মঙ্গলবার, ৪ মার্চ, ২০১৪

রাজনীতির ভাষা ও গণহত্যার হুমকি


আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপিরা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কিনা তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দীর্ঘকালের। সংসদ কিংবা সংসদের বাইরে তাদের কথাবার্তার ধরন, ভাষার ব্যবহার, আদব-কায়দা, রুচি-সংস্কৃতি আমাদের স্তম্ভিত করে দেয়। কোনো সুস্থ মানুষ যে এ ধরনের কথা বলতে পারে- সেটি এদেশের শিক্ষাবঞ্চিত সাধারণ মানুষরাও কল্পনা করতে পারেন না। ঢাকায় এসে আমি প্রথম পুরান ঢাকার বাসিন্দা ছিলাম। থাকতাম মেসে। গোসল করা, কাপড় ধোয়া সবই ছিলো ওয়াসার বারোয়ারি পানির লাইনে। সেখানে আগে থেকেই শত শত কলসির লাইন থাকতো। কলসিতে বুয়াদের পানি নেয়া শেষ হলে গোসল করা, কাপড় ধোয়া এসব কাজ আমাদের করতে হতো। ফলে অপেক্ষা সেখানে স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো। পানি নেয়া নিয়ে বুয়াদের মধ্যে ঝগড়া ছিলো নিত্যকার ব্যাপার। তখন তারা এমন সব ভাষায় পরস্পরকে আক্রমণ করতো যে, সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হতো না। আমরা ছুটে দূরে সরে যেতাম। কখনও কখনও কানে আঙুলও দিতে হতো।
ঐ এলাকা থেকে চলে আসার পর এমন ভাষায় পরস্পরকে আক্রমণ করার ঘটনা অন্তত আমার চোখের সামনে আর কখনও ঘটেনি। ইদানীং আবার সেরকম ভাষায় বিভিন্ন মহল থেকে শুনতে পাচ্ছি। সেটা জাতীয় সংসদে কিংবা জনসভায়। অপরকে সম্মান না করলে যে নিজেও সম্মান পাওয়া যায়না এই সাধারণ জ্ঞানটুকু আমরা হারিয়ে ফেলেছি। কেউ যদি কাউকে অশালীন ভাষায় গালি দেয়, তাহলে গালি খাওয়া লোকটিও যে ততোধিক অশালীন ভাষায় গালি দিয়ে বসবে কিংবা দেয় সেটি আমরা বিবেচনায় নিতে চাইনা। খুব ব্যক্তিগত জীবনে নিজের ঘরের ভেতরে ছোটখাটো ঝগড়া বিবাদে যে আমরা পরস্পরকে গালি দেয়না এমনটি না। কিন্তু সেরকম গালি দিতেও আমরা কতোটা সংযত থাকি যে, যাতে আশপাশের কেউ তা শুনতে না পায়। কেনো এরকম করি? তার কারণ হলো প্রতিবেশীদের বা আশপাশের লোকদের আমার সম্পর্কে একটা ইতর ধারণার সৃষ্টি হতে পারে। সেরকমটি আমরা কেউই চাইনা।
এখন মূল্যবোধের সেই সামান্য দেয়ালটুকুও মুছে গেছে। জনসভা কিংবা জাতীয় সংসদের মতো পবিত্র অঙ্গনে দাঁড়িয়েও আমরা অকপটে কলতলার বুয়াদের মতো গালি দিতে কুণ্ঠাবোধ করিনা। সম্ভবত আমরা মনে করি যে, যতো কড়া ভাষায় গালি দিতে পারবে জনগণের কাছ থেকে সে ততোটাই বাহবা পাবে। জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে কেউ যদি জিয়াউর রহমানকে রাজাকার বলে তবে তাকে ভাবতে হবে যে, এর প্রত্যুত্তরে অন্য কেউ শেখ  মুজিবকেও রাজাকার বাহিনীর কমা-ার হিসেবে গালি দিতে পারবে। কা-জ্ঞানের মাত্রা এতোটাই ছাড়িয়ে গেছে যে, বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমকে আওয়ামী লীগের এক নেতা রাজাকার বলে অভিহিত করে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের দাবি করলেন। জবাবে কাদের সিদ্দিকী বললেন, আমি যদি রাজাকার হয়ে থাকি তবে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাজাকার বাহিনীর কমা-ার। কাদের সিদ্দিকীর মুজিব-ভক্তি প্রশ্নাতীত। সেটা দু’ভাবে সত্য। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ যখন আওয়ামী লীগের নেতারা প্রাণ নিয়ে ভারতের দিকে ছুটে গেছেন, তখন কাদের সিদ্দিকী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য টাঙ্গাইলের বন-বাদাড়ে ঘুরে শক্তিশালী কাদেরিয়া বাহিনী গঠনে ব্যস্ত ছিলেন। তারপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখেন। যে কারণে জনগণ তাকে ‘বঙ্গবীর’ বলে সম্মান দিয়েছে। তেমনি শেখ মুজিবুর রহমানও তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করেছেন। দ্বিতীয়ত; ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা-ের পর কাদের সিদ্দিকী পূনরায় একটি বাহিনী গঠন করে যুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তারপরও যখন তাকে আওয়ামী লীগের নেতারা রাজাকার বলে তখন আমাদের ধারণা ছিলো যে, আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হবে। বিশেষ করে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদের ভেতর থেকে। কিন্তু সেরকম কোনো প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়নি। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে গেছে কেউ আওয়ামী লীগ না করলে সে স্বাধীনতা বিরোধী। এর উপরে কাদের সিদ্দিকীর আর এক অপরাধ হলো, তিনি আল্লাহ-ভক্ত মানুষ। নিয়মিত নামাজ, রোজা করেন। বাংলাদেশে এখন এর চাইতে বড় অপরাধ আর কিছু নেই। কেউ যদি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হয়ে থাকে তাহলে সে কেনো নামাজ, রোজা করবে? টুপি মাথায় দেবে? সঙ্গে জায়নামাজ রাখবে? এর চাইতে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে। অর্থাৎ কাদের সিদ্দিকী, তুই যতোবড় বঙ্গবীরই হোসনা কেনো, যতোবড় বীর উত্তমই হোসনা কেনো, তুই রাজাকার।
জাতীয় সংসদে আমরা আওয়ামী লীগের ভাষা লক্ষ্য করেছি। তারা সরকারি দলেই থাকুক আর বিরোধী দলেই থাকুক ভাষা ব্যবহারে অশ্লীলতার কোনো কমতি তাদের মুখে কখনও ছিলোনা। এখনও নেই। বিএনপি যখন বিরোধী দলে ছিলো তখন বেগম খালেদা জিয়া ও জিয়াউর রহমান এবং বিএনপি’র অন্যান্য নেতা সম্পর্কে যে অশ্লীল কথা প্রয়োগ করা হতো তা শোনার জন্য সেখানে উপস্থিত থাকা বিএনপি’র পক্ষে সত্যি কঠিন ছিলো। আমরা সাধারণ মানুষেরা টিভিতে লাইভ দেখে বা পত্রিকায় পড়ে বিস্মিত হয়েছি। এগুলো মানুষের ভাষা? কোনো ভদ্রলোকের ভাষা? কোনো জনপ্রতিনিধির ভাষা?
ব্যক্তি হিসেবে আমরা সাধারণ মানুষেরা যতো খারাপই হইনা কেনো আমাদের নেতানেত্রী হিসেবে যারা আসেন তাদের কাছ থেকে এমন ভাষা আমরা আশা করিনা। ’৭০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছিলেন গ্যারি হার্ট। নির্বাচনে তার বিজয়ও সুনিশ্চিত ছিলো। কিন্তু গ্যারি হার্ট নির্বাচনী প্রচারাভিযানের মাঝখানে তার এক বান্ধবীকে নিয়ে গভীর অরণ্যে কিছুটা নিভৃত সময় কাটাতে গিয়েছিলেন। পত্রিকার ক্যামেরাম্যানরা সেই অরণ্যে গিয়ে গ্যারি হার্ট ও তার বান্ধবী ডোনা রাইসের ছবি তুলে ছাপিয়ে দিয়েছিলো। আর যায় কোথায়। গোটা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে তার কঠোর সমালোচনা শুরু হয়। এমন ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা যায়না। কারণ তিনি তার স্ত্রীর প্রতি ছিলেন অসৎ। তখন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক পত্রিকা সাধারণ মার্কিনীদের জীবনাচরণ নিয়ে জরীপ পরিচালনা করে। তাতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ৮০ শতাংশ নাগরিক হয় ব্যভিচারী অথবা ব্যভিচারী হতে চান। তাহলে তারা কেনো গ্যারি হার্টের বিরোধিতা করলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ঐ নাগরিকরাই বলেছিলেন যে, আমরা খারাপ হতে পারি। কিন্তু আমাদের যিনি নেতা হবেন তাকে তো খারাপ হওয়া চলবে না। অর্থাৎ খারাপ না হওয়া বা ভালো মানুষ হওয়া নেতৃত্বের একটা গুণ। বাংলাদেশে সে গুণ শূন্যের কোঠায় গিয়ে পোঁছেছে। সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে জনপ্রতিনিধিত্বহীন এমপি শেখ সেলিম পর্যন্ত সত্য।
গত ২রা মার্চ ঢাকার এক সমাবেশে বক্তৃতাকালে শেখ সেলিম বলেছেন যে, এবার আন্দোলনের নামে যারা নাশকতা করবে তাদের হাত-পা কেটে দেয়া হবে। অর্থাৎ প্রকাশ্যে শত শত মানুষকে হত্যার হুমকি দিলেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তাহলে কতো লোককে হত্যা করবেন? ছাত্ররা আন্দোলন করছে হল উদ্ধারের জন্য। অনেক ক্ষেত্রেই তা সহিংস। তাদের সাথে শিক্ষকরাও যোগ দিয়েছেন। তবে কি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষককে শেখ ফজুলল করিম সেলিম হাত-পা কেটে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিবেন। গার্মেন্টস শ্রমিকরাও আন্দোলন করছে। কখনও কখনও আগুন জলছে। কখনও কখনও মহাসড়ক অবরোধ করছে। কখনও কখনও ভাঙচুর করছে। সহজ ভাষায় সহিংসতা। তবে কি শেখ সেলিম এই হাজার হাজার শ্রমিকের হাত-পা কেটে দেবেন? আন্দোলন করছেন রাজনীতিবিদরা। সে আন্দোলন গণতন্ত্রের জন্য। প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের জন্য। লুণ্ঠিত মানবাধিকারের জন্য। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারাণ্টির জন্য। এরা লাখে লাখে। শেখ সেলিমরা কি তবে এই লক্ষ লক্ষ মানুষের হাত-পা কেটে নেবেন? এর আগে মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী মন্তব্য করেছিলেন যে, সরকারের বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করবে বাড়ী বাড়ী ঢুকে তাদের হত্যা করা হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আন্দোলন দমাতে যতোটা কঠোর হওয়া দরকার সরকার ততোটাই কঠোর হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, আসামী হলেই ক্রসফায়ার। কিংবা বাণিজ্যিক কারণে ক্রসফায়ার। অর্থাৎ ঘোষিত হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। আদালতে কেউ বিচার চাইবে কিনা জানিনা। কিন্তু মহামান্য আদালতের কাছে আমরা কি এমন প্রার্থনা করতে পারি যে, এরকম গণহত্যার হমকি যারা দেয় আদালত কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে?
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads