বাংলাদেশে এখন ক্রিকেটের
বিশ্বযুদ্ধ চলছে। নাম এর টি-টোয়েন্টি। বাংলাদেশ দল সুপার টেন বা শীর্ষ দশটি দেশের
একটি হিসেবে খেলছে বলে শুধু নয়, স্বাধীনতার
মাসে শুরু হয়েছে বলেও বাংলাদেশ দলের খেলার ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ ও উৎসাহের কোনো
সীমা ছিল না। এখনও নেই। ক্রিকেট বুঝুক না বুঝুক, মাঠে গিয়ে বা টেলিভিশনের সামনে বসে খেলা দেখুক না দেখুক বাংলাদেশের
মানুষমাত্রই বাংলাদেশ দলের সাফল্যের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। তারা চায়, বাংলাদেশ দল প্রতিটি খেলাতেই জয়ী হোক।
এখানেই দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের এই আশা অবশ্য সব সময় পূরণ হয় না।
যেমনটি হয়নি গত ২৫ মার্চ। সেদিন খেলা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। দুনিয়া কাঁপানো
ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইল ছাড়া ভালো ক্রিকেটার খুব বেশি নেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের। তাছাড়া
দলটিকে বাংলাদেশ আগে হারিয়েছেও। সে কারণে মানুষের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু
নিরাশ করেছে বাংলাদেশের ‘টাইগাররা’। এখানে
বলে রাখা দরকার, আমার মতো অনেকেই
মনে করেন, সৃষ্টি জগতের
শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে ‘টাইগার’ তথা পশু বানিয়ে ফেলাটা শুধু অন্যায় নয়, বড় ধরনের গুনাহর কাজও। সে কাজটিই আমাদের
মিডিয়া কোনো রকম চিন্তা না করেই করে চলেছে। দু-একবার শুধু বাংলাদেশ বলার পরই বার
বার বলা ও লেখা হচ্ছে ‘টাইগার’ বা ‘টাইগাররা’।
টেলিভিশনের খবরে বা ধারাবর্ণনায় বলুন, কিংবা বলুন পত্রিকার রিপোর্টে সবখানেই শুধু ‘টাইগার’ আর ‘টাইগাররা’! এমনভাবে বলা ও লেখা হচ্ছে যেন ‘টাইগার’ বা বাঘ মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর! যুক্তি হিসেবে
বাঘের শক্তি ও গতিবেগের কথা বলা হয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলোয়াড়রাও বাঘের মতোই
দুর্দান্ত শক্তিশালী ও ক্ষিপ্রগতির বলে বোঝানো হয়। অন্যদিকে কথার পিঠেও কিন্তু কথা
রয়েছে। শ্রীলঙ্কা দলের কথাই ধরা যাক। ‘বনের রাজা’ সিংহ রয়েছে দেশটির জাতীয় পতাকায়। সে সিংহও
আবার যেমন-তেমন সিংহ নয়, তরবারি
হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে! তা সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা কিন্তু নিজেদের লায়ন
বা সিংহ হিসেবে পরিচয় দেয় না। কারণ, তারা জানে, ‘বনের রাজা’ হলেও সিংহ একটি পশুই মাত্র। মানুষের মতো
শ্রেষ্ঠ জীব নয়। ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ার উদাহরণও লক্ষ্য করা
দরকার। ক্যাঙ্গারু দেশটির জাতীয় পশু। কিন্তু আমরা যেভাবে ‘টাইগার’ নিয়ে মাতামাতি করি অস্ট্রেলিয়ানরা কিন্তু
তার ধারে-কাছেও যায় না। আমাদের আসলে লজ্জিত হওয়া উচিত। কারণ, মানুষকে পশু বানানোর মধ্যে গর্ব বা অহঙ্কার
করার কিছুই থাকতে পারে না।
কথাটা বিশেষভাবে মনে পড়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে খেলার
দিন, গত ২৫ মার্চ।
স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন হচ্ছিল বলে মানুষের আগ্রহ-উদ্দীপনাও ছিল অনেক বেশি।
কিন্তু প্রত্যেককেই সেদিন হোঁচট খেতে হয়েছে। টসে জিতে ‘টাইগাররা’ (!) ওয়েস্ট ইন্ডিজকে কেন ব্যাটিং করতে দিয়েছিল
সে প্রশ্নের জবাব এখনো পাওয়া যায়নি। সিদ্ধান্তটি অগ্রহণযোগ্য ছিল এজন্য যে, রান চেজ বা তাড়া করা এবং পরে ব্যাটিং করার
জন্য বিশেষ কিছু যোগ্যতার দরকার হয় আস্থার সঙ্গে মারমুখী ব্যাটিং করতে পারা এবং প্রচ- চাপের মুখেও আউট
না হওয়া যেগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ যোগ্যতা কেবল পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার রয়েছে।
ভারতের মতো ক্রিকেট পরাশক্তিকেও পরে ব্যাট করতে গিয়ে প্রায়ই পরাজিত হতে হয়।
অন্যদিকে আমাদের অতি ক্ষিপ্রগতির ‘টাইগাররা’ (!) ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আগে ব্যাটিং করতে দিয়ে
নিজেরা ফিল্ডিং বেছে নিয়েছিল। মাঠে নেমে বোলিংও তারা ভালো করতে পারেনি। ক্যাচ ছেড়ে
দেয়াসহ সব মিলিয়ে ফিল্ডিংও তারা খুবই বাজে করেছে। এ জন্যই ৪০-এর ঘরে এসে ক্রিস
গেইল আউট হয়ে গেলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্য ব্যাটসম্যানরা দলকে ১৭১ রানে পৌঁছে
দিয়েছিল। এটাও বিরাট কোনো টার্গেট ছিল না। কিন্তু কীর্তিমান ‘টাইগাররা’ (!) শুরু থেকেই প্যাভিলিয়নে ফিরে আসার অর্থাৎ
একের পর এক আউট হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। ‘ম্যাগনেট অ্যাকশন’ ধরনের পণ্যের বিজ্ঞাপনের মডেল তামিম ইকবাল
মাত্র পাঁচ রান করেই প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছে। ‘লাইফবয়’ সাবানসহ নানা পণ্যের ‘সুপার
মডেল’ এবং
প্রধানমন্ত্রীর সুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের পাশে বসে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার
জন্য নিন্দিত হওয়া আরেক ‘কৃতী’ ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান এমনকি একটি রানও
করতে পারেনি। প্রথম বলেই সোজা বোল্ড আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছে সে। অথচ এই
সাকিবই মাত্র কিছুদিন আগেও বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার ছিল! বিজ্ঞাপনের মডেল এবং সজীব
ওয়াজেদ জয়ের রাজনৈতিক শিষ্য হতে গিয়েই তার এতটা অধঃপতন হয়েছে কি না সে বিতর্কে না
গিয়েও বলা দরকার, সব মিলিয়েই ‘টাইগাররা’ (!) সেদিন জাতিকে নিরাশতো করেছেই, ৭৩ রানের বিরাট ব্যবধানে পরাজিত হয়ে
সীমাহীন লজ্জাও দিয়েছে। তারা এমনকি একশও করতে পারেনি, করেছিল মাত্র ৯৮ রান! এতটাই বাহাদুর ‘টাইগার’ তারা!!
এ পর্যন্ত এসে পাঠকরা ভাবতে পারেন, ক্রিকেটই হয়তো আজকের বিষয়বস্তু। আসলে তা
নয়। ক্রিকেট নিয়ে লিখতে হচ্ছে একটি বিশেষ কারণে। সে কারণ একটি স্লোগান। গ্যালারির
এক শ্রেণীর দর্শক সেদিন ‘জিতেগা, জিতগা বাংলাদেশ জিতেগা’ বলে বার বার চিৎকার দিয়ে উঠছিল। ‘জিতেগা’ শব্দটি যে হিন্দি ভাষার সে কথা নিশ্চয়ই
বলার দরকার পড়ে না। আপত্তির কারণ হলো, হিন্দি ভাষায় স্লোগান দেয়ার এবং ভারতের সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত অসংখ্য
সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশীরা বরং প্রমাণ করেছে, ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশটি কোনো অন্যায়, বঞ্চনা ও শত্রুতার সামনে মাথা নত করতে জানে
না। বস্তুত বাংলাদেশের জনগণ প্রচ-ভাবে স্বাধীনচেতা বলেই ‘পশ্চিম
পাকিস্তানীরা’ মুসলমান হওয়া
সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ হিসেবে এক রাষ্ট্র পাকিস্তানে থাকেনি।
মুসলমানদের ভাষা হিসেবে বর্ণিত উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেয়নি। কথাটা
বিশেষ করে স্বাধীনতার মাস মার্চে বলারও বিশেষ কারণ রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ভারতপন্থীদের প্রচারণা এবং আওয়ামী লীগ
সরকারের সুচিন্তিত কৌশলের পরিণতিতে ভারতের ব্যাপারে নতুন প্রজন্মের মধ্যে প্রবল
আগ্রহ ও আকর্ষণের সৃষ্টি হয়েছে। মূলত ভারতীয়দের ষড়যন্ত্রে এদেশেরই কিছু
ছদ্মবেশধারী রাজনীতিক ও তথাকথিত সুশীল সমাজ সাফল্যের সঙ্গে আগ্রহ সৃষ্টির কাজকে
এগিয়ে নিচ্ছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বোম্বের সিনেমা এবং স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো।
আমাদের ছেলেমেয়েরা টিভি ও সিনেমার চাকচিক্যে চমৎকৃত হচ্ছে। ভারতকে স্বর্গের
কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া কোনো দেশ মনে করে বিভ্রান্ত হচ্ছে। তাদের একটি অংশ এমনকি
বাংলাদেশকে স্বাধীন বা ভারতের বাইরে আলাদা একটি রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখারও কোনো
যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছে না!
অথচ পার্থক্য ও প্রকৃত অবস্থা বোঝার জন্য নিউইয়র্ক, লন্ডন বা প্যারিসের মতো দূরে কোথাও যাওয়ার
দরকার নেই, যে কেউ বাংলাদেশের
লাগোয়া নগরী এবং ভারতের রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী কলকাতায় গিয়ে দেখে আসতে
পারেন। সেটাও সম্ভব না হলে ‘দূরদর্শন’ টিভির কলকাতা কেন্দ্রের কিংবা ‘তারা
বাংলা’ বা ‘জি বাংলা’ ধরনের বাংলা টিভি চ্যানেলের নাটক এবং
কলকাতার সিনেমাগুলো দেখতে পারেন। দেখবেন, এগুলোর কোনোটিতেই বোম্বের সিনেমা-নাটকের মতো চাকচিক্যের ছিটেফোঁটাও
নেই। হতদরিদ্র অবস্থায় রয়েছে পশ্চিম বঙ্গের মানুষ নামে যারা বাঙালি, কিন্তু ‘বীর
বাঙালি’ নয় যেমনটি আমরা ছিলাম ১৯৭১ সালে। এসব সিনেমা-নাটকের
নায়ক-নায়িকারাও বাংলাদেশের কাউকে আকৃষ্ট করতে পারবে না। এটাই ভারতের আসল চেহারা, বোম্বের বিভিন্ন সিনেমা ও সিরিয়ালটা নয়।
সুতরাং চমৎকৃত বা আকৃষ্ট হয়ে নেচে ওঠারও কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। মাতামাতিটুকু
কেবল ধান্দাবাজরাই করে, ভারত
যাদের টাকা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চাকর-বাকরের মতো পুষছে।
আপত্তি ও উদ্বেগের কারণ শুধু বোম্বে ও কলকাতার সিনেমা-নাটকের
মধ্যকার পার্থক্য নয়। ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামজিক কারণগুলোও যথেষ্ট
গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ঘটনা ও উদাহরণেরই উল্লে¬খ করা যায়, যেগুলো থেকে প্রমাণিত হবে, মুসলমানদের প্রতি ভারতীয় হিন্দুদের মনোভাব
সেই ব্রিটিশ আমলের মতোই রয়েছে। যেমন কলকাতার মুসলিম প্রধান পার্ক সার্কাস এলাকাতেও
মুসলমানরা জুমার নামাজ আদায় করতে যান টুপি পকেটে নিয়ে। অনেকটা লুকিয়ে লুকিয়ে যেন মহা কোনো অপরাধ করতে যাচ্ছেন! কলকাতাসহ
পশ্চিমবঙ্গে মাইকে আযান দেয়া আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু কলকাতার কথাই বা বলা
কেন, ভারতের অন্য সব
অঞ্চলেও হিন্দুদেরই একচেটিয়া প্রাধান্য চলছে। সোনিয়া গান্ধীর মতো বিদেশিনী
খ্রিস্টান রমণীকেও নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করার আগে ব্রাহ্মণ পুরোহিত ডেকে এবং
হাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। মন্দিরে গিয়ে গলায় আঁচল
পেঁচিয়ে দেবীকে পেন্নাম করতে হয়। এসবই ভারতের রাজনীতিতে অবশ্য পালনীয় সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী থেকে মনমোহন সিং ও
নরেন্দ্রনাথ মোদি পর্যন্ত রাজনীতিকদের প্রত্যেককে হিন্দু ধর্মের বিধিবিধান মেনে
চলতে হয়। না হলে ভোট পাবেন না তারা।
কথাগুলো জানানোর উদ্দেশ্য এ কথা স্পষ্ট করা যে, এদেশের ভারতপন্থী রাজনীতিক ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সুশীলজনরা যতই বলুন না কেন, ভারত এখনো সর্বতোভাবে হিন্দুত্ববাদী
রাষ্ট্রই রয়ে গেছে। দেশটিতে বরং মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের বিপদ বাড়ছে দিন দিন। ভারতে
হিন্দু জঙ্গি-সন্ত্রাসীদেরও ব্যাপক হারে বিস্তার ঘটছে। ‘ভারত
কেবলই হিন্দুদের রাষ্ট্র’ এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী সেø¬াগান
মুখে ভারতজুড়ে ভয়ঙ্কর তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। এসব সংগঠনের সঙ্গে ভারতের সেনাবাহিনীও
প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের অনেকে হিন্দুত্ববাদী
জঙ্গি সংগঠনের নেতৃত্বও দিচ্ছেন। তাদের লক্ষ্য ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো।
কিন্তু ভারতের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী সংগঠন এবং তাদের নিষ্ঠুর কর্মকা-ের
ব্যাপারে বাংলাদেশের ভারতপন্থী মহল এবং সুশীলজনরা কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। তারা
বরং বোঝাতে চান যেন হিন্দু এবং ভারতীয়রা একেবারে ‘দুধে ধোয়া
তুলসি পাতা’! কথা শুধু এটুকুই
নয়। ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাসের আলোকে এবং
সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার পরিপ্রেক্ষিতেও যে কোনো পর্যালোচনায় পরিষ্কার দেখা
যাবে, বেইলী রোডের নাটক
পাড়া থেকে রামপুরার টিভি ভবন ও এফডিসি পর্যন্ত সংস্কৃতির অঙ্গনে তৎপর তথাকথিত ‘প্রগতিশীলদের’ বদৌলতেই বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে
ভারতের সর্বগ্রাসী আগ্রাসন সর্বাত্মক হতে পেরেছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশেও তারা
খুঁজে খুঁজে অমুসলিমদেরই প্রধান চরিত্র বানিয়ে নাটক-সিনেমা বানিয়েছেন। চরম
মুসলিমবিদ্বেষী খুনি-সন্ত্রাসীদের পর্যন্ত নায়ক বানিয়ে ওনারা মঞ্চায়নের সেঞ্চুরি
করেছেন কিন্তু শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের
দেশপ্রেমিক কাউকে নিয়ে কোনো কাহিনী তৈরি করার অনুগ্রহ করেননি। কারণ একটাই হিন্দির চামচামো করে তারা ভারতের সুনজরে
থাকতে চান। এজন্যই ভারত ও হিন্দির বিরোধিতাকারীরা তাদের মতে প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকÑ এমনকি পাকিস্তানের দালালও! দেশের অর্থনীতি
ও সংস্কৃতির সর্বনাশ ঘটিয়ে হলেও নিজেরা যে হিন্দির পাশাপাশি ভারতের দালালি করে
বেড়াচ্ছেন এতে কিন্তু দোষের কিছু নেই! এ সংক্রান্ত অসংখ্য উদাহরণ দেয়া সম্ভব।
সেদিকে যাওয়ার পরিবর্তে রাজনৈতিক দিকটিকে প্রাধান্যে
আনার পাশাপাশি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বলা দরকার, এই ভারতপন্থীরা এমন এক ভারতের দালালি করছেন, যে দেশটি কখনোই বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম
রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয়নি। এর প্রমাণও পাওয়া গেছে বিভিন্ন উপলক্ষে। মাঝে মধ্যেই
তারা কলকাতা থেকে সকালে যাত্রা শুরু করে বিকেলে ঢাকায় বসে চা খাওয়ার ইচ্ছার কথা
শুনিয়ে থাকেন। আসলে ভয় দেখিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত খুলে দেয়ার জন্য
নসিহত তো প্রায়ই করেন তারা। বর্তমান সরকারের আমলে আরো একটি কথাও শুনিয়েছেন
ভারতীয়রা। বলেছেন, ১৯৭১ সালে
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা দেয়ার বিনিময়ে ভারত যা কিছু পাওয়ার আশা করেছিল
সেসব পাওয়া শুরু হয়েছে এবং সবই পাওয়া যাবে যদি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা ও রাখা
যায়। লক্ষণীয় যে, নিজেদের ইচ্ছা ও
পরিকল্পনার ব্যাপারে কথায় কোনো ফাঁক রাখেননি ভারতীয়রাÑ যাদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরাও
রয়েছেন। তাদের মূল কথাগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করা দরকার। লগি-বৈঠার তা-ব
থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনে ভারতের ভূমিকা
সম্পর্কে এতদিনে সাধারণ মানুষও জেনে গেছে। এই সমর্থনের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ সরকারও
একের পর এক সকল বিষয়ে ভারতের ইচ্ছা পূরণ করে চলেছে। ট্রানজিটের আড়ালে সড়ক ও নৌপথে
করিডোর দেয়া থেকে যৌথ মহড়ার পাশাপাশি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের
ভারতের হাতে তুলে দেয়া পর্যন্ত সরকারের সকল পদক্ষেপের পেছনেই রয়েছে ভারতের ইচ্ছা
পূরণের উদ্দেশ্য। একই উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে দেশের ভেতরে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ
দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তিকে নির্মূল করার কার্যক্রম চালাচ্ছে সরকার।
সব মিলিয়েই বর্তমান পর্যায়ে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে জানানো দরকার, মূলত ভারতের মদদ ও ষড়যন্ত্রে এবং এদেশের
ভারতপন্থীদের উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই হুমকির মুখে ঠেলে দেয়ার ভয়ঙ্কর
কর্মকা- চলছে। একযোগে চলছে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টাও। এজন্যই
ক্রিকেটের মাঠে পর্যন্ত ‘জিতেগা, জিতেগা’ শুনতে হচ্ছে।
হঠাৎ শুনলে প্রশ্নের সৃষ্টি হতে পারে সত্য কিন্তু সব
মিলিয়ে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যখন অতীতের দিকে ফিরে যাওয়া এবং
স্বাধীনতার ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। বিশেষ করে ইতিহাসের সেই কারণ সম্পর্কে
জানানো দরকার, যা ‘জিতেগা’ সেøাগান দিতে ব্যস্ত বর্তমান
প্রজন্মের জানা নেই। সে কারণ বা ইতিহাস জানার জন্য চলুন ১৯৭১ সালকেও পেছনে ফেলে
দূর অতীতে ঘুরে আসি। বাংলাদেশ যে এক সময় ভারতের অংশ ছিল সে কথা ভাসা-ভাসাভাবে
জানলেও বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানে না, বাংলাদেশকে কেন বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। বেরিয়ে
আসার কারণ শুধু রাজনৈতিক ছিল না, এর সঙ্গে
ধর্ম ও অর্থনীতিও গভীরভাবে জড়িত ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের প্রদেশ ‘পূর্ব
পাকিস্তান’ হওয়ার আগে পর্যন্ত
বাংলাদেশ ছিল ভারতের বঙ্গ নামক কলকাতাকেন্দ্রিক প্রদেশের অংশ। পরিচিতি ছিল পূর্ব
বঙ্গ বা পূর্ব বাংলা নামে। পূর্ব বাংলা ছিল মুসলিম প্রধান। মূলত সে কারণে ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ভারতের সঙ্গে এ অঞ্চলের দ্বন্দ্ব ছিল
সব সময়। ব্রিটিশরা ভারত দখল করে নেয়ার পর এই দ্বন্দ্ব মিটে যাওয়ার পরিবর্তে
ক্রমাগত বরং বাড়তে থাকে। মুসলিম বিরোধী চিন্তা ও উদ্দেশ্য থেকে ব্রিটিশদের দালালি
করায় হিন্দুরা পুরস্কৃত হয়েছিল। দু-চারটি ছাড়া সব এলাকার জমিদারি পেয়েছিলেন
হিন্দুরা। মুসলমান কৃষকদের ওপর হিন্দু জমিদাররা নির্মম শোষণ-নির্যাতন চালাতেন।
মুসলমানরা এমনকি হিন্দু জমিদার বাড়ির আশপাশ দিয়ে জুতো পরে বা ছাতা মাথায় দিয়ে
যাতায়াত করতে পারতেন না। সব ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি চলে গিয়েছিল হিন্দুদের দখলে।
শিক্ষাতেও হিন্দুরাই একচেটিয়াভাবে এগিয়ে ছিল। সব মিলিয়েই মুসলমানরা ছিলেন
নির্যাতিত, উপেক্ষিত ও
পশ্চাৎপদ অবস্থায়।
úরিস্থিতিতে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ঊনিশ শতকের
মাঝামাঝি থেকে। সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮৫৭ সালের ‘সিপাহী
বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত
সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রাম বিকশিত হতে থাকে। পূর্ব
বঙ্গের মুসলমানরা এতে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেন। হিন্দুদের প্রাধান্য বহাল রেখে
মুসলমানদের পক্ষে যেহেতু উন্নতি-অগ্রগতি অর্জন করা একেবারেই সম্ভব ছিল না, সেহেতু মুসলিম প্রধান পূর্ব বঙ্গ ও
প্রতিবেশী রাজ্য আসামকে নিয়ে পৃথক একটি প্রদেশ গঠনের দাবিতে মুসলমানরা আন্দোলন গড়ে
তোলেন। আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গ প্রদেশকে দ্বিখ-িত
করে পূর্ব বঙ্গ ও আসামকে নিয়ে নতুন একটি প্রদেশ গঠন করে। ঢাকাকে এর রাজধানী করা
হয়। এটাই ইতিহাসে ‘বঙ্গভঙ্গ’ নামে পরিচিতি। এর ফলে ঢাকাসহ বর্তমান
বাংলাদেশের দ্রুত উন্নতি হতে থাকে। কিন্তু মুসলমানদের এই উন্নতি ও সম্ভাবনার
বিরুদ্ধে হিন্দুরা পাল্টা তৎপরতা শুরু করে। কারণ, হিন্দুদের দৃষ্টিতে এটা ছিল তাদের ‘বঙ্গমাতা’কে দ্বিখ-িত
করার পদক্ষেপ। কলকাতায় বসবাস করে পূর্ব বঙ্গের ওপর যারা শোষণ-নির্যাতন চালাতেন এবং
এখানকার অর্থবিত্ত লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়ে সেখানে বসে যারা নাচ-গান ও আনন্দ-ফুর্তি
করতেন, সেই হিন্দু
জমিদারদের প্রত্যক্ষ সাহায্যে ও উস্কানিতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- দুর্বার হয়ে ওঠে।
হিন্দুরা একে সন্ত্রাসবাদী ‘আন্দোলন’ নাম দেয়। জমিদার নন্দন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ
সময়ই পূর্ব বঙ্গকে পৃথক প্রদেশ করার প্রতিবাদে ‘আমার
সোনার বাংলা’ গানটি রচনা
করেছিলেন, যেটা এখন স্বাধীন-সার্বভৌম
রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।
‘আন্দোলন’ নামের এই সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-ে ভীত হওয়ার
অভিনয় করে মূলত ও সর্বতোভাবে মুসলিমবিরোধী ব্রিটিশ সরকারও হিন্দুদের ইচ্ছার কাছে
নতি স্বীকার করে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়, ঢাকাসহ পূর্ব বঙ্গ আবারও কলকাতার এবং হিন্দুদের অধীনস্থ হয়ে পড়ে।
হিন্দুদের মধ্যে ‘বঙ্গমাতা’র জন্য প্রীতির যে লেশমাত্র ছিল না এবং
মুসলিম বিদ্বেষই যে বিরোধিতার প্রধান কারণ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে একটি বিশেষ
ঘটনায়। সন্ত্রাসের অভিযোগে প্রায় দেড়শ’ বছরের রাজধানী কলকাতাকে পরিত্যাগ করে ব্রিটিশ
সরকার এ সময় দিল্লী¬কে ভারতের রাজধানী বানিয়েছিল। কিন্তু হিন্দুরা কোনো
প্রতিবাদই করেনি, রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর বরং উল্টো ব্রিটেনের রাজাকে ‘ভাগ্য বিধাতা’ এবং ‘জয় হে, জয় হে’ বলে বিনয়ে বিগলিত হয়ে নতুন একটি গান
লিখেছিলেন। সে গানটিই ভারতের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে মুসলমানদের
হিন্দু ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলতে থাকে। পর্যায়ক্রমে সেটাই মুসলমানদের পৃথক
আবাসভূমি বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব
ছিল এর ভিত্তি। লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনও করেছিলেন এদেশেরই এক কৃতীসন্তান তিনি তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী, ‘শেরেবাংলা’ আবুল কাশেম ফজলুল হক। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট
পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ছিল মুসলমানদের সে দাবি ও আন্দোলনেরই সফল পরিণতি।
‘পশ্চিম পাকিস্তান’কেন্দ্রিক
শাসক-শোষক ও জেনারেলদের কারণে পাকিস্তান কেন টিকে থাকতে পারেনি এবং আমরা কিভাবে
সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি সে ইতিহাস সবারই জানা। এর মূল
কারণও শুধু রাজনৈতিক ছিল না। অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও শোষণের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছিল
ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতি। ভাষা আন্দোলনের কারণ ছিল উর্দুর প্রাধান্য প্রত্যাখ্যান করে
বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা এবং সে মর্যাদা ও অবস্থানকে সমুন্নত রাখা।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সার্বভৌম
বাংলাদেশে এখন ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দিতে ‘জিতেগা, জিতেগা বাংলাদেশ জিতেগা’ সেøাগানও শুনতে হচ্ছে!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন