রবিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৪

হিংসার অনলে জ্বলছে স্বাধীন জাতি-জনপদ


বিভাজন একটি জাতির সার্বিক দুর্দশাকেই চিহ্নিত করে। উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। যার শিকার বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশ নামক ভূখ-টি। শিক্ষায় বিভাজন, প্রশাসনে বিভাজন, সাহিত্যে বিভাজন, শিল্পকলায় বিভাজন, সংস্কৃতিতে বিভাজন, বিচার ব্যবস্থায় বিভাজন, ইতিহাসে বিভাজন, সাংবাদিকতায় বিভাজন আর রাজনীতির বিভাজনটি তো মহাশংকার কারণ হয়ে উঠে আসছে। বিভক্তি অধিকাংশ সময় অকল্যাণকেই প্রলম্বিত করে। স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। এত দীর্ঘ সময় পরও কোন কিছুতেই স্থিরতা নেই। অস্থির মনোভঙ্গি প্রতিটি পদক্ষেপে। এক প্রান্তে প্রভাত অনুভূত হলেও অন্যপ্রান্তে অন্ধকার। একদিকে নিরানন্দ অন্য অংশে আনন্দের হুল্লোড়। সুখ-অসুখ থাকবে, কিন্তু অসুখের অংশটি যদি পুষ্ট থেকে পুষ্টতরই হতে থাকে তবে তো আতঙ্ক-শঙ্কা অন্তরে বাসা বাঁধবারই কথা। প্রায় চার যুগ পার করে এসেও বাংলাদেশের জনগণ প্রকৃত স্বাধীনতার আস্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত কেবলি আতঙ্ক, কেবলি অস্থিরতা। বিশেষ করে রাজনীতির বিভক্তি বর্তমানে ঘরে ঘরে। যার বিষম ফল ভোগ করছে দেশের জনগণ। অশিক্ষা-কুশিক্ষা এবং মূর্খতা বিষয়টির আরও বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। ইতিহাসের সত্য গ্রহণে অনীহা এবং অসততা বিভক্তিকে আরও জটিল করে তুলছে। যে কারণে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শ্লোগানটি বিয়াল্লিশ বছরেও অপসৃত হয়নি বা হতে দেয়া হয়নি কোন উদ্দেশ্য হাসিলের অপেক্ষায়। কি সে অপেক্ষা, যে অপেক্ষার রজনীতে বাংলাদেশের মানুষ গত বিয়াল্লিশ বছর পর্যন্ত দিশাহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করছে? বিভেদের বিভীষিকায় বিভ্রান্ত হচ্ছে।
একটি বিশেষ গোষ্ঠী বিদ্বেষ এবং হিংসাকে চিরস্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত। তাই এই অপবিবেচনাকে সমাজের সর্বমহলে ছড়িয়ে দেবার নানা কৌশলে মত্তা। এই মত্ততা নতুন প্রজন্মের চিন্তা-চেতনাকেও প্রভাবিত করছে। এদের সংখ্যা সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশ হলেও বিদ্বেষ এবং হিংসা নামক দুর্গন্ধটি সুস্থ জনপদকে ক্রমশই ব্যাধিগ্রস্ত করে তোলে। যার প্রভাব সময় সময় বাংলাদেশে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠছে। সবচেয়ে পীড়াদায়ক সংবাদটি হলো, যে শ্রেণীটি বিদ্বেষ-হিংসা নামক সংক্রামক ব্যাধিটি বহন করে চলছে, তাদেরকে সমাজের বিবেক-বিবেচনা বলে প্রচার করে থাকে একটি মহল। তাছাড়া কোন কোন সময় দেখা যায়, এদের একটা বড় অংশ কৌশলে হোক বা অপকৌশলে হোক সমাজের বা দেশের চিন্তা-চেতনার স্থানগুলো দখল করে বসে আছে। যে কারণে সুচিন্তা, সুভাবনা বিভ্রান্তির চোরাজমিতে পথ হারায় মাঝেমধ্যে। এদের প্রভাবে এসে বিভ্রান্ত হয় নতুন প্রজন্মও। তাদের প্রচারিত প্রকাশিত অসত্য অর্ধ সত্যকেই মান্য করে। বিশ্বাস স্থাপন করে। এভাবেই বিকৃতি ঘটে ইতিহাসের। এভাবেই দিশাহীন হয় নতুন প্রজন্ম। হিংসা-বিদ্বেষকে আশ্রয় করেই বেড়ে ওঠে এরা। বিভেদের বীজটি অঙ্কুরিত হয় এ প্রক্রিয়ায়। যে কারণে বাংলাদেশে বিভাজনের টংকা স্বশব্দে ধ্বনিত হয় একশ্রেণীর বৃদ্ধ থেকে বালক অবধি। দেশপ্রেমে প্রচ-রকম অভাব এই সড়কটিকে প্রলম্বিত করছে প্রতিনিয়ত। কারণ বাংলাদেশীদের দেশপ্রেম মাছ-মুরগিতে এসে আটকে যাচ্ছে। সার্ট-প্যান্ট কসমেটিক চাই বিদেশী কিন্তু মাছ মুরগি চাই পাক্কা দেশি। দেশপ্রেমের কি পরাকাষ্ঠা!
দু’দিন পরই স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছরে পা রাখবে বাংলাদেশ। যে বয়স যৌবন অতিক্রম করে চিন্তা- চেতনায় স্থিরতা স্থাপনের বয়স। বাংলাদেশের অবস্থান এখন সে বয়সে। কিন্তু সার্বিক অবস্থার দিকে যদি নিবিড়ভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয় দেখা যাবে আচার-আচরণে বালকত্বের ঘাটই অতিক্রম করতে পারেনি অজ অবধি। কি বিচার বুদ্ধি, কি শিক্ষা সাহিত্য, কি কাজনীতি, কি রাজনীতি, কোথাও বয়সের ঘনত্ব অনুভূত হয় না। যারা নিজের স্বার্থকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ, তাদের বয়সের পরিমাপ করা অর্থহীন। এই অর্থহীন দিগভ্রান্তিতেই যেন বাংলাদেশের জনগণ পিষ্ট হচ্ছে।
একটি বলবান পরিবার ধ্বংস হয় যখন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আত্মকলহের সূত্রপাত ঘটে, বিভেদের বীজ অঙ্কুরিত হয়। তখন পরিবারটির উন্নতি সুখে বরাবরই কাতর সেই হিংসুটে প্রতিবেশী সুযোগ গ্রহণ করে। অন্তরের দুশমনীতে প্রীতির প্রলেপ মেখে এগিয়ে এসে কলহের প্রাঙ্গণটিকে আরো বিস্তৃত করার চেষ্টা করে। কলহে মত্ত পরিবারেরই কোন বৈরী সদস্যের আপনজন সেজে পরিবারটির দুর্বল দিকগুলোকে আরো দুর্বলের প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত হয়। হয়তো একদিন দেখা যায় সেই বৈরী সদস্যের নির্বুদ্ধিতা এবং আহম্মকিতে কোন কোন সময় ষড়যন্ত্রে এককালের আনন্দ উল্লাসের পরিবারটি নির্জীব হয়ে পড়ে। তখন আপনজন সাজা প্রতিবেশীর চেহারা উন্মোচিত হয়ে পড়লেও ঘুরে দাঁড়ানোর সময় আর অবশিষ্ট থাকে না, কপাল চাপড়ানো ব্যতিরেক। তখন বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি নিজে যেমন ভোগ করে সাথে সাথে গোটা পরিবারকেও দুর্দিন দুঃস্বপ্নে ডুবতে হয়। ইতিহাসে এরকম নজির অনেক। নবাব মীর কাশেম আলী খাঁ বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠ মীর জাফরের কুপরামর্শে নবাব সিরাজের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল। যখন উপলব্ধি এলো তখন মূল ষড়যন্ত্রকারীদের হত্যা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। দেশ-সংসারহারা নবাব মীর কাশেম আলী খাঁ অনাহার-অর্ধাহারে দিল্লীর শাহী মসজিদের দরজায় পরিত্যক্ত লাশ হিসেবে শায়িত ছিল। দেশ এবং জাতির আশা-আকাক্সক্ষার বিপক্ষে যেসব বিশ্বাসহন্তা মন এবং মেধাকে কাজে লাগায় ব্যক্তি স্বার্থে, তাদের পরিণতি কখনো শুভ হয় না। বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠ, রায় দুর্লভরা মুংগের দুর্গের চূঁড়া থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, মীরজাফর আক্রান্ত হয়েছিল কুষ্ঠরোগে। বিভেদ-ষড়যন্ত্রের তিক্ততায় দেশের স্বাধীনতা চালান হয়ে যায় ভিন্ন প্রাসাদে।
অব্যাহত কলহ-বিবাদ একটি জাতির ধ্বংসকেই অনিবার্য করে তোলে, সর্বনাশ ডেকে আনে। যারা জাতিসত্তায় এই বিভক্তির রূপকার তারা আসলে দেশ এবং জাতির চিহ্নিত শত্রু। এই শত্রুকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। হিংসা-বিদ্বেষ থেকেই বিভেদের জন্ম। অসত্য-অর্ধসত্য পাঠ থেকে সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তির শেষ পরিণতি বিভাজনে। বিভাজনের সাগরে যেন ভাসছে দেশ-দেশের মানুষ। তাই স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও অর্জনের ঝুড়ি প্রায় শূন্য। আনন্দ-উন্নতির পরিবর্তে সেখানে হিংসা-বিভেদের জাড়ক। একশ্রেণীর মানুষের নীচুতা বিভীষণীয় মনোভঙ্গী বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলেছে। এই জটিলতার জটাজালে ক্রমশই দেশ ও জনগণ আটকে যাচ্ছে। এই দুর্ঘট থেকে উদ্ধারের পথ ¯েœহ-মমতাকে জাগরুক রাখা। হিংসা ও নিচু মনোভঙ্গিকে পরিহার করা এবং ইতিহাসের সত্যকে প্রশান্তচিত্তে গ্রহণ করা। গ্রহণ এবং বর্জনে পরিমিতিবোধের অভাব বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে, উন্নতির সড়কগুলো আটকে দেয়। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশীদের সামনে এই অভাবটিই বর্তমানে প্রকট। একশ্রেণীর ক্ষমতালিপ্সু মানুষ-দল উদ্ভট সব কা- কারখানায় লিপ্ত হচ্ছে। তাদের প্রদর্শিত দেশপ্রেম ক্ষমতায় টিকে থাকার মহড়া মাত্র। অপশাসন-কুশাসনকে ঢেকে রাখার কৌশল সেটি। সেই কৌশলের একটি উজ্জ্বল মাত্রা হলো জাতিকে বিভক্ত করা, হিংসাকে বিস্তৃত করা। যে হিংসার অনলে দগ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশ, স্বাধীনতা। পরিণতিতে অঙ্গার হচ্ছে দেশের নিরীহ মানুষ, জনপদ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads