আওয়ামী লীগের মন্ত্রীসভায় সব সময় এমন কিছু লোক থাকে যারা নিজ মন্ত্রণালয়ের বাইরে অন্য মন্ত্রণালয়ের বিষয় নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটিতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাদের কাছে নিজ মন্ত্রণালয়ের খবর বলতে গেলে থাকেই না। এটি এখনকার কথা নয়। ১৯৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যখন ক্ষমতায় আসীন ছিলেন তখনও এমন কিছু মন্ত্রী ছিলো যারা সব সময় অন্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে নানারকম ফপর দালালী করতো। এতে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেন কড়া এক নিবন্ধ লিখেছিলেন। তাতে হেরফের কিছু হয়নি। ফপর দালালী জারি-ই ছিলো।
এখন দেখি নব্য আওয়ামী লীগ ও লীগের হাইব্রিড নেতাদের তেমন সবজান্তা কথাবার্তা। তেমন নেতা মাহবুবুল হক হানিফ ও হাসানুল হক ইনু। হানিফ এখন আর প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্রও নন। হাছান মাহমুদ বলে এক ভদ্রলোক গত আমলের মন্ত্রী ছিলেন। নানা ধরনের ফ্লপ। তিনি বাদ হয়ে গেছেন। কিন্তু কথার তুবড়ি বন্ধ হয়নি। শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অবিরাম উদ্ভট সব কথা তিনি বলেই যাচ্ছেন। আর ইনু জানেননা বা বোঝেননা এমন কোনো মন্ত্রণালয় নেই। তিনি সব বোঝেন। সব মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে মন্তব্য করতে পছন্দ করেন। তবে নিজের মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে তিনি কতোটা মনোযোগী ও দায়িত্বশীল সে প্রশ্ন তো আছেই।
তার মন্ত্রণালয়ের অধীন হলো সংবাদপত্র ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়া। তারা ‘আমার দেশ’ বন্ধ করেছেন অনেকদিন আগেই। এর প্রেসে কি যেনো এক অজ্ঞাত অনুসন্ধান কাজের জন্য তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। এরপর ইনু বারবার বলেছেন, তদন্ত কাজ শেষ হলেই আমার দেশ পত্রিকার প্রেসের তালা খুলে দেয়া হবে। আমার দেশ আইনি বিধান অনুযায়ী চুক্তির মাধ্যমে অন্য প্রেসে ছেপে পত্রিকাটি চালু করেছিলো। তখন তারা বললেন, সেটি বিধান মোতাবেক হয়নি। আর তাই সে ব্যবস্থাও রদ করে দেয়া হয়। এরপরে বন্ধ করে দেয়া হয়- দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি। তারা শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের উপর বর্বরোচিত হামলার ঘটনা কিছুক্ষণ সরাসরি সম্প্রচার করেছিলো। এরপর ইনু সাহেব বললেন, ঐ টিভি চ্যানেল দু’টো বন্ধ। সাময়িক। কতোদিনে এই ‘সাময়িক’ শেষ হবে বলা মুশকিল। এখন প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদকসহ তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সমন জারি করা হয়েছে। এদের ভাগ্যেও যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে সে সম্পর্কে তথ্যমন্ত্রী সাহেব এখনও কিছু বলেননি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে টিভি চ্যানেলগুলো পেশাগত দায়িত্বপালনের জন্যই দেখিয়েছিলো যে, সেখানে কোনো ভোটার উপস্থিত নেই। নির্বাচনী কর্মকর্তারা টেবিলে বসে ঝিমাচ্ছেন। কোথায়ও কোথায়ও আবার এসব কর্মকর্তাই ব্যালট পেপারে সিল মারছেন। তারপর সরকারের তরফ থেকে প্রচ্ছন্নভাবে জানিয়ে দেয়া হলো যে, এদেশের সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারের আকাঙ্খা অনুয়ায়ী ‘দায়িত্বশীল’ হতে না পারলে তাদের পরিণতিও আমার দেশ বা দিগন্তÍ টিভি ও ইসলামিক টিভির মতো হতে পারে।
সম্প্রতি হাসানুল হক ইনু নিজের মন্ত্রণালয় বাদ দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকা- সম্পর্কে বেশ চটকদার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। বিএনপি-জামায়াত নির্বাচিত সরকারকে নির্ধারিত সময়ের আগেই টেনে নামানোর চক্রান্ত করবে আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চোখ বন্ধ করে দেখবে তা হবেনা। দেশে বর্তমানে কোনো অগণতান্ত্রিক সরকার নেই। গণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে। তারপরও দেশে যা সমস্যা হচ্ছে- তা খালেদা জিয়ার তৈরি। খালেদা জিয়া আর জামায়াত মিলে দেশে গণতন্ত্রের বিঘœ ঘটাচ্ছে। পুলিশ বাহিনী দিয়ে বিরোধী দলীয় লোকজনের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে ইনু বলেন, জামায়াতের ছত্রছায়ায় যেসব জঙ্গী হত্যা ও খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে সেগুলোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বিএনপি নেতাদের বলবো, আপনারা সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করুন। তাহলে পুলিশ আপনাদের সন্ত্রাসী ও গু-াবাহিনী নিয়ে মাথা ঘামাবেনা। এর কোনো কথায় তার নিজের তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কথা নয়। সবটাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত। কথাগুলো যৌক্তিক না অযৌক্তিক সে প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওগুলো বললে যৌক্তিক হতো। পুলিশ কী করবে, করবেনা তার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর। তথ্যমন্ত্রীর নয়।
সর্ববিষয়ে মহা বিশেষজ্ঞ এই ইনু সাহেবের বক্তব্য যেদিন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে সেদিনের কাগজে একসঙ্গে অনেকগুলো ঘটনা প্রকাশিত হয়। তার শিরোনামগুলো হচ্ছে- ‘গুম-নিখোঁজ তদন্তে অনীহা’, ‘মুন্সিগঞ্জের নিখাঁজ আইনজীবীকে সিলেটে হত্যা’, ‘লক্ষ্মীপুরে স্বজনের অপেক্ষায় তিন পরিবার’, লাকসামে তিনমাসে খোঁজ নেই দুই শীর্ষ বিএনপি নেতার’, ‘র্যাব-পরিচয়ে অপহরণ : তিন সহোদরের ৭২ ঘন্টা’, ‘অপহরণ আতঙ্কের জনপদ ঝিনাইদহ’, ‘নড়াইলে টে-ার সিডিউল ছিনতাই’, দোহারে গণধর্ষণের শিকার কিশোরী’, এটা মাত্র একটি সংবাদপত্র থেকে নেয়া শিরোনাম।
পুলিশ কেনো গুম-নিখোঁজ তদন্তে অনীহা, তার বিস্তারিত বর্ণনা পত্রিকাটিতে ছাপা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার পরিচয়ে তুলে নেয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। কখনও কখনও সাদা পোশাকে কিংবা পুলিশ, র্যাবের পোশাকে রাতের অন্ধকারে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিলো না। পরিবারের লোকজন থানা, ডিবি কিংবা নিকটস্থ র্যাব কার্যালয়ে ছুটে যাচ্ছেন। তখন কেউ তাদের আটকের কথা স্বীকার যাচ্ছেন না। মাসের পর মাস গুম হয়ে থাকলেও তাদের উদ্ধারে তৎপরতা ও ঘটনা তদন্তে অনীহা দেখা যায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। এখন পর্যন্ত গুম হওয়া কোনো ব্যক্তিকে উদ্ধার করা যায়নি। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, গুম বা নিখোঁজের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত থাকায় তারা এ নিয়ে তদন্ত করেননা। এ কারণে অন্য অনেক অপরাধী গ্রেফতার হলেও গুম হওয়া কোনো ব্যক্তি উদ্ধার কিংবা এরসঙ্গে জড়িতরা কেউ গ্রেফতার হয়না।
ময়মনসিংহের ভালুকার একটি বাড়ী থেকে র্যাব পরিচয়ে একদল লোক তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু র্যাব কর্তৃপক্ষ তাদের আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে। ঘটনার চতুর্থ দিনে তাদের ছেড়ে দেয়া হলেও কারা তাদের তুলে নিয়ে গিয়েছিলো- এবিষয়ে কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশের মহাপরিদর্শক হাছান মাহমুদ খন্দকার বলেন, গুম বা নিখোঁজের বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জড়িত থাকার সুনির্দষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। আর অপহৃত ব্যক্তিদের বেশিরভাগ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য।
আগে বাসা থেকে নেয়ার পর লাশ পাওয়া গেলেও এখন নতুন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। এক এলাকা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর দূরের কোনো এলাকা বা নদী, জলাশয়ে তাদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে লাশ এমন স্থানে ফেলা হয় বা চেহারা এমনভাবে বিকৃত করা হয় যাতে লাশের পরিচয় শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অজ্ঞাত হিসেবে লাশ দাফন হয়ে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যরা কোনো তথ্যই জানতে পারেননা। বিএনপি দাবি করেছে, নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের ৬০ নেতাকর্মী গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজধানী ঢাকা শহরে ২১ জন। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তাদের তুলে নিয়ে গিয়েছিলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে। পরিবারগুলো থেকে দাবি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অপহৃত হয়েছে বলেই কোনো বাহিনীই তদন্তে গুরুত্ব দেয়না। এতে একটি সংস্থার হাতে অপর সংস্থা ধরাশয়ী হতে পারে। আর চমকপ্রদ কথা বলেছেন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্ণেল জিয়াউল আহসান। তিনি বলেন, গুম-নিখোঁজের কোনো অভিযোগ থাকলে র্যাব তা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে। অনেক সময় দেখা যায়, নিখোজ ব্যক্তিই অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকায় নিজেই পালিয়ে থাকে। ধরা পড়ার ভয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ না করায় পরিবারের সদস্যরা ভেবে নেয় যে, তাকে গুম করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, থানা পুলিশ তাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ের বিষয়টি জিডিতে উল্লেখ করতে নিষেধ করে। নিখোঁজ জিডি হিসেবে পুলিশ তা গ্রহণ করতে চায়। যাতে দেশের সবগুলো থানায় একটি বার্তা পাঠানোই তাদের একমাত্র কাজ। এর কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যায়। গত ৪ঠা ডিসেম্বর রাতে তেজগাঁও এর ২৫ নং ওয়ার্ড (সাবেক ৩৮) বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ সাত জনকে র্যাব পরিচয়ে দু’টি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার তিনমাস পেরিয়ে গেলেও তাদের কোনো সন্ধান দিতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ঘটনার পরপরই তার আত্মীয়রা ভাটারা ও তেজগাঁও থানায় জিডি করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু থানা পুলিশ র্যাব পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে লেখা দেখে জিডি নেয়নি। নিখোঁজ হিসেবে জিডি করলে নেয়া হবে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের জানান। কিন্তু তারা তাতে রাজী হননি। একই দিন পশ্চিম নাখালপাড়ার ৬৪০ নং বাড়ীতে একদল ব্যক্তি নিজেদের প্রশাসনের লোক পরিচয় দিয়ে তেজগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সম্পাদক এ এম আদনান চৌধুরীকে তুলে নেয়। আদনানের পিতা স্কুল শিক্ষক রুহুল আমিন চৌধুরী বলেন, তারা ঘরে তল্লাসীও চালায়। কিন্তু পরদিন থানা পুলিশ, র্যাব, ডিবি সবাই তুলে নেয়ার কথা অস্বীকার করে। তারপর থেকে আদনানের আর কোনো খোঁজ নেই। তিনি তেজগাও থানায় গিয়েছিলেন জিডি করতে। কিন্তু থানা র্যাব তুলে নিয়ে গেছে জানতে পেরে জিডি নেয়নি। এখন র্যাবও স্বীকার করছেনা। গত ২ ফেব্রুয়ারি সবুজবাগ থানা ছাত্রদল সভাপতি মাহবুব হাসান সুজন ও ২৮ নং ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি কাজী ফরহাদকে নারায়ণগজ্ঞের মুগরা এলাকা থেকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নেয়। এখনও তার কোনো হদিস মেলেনি।
এই যেখানে আইন-শৃঙ্খলার চিত্র সেইখানে পুলিশ চোঁখ বন্ধ করে থাকবেনা। আঙ্গুল চুষবেনা-এমন উক্তি তাদের একাজে আরও উষ্কে দেয়ার শামিল। বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের পুলিশ পেটাবে এটাকে যৌক্তিক মনে করেছেন ইনু সাহেব। আর জাসদের আরেক সাবেক সদস্য শাজাহান খান একেবারে স্পষ্ট করে বলেছেন, ক্রসফায়ারের দরকার আছে। অর্থাৎ বিনা বিচারে নরহত্যা একটি স্বীকৃত পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা ইনু সাহবদেরকে এই বলে সতর্ক করতে চাই যে, তারা যেনো ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়। তা নাহলে হয়তো তাদের অনেক চড়া মূল্য দিতে হবে।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন