে গত পাঁচ বছরে শুধু রেন্টাল ও কুইক রেন্টালেই ভর্তুকি দিতে হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, সরকার স্থায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মেরামত না করে বা বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা না বাড়িয়ে সাময়িক সমস্যা সমাধানে এই ভর্তুকি দিচ্ছে। এর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বারবার সতর্ক করে দেয়ার পরও সরকার রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ওপর নির্ভরতা কমাতে বিকল্প ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
আনু মোহাম্মদ বলেন, সরকারের কিছু ভুল নীতির কারণে বার বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। জাতীয় স্বার্থবিরোধী নীতি ও দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য একটি মহল চাপ সৃষ্টি করছে এবং সরকারকে বাধ্য করছে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে। (সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম ২ মার্চ ২০১৪)
বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেছেন, ২০১৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতায় রপ্তানিমুখী শিল্প বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছে। এর মধ্যে শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে হয়েছে। এখন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যৌক্তিক নয়। আমরা মনে করি, ব্যবসায়ীদের আরও কিছুটা সময় দেওয়া উচিত। আগামী ছয় মাস পর বিদ্যুতের দর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হোক। তাতে ব্যবসায়ীরা কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। (সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ৬ মার্চ ২০১৪)
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক বিশেষ সহকারীর দায়িত্বে থাকা ম. তামিম বলেছেন, বিদ্যুতের মূল্য ইতোমধ্যেই সাধারণ গ্রাহকদের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। যদিও সাড়ে ছয় শতাংশ বৃদ্ধি বেশি না। কিন্তু এই মূল্য যে ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যে বাড়বে না এর কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ সরকার ধাপে ধাপে দাম বাড়াচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ক্রমশই বিদ্যুৎ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। দাম বাড়ানোর কোন বিকল্প আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে সরকারের উচিত সাশ্রয়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া। দেশী কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এক্ষেত্রে ভাল ভূমিকা রাখতে পারে। গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের যে উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেছে তা জনগণের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি বলেন, গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পর গ্যাস পাওয়া না গেলে এটা হবে বড় ধরনের ক্ষতি। তাই সরকারের উচিত এই উদ্যোগ পরিত্যাগ করা। (সূত্রঃ দৈনিক মানবজমিন ৬ মার্চ ২০১৪)
সরকারের দুর্নীতি ও ভুল নীতির কারণে যদি বিদ্যুতের দাম বাড়ে তাহলে কেনো জনগণ তার দায় বহন করবে না। ২০১৩ সালের পর থেকে বিদ্যুতের দাম কমবে-সরকারের এমন ঘোষণার পরেও কেন দাম বাড়ানো হচ্ছে? এটি জনগণের আরেকটি প্রশ্ন। জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কোন সরকারই সফলভাবে দেশ চালাতে পারেনি। সরকার যে জনবিচ্ছিন্ন তার প্রমাণ সিটি কর্পোরেশন ও উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদের কাছে সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের হেরে যাওয়ার ঘটনা।
মূলত তেলভিত্তিক রেন্টালের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ না হবে ততদিন এ সমস্যা থাকবেই। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো মানে মন্ত্রী-এমপিদের পকেট ভারি ও লুট-পাট।
মূলত তেলভিত্তিক রেন্টালের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ না হবে ততদিন এ সমস্যা থাকবেই। সমস্যা সমাধানে বিকল্প হিসাবে উৎপাদন খরচ কমাতে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে হবে। তেলভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিবর্তে কয়লাভিত্তিক (দেশী বা বিদেশ থেকে আমদানি) বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। তাহলেই বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসবে।
জিবলু রহমান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন