দৈনিক আমার দেশ, চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভিসহ অনেকগুলো গণমাধ্যম
একের পর এক সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক সাংবাদিককে থাকতে হচ্ছে অন্যায়ভাবে কারাগারে।
সাগর-রুনির হত্যাকারীদের বিচার দাবি করে চলা আন্দোলন প্রায় বন্ধ হতে চলেছে। প্রখ্যাত
সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ‘রক্তের ঋণ’ বইয়ে লিখেছেন স্বাধীনতার পরপরই বেশির ভাগ পত্রিকার সম্পাদক সরকারের অন্যায়
ও দুষ্কর্মের সাফাই গাইতেন নিজেদের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করার জন্য। এরই ধারাবাহিকতায়
দেখা যায় সব স্বৈরশাসন ও অগণতান্ত্রিক শাসনের সময়ে গণমাধ্যম তাদের পদ লেহন করে চলেছে।
আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, যেসব স্বৈরশাসক গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরেছেন যত
বেশি; গণমাধ্যমও তত বেশি তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
দেশে চলমান
অনেক সমস্যা সৃষ্টিতেও ভূমিকা রেখেছে গণমাধ্যম। সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রবণতা ভয়াবহ আকার
ধারণ করছে। গণজাগরণ মঞ্চ, হেফাজতে ইসলামসহ অনেক বিতর্কিত ইস্যুর জন্মদাতা
এই গণমাধ্যম। দেশে কোনো হত্যা কিংবা হামলার ঘটনা ঘটলেই কোনো রকম তথ্য-প্রমাণ ছাড়া গণমাধ্যম
বলে দিচ্ছে ওমুক লোক বা ওমুক গোষ্ঠী এর জন্য দায়ী। কিন্তু তদন্ত কিংবা বিচারে প্রমাণ
হচ্ছে ঘটনার সাথে জড়িত অন্য কেউ। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, ব্লগার রাজীব কিংবা নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যাÑ এ রকম অসংখ্য ঘটনা রয়েছে যেসব ঘটনায় গণমাধ্যম অনেককে জড়িয়ে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন
করেছে। সত্য ঘটনাটি যখন পাওয়া গেল মিডিয়া তখন সেটি প্রকাশে অনীহা প্রকাশ করল। ভোটারবিহীন
গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ও আমরা দেখেছি কিভাবে বেশির ভাগ গণমাধ্যম নৈতিকতা
ভুলে নির্বাচনকে জায়েজ করার চেষ্টা করেছে! নির্বাচনের পরও যেন মনে হয় ক্ষমতাসীনদের
বৈধতা দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছে গণমাধ্যম। নির্বাচনের আগেও জনমতকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার
চেষ্টা চালিয়েছে দেশের মিডিয়া।
নিরপেক্ষ
নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনকে সন্ত্রাসীদের আন্দোলন হিসেবে আখ্যা দিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন
তৈরি করেছে তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিচারে বিরোধীদের ওপর গুলি চালালেও
ক্ষমতাসীনদের দেয়া বক্তব্যকে তারা সমর্থন করেছে। বেশির ভাগ গণমাধ্যম এক দিকে বলছে বিরোধী
দল দাবি আদায়ের সমর্থনে কোনো কার্যকর আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারছে না, অন্য দিকে বলছে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, জানমালের কোনো নিরাপত্তাই নেই, বিদেশীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
স্ববিরোধী কথা বলে মিডিয়া সমাজে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। প্রতিবেশী দেশের সাথে স্বার্থসংশ্লিষ্ট
কোনো বিষয়েও গণমাধ্যম জনগণকে পরিষ্কার তথ্য দিতে দেখা যায় না। সরকার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের
সাথে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিংবা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো চুক্তি করছে কি না তা নিয়েও
একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট পর্যন্ত কোনো গণমাধ্যমকে করতে দেখা যায় না। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের
স্বার্থ রক্ষাই যেন গণমাধ্যমের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুশাসন
প্রয়োগ করতে হবে সর্বক্ষেত্রে; কিন্তু আমরা দেখেছি বিরোধীদের বিচারের নামে সুশাসন
প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দেশকে অশান্তির দিকে ঠেলে দেয়া হলো। দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার
কথা বলে দুর্নীতি জায়েজ করা হলো, দুর্নীতিবাজরা উল্টো আখ্যা পেল দেশপ্রেমিক হিসেবে।
নাস্তিকেরা শহীদ হিসেবে আখ্যা পেল। সন্ত্রাসীরা সোনার ছেলে হলো। বেশির ভাগ গণমাধ্যম
বরাবরই এসব ব্যাপারে নীরব। তাহলে গণমাধ্যম কি বোঝেনি ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত
করার কৌশল হিসেবেই এটাকে বেছে নিয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর অনেকের কাছে
জানা; আবার অনেকের কাছে জানা নয়। শহীদের আত্মার শান্তির জন্য গণমাধ্যম
রাতদিন কান্নাকাটি শুরু করল। পাপ মোচনের দায়িত্ব নিলো তারা। পাপ মোচন করতে গিয়েই শুরু
হলো দশম জাতীয় সংসদ নিয়ে অনিশ্চয়তা। যে পাপ মোচনের যুদ্ধে ক্ষমতাসীনেরা নেমেছে সে পাপ
তাদেরকেও ঘায়েল করতে পারেÑ এই আশঙ্কায়ই সবার অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে
দেয়া হলো না। গণমাধ্যম কখনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে দেখেনি ক্ষমতাসীনেরা মুখে মুক্তিযুদ্ধের
কথা বললেও তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে তাদের কতটুকু আন্তরিকতা রয়েছে। গণমাধ্যম প্রকাশ
করেনি বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারগুলো কী নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে! কত মুক্তিযোদ্ধা না
খেয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। কত মুক্তিযোদ্ধা রেললাইনের বস্তিতে রাতযাপন করছেন। তারা প্রকাশ
করেনি ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে কত মুক্তিযোদ্ধা ভিটেমাটি
হারাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
তোষামোদের
নির্লজ্জ উদাহরণ দেখা যায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াত নেতা এ
কে এম ইউসুফের মৃত্যুর দিন। বেশির ভাগ টেলিভিশন চ্যানেল ওই দিন তার মৃত্যুর খবরে ‘ইন্না লিল্লাহ’ পর্যন্ত বলেনি। এই নির্লজ্জ গণমাধ্যমগুলো জানে না
এই আরবি শব্দগুলো ইউসুফের বাবা কিংবা দাদাবাড়ি থেকে আমদানি করা হয়নি কিংবা জামায়াতও
আমদানি করেনি। এটি কুরআন শরিফের সূরা বাকারার ১৫৬ নম্বর আয়াতের অংশ। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার
হচ্ছে, অনেক সময় সরকার কিংবা মালিকপক্ষের চাপ না থাকলেও গণমাধ্যমের চাকরিতে
নিয়োজিত কর্মচারীরা নিজ উদ্যোগেই এ ধরনের কাজ করে বসছে। দেশের উন্নয়নে গণমাধ্যম ভূমিকা
না রাখলেও সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি নিশ্চয়ই গণমাধ্যমের কাজ নয়। অনেকেরই জানার কথা, সরকারের ভেতর আরেক সরকার দেশ চালাচ্ছে, কিন্তু তা নিয়ে একটি সিঙ্গেল
কলামও কোনো গণমাধ্যম লিখছে না। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হলেও তারা
এ বিষয়ে নীরব থাকছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন