শনিবার, ১ মার্চ, ২০১৪

আবারো নির্বাচনী তামাশা


৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে প্রহসনের পর বাংলাদেশে আবারো একধরনের নির্বাচনী তামাশা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। সেটি উপজেলা নির্বাচন নিয়ে। এর আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৩৫টি আসনে জয়ী হয়েছিল। অপর দিকে বিএনপি ৪৪টি আর জামায়াত ১৩ আসনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিএনপি ৭২টি, আওয়ামী লীগ ৬১টি ও জামায়াত ৩০ আসনে বিজয় লাভ করেছে। ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন অবশ্যই আছে। জন্মান্ধনির্বাচন কমিশন সেসব আমলে নেয়নি। আওয়ামী লীগ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থেকে ধরেই নিয়েছিলÑ উন্নয়নের যে জোয়ারতারা সৃষ্টি করেছে, তাতে জনগণ ভোট দিয়ে তাদের ভাসিয়ে দেবে।
আর তাই নির্বাচনের আগে থেকেই এক এলাহি কাণ্ডঘটল বাংলাদেশে, যা দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনেও অব্যাহত ছিল। এর ভিত্তিতে বলা যায় যে, ভবিষ্যৎ নির্বাচনগুলোতেও সে ধারা হয়তো অব্যাহত থাকবে। নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই বিএনপি-জামায়াতসহ ১৯ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করা শুরু হয়। অজ্ঞাত পরিচয় আসামিধরার নামে দিন-রাত অভিযান চালানো হয়েছে গ্রামগঞ্জে। এর ফাঁকে ব্যাপক হারে চলে গ্রেফতারবাণিজ্যও। ফলে গ্রাম-গ্রামান্তরে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। শুধু যে রাজনৈতিক কর্মীরাই এই হয়রানির শিকার তা নয়, এমনকি নির্বাচনের প্রার্থীদেরও নানা অভিযোগে গ্রেফতার করা হতে থাকে। নির্বাচনকালে এই এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের হাতে চলে আসার কথা। কিন্তু এক কমিশনার বলে বসলেন, গ্রেফতার করা-না-করা সরকার বা পুলিশের কাজ। এ ক্ষেত্রে তাদের নাকি কোনো দায়িত্ব নেই। তাদের দায়িত্ব শুধু নির্বাচন করা। সে নির্বাচন তারা করছেন। তখনই অনুমান করা গিয়েছিল দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ দফার নির্বাচনে বস্তুতপক্ষে কী ঘটতে যাচ্ছে।
আর ঘটলও অনেকটা তাই। গত ২৭ তারিখের নির্বাচনের আগে পুলিশ ও সরকারি দলের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী একইভাবে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী প্রার্থীদের ওপর হামলে পড়তে শুরু করলে নির্বাচন কমিশন পূর্ববৎ নির্বিকারই রইল। ভাবটা এমন, নির্বাচন একটা করে দিতে পারলেই হলো। সে নির্বাচনে জনগণ নিরাপদে ভোট দিতে পারল কি পারল না, সে দায়িত্বও কমিশন গ্রহণ করতে নারাজ। সরকার যা খুশি তাই শুরু করে দিলো। বিরোধী দলের প্রচারণায় বাধাদান, ভোটারদেরকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, গুম, খুনÑ এগুলোর ধারা অব্যাহতই রইল। নির্বাচন কমিশন মুখে যথারীতি কুলুপ এঁটে থাকল। দ্বিতীয় দফায় উপজেলা নির্বাচনের কয়েক দিন আগে থেকেই ক্ষমতাসীনমহল যেন একেবারে মরিয়া হয়ে উঠল ভোটের ফলাফল ছিনিয়ে নেয়ার জন্য। এটি ঘটল সবার চোখের সামনেই।
নির্বাচনের দিন ঘটল আরেক কাণ্ড। সকাল থেকেই পুলিশ, বিজিবি, মিলিটারির সামনে আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী বিভিন্ন জেলায় কেন্দ্রের পর কেন্দ্র দখল করে নিতে থাকে। তার আগের রাতে বিরোধী দলের অনেক চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মিবাহিনী শয়ে শয়ে গ্রেফতার হয়ে যায়। সকালে আওয়ামী ক্যাডাররা দলে দলে বিভক্ত হয়ে পথের মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড বসিয়ে দিলো ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে যেতে না পারে। কেন্দ্রে কেন্দ্রে চালানো হলো ব্যাপাক বোমা হামলা। তার পর একটা একটা করে ভোটকেন্দ্র দখল করে নিয়ে তারা পাইকারি হারে আওয়ামী প্রার্থীর অনুকূলে সিল মারতে থাকল। এসব জায়গায় সারা দিন বলতে গেলে ভোটকেন্দ্র ছিল ফাঁকা। ১৯ দলীয় জোট এ অবস্থায় অনেক এলাকায় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে আজ কিংবা কাল ডেকেছে হরতাল। টেলিভিশন পর্দায় আমরা আওয়ামী ক্যাডারদের সশস্ত্র হামলা আর ভোট ডাকাতির ছবি দেখলাম। শুধু দেখল না নির্বাচন কমিশন। এভাবেই উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সবার চোখের সামনে এসব ঘটনা ঘটার পরও দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। ২৮ ফেব্রুয়ারির পত্রিকাগুলোর নগর সংস্করণে ১১৫টির মধ্যে ১১০টির ফল প্রকাশিত হয়। সে ফলের ক্ষেত্রেও হেরফের আছে। তবু দেখা যায়, বিএনপিসমর্থিত প্রার্থী ৫২ উপজেলায়, আওয়ামী লীগসমর্থিত প্রার্র্থী ৪৪ উপজেলা, জামায়াতসমর্থিত প্রার্থী আট উপজেলায় বিজয়ী হয়েছেন। একটিতে জাতীয় পার্টি। বাকিগুলোতে স্বতন্ত্রপ্রার্থী। এটিও এক দিক দিয়ে অবিশ্বাস্য। যদি কেন্দ্র দখল করা না হতো, যদি হানাহানি-খুনোখুনি না করা হতো, যদি বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী ও প্রার্থীদের র‌্যাব-পুলিশ দিয়ে দৌড়ের ওপর না রাখা হতো, অর্থাৎ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে এখানে আওয়ামী লীগ ১০-১৫টি আসনে জয়ী হতো কি না অনেকেরই সন্দেহ।
এতসব কাণ্ডের পরও নির্বাচন কমিশন নির্বিকার। সামনের দিনগুলোতে কমিশনের এই নির্বিকারত্ব ও নিষ্ক্রিয়তা ব্যাপক হানাহানি ডেকে আনতে পারে। দেশ চলে যেতে পারে নৈরাজ্যের দিকে। এটুকু দায়িত্ববোধ বা কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয়ও নির্বাচন কমিশন দিতে পারেনি। সরকারের হিসাবানুযায়ী তারা কার্যত জো হুকুম, জাঁহাপনাবলে তৃপ্তির ঢেঁকুরই তুলে যাচ্ছে। তারপরও মিডিয়ায় মুখ দেখাচ্ছেন কেমন করে, সেটাও এক বিস্ময়। বিএনপির যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ সঠিকভাবেই পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তারা সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় ও পাহারা দিচ্ছেন।সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দিলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো নীরব-নির্বিকার থাকার অভিযোগ এসেছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে জানা গেছে।
জামায়াত প্রসঙ্গে আসা যাক। সরকার মনে করেছিল, মেরে-কেটে আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে একেবারে ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু ধ্বংস তো হয়ইনি, বরং সরকারের খামোখা নির্যাতনের কারণে রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা আরো বেশি সুসংগঠিত হয়েছে এবং জনগণের সহানুভূতি পেয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। ফলে জামায়াত এ পর্যন্ত শত শত ভোট কারচুপি, ডাকাতি, জালিয়াতি-চালিয়াতি-নির্যাতন সত্ত্বেও ২১ জেলায় চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান পদে তাদের বিজয়ী প্রার্থীর সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতে এখানে আরো পালক যে যুক্ত হবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথম দফা নির্বাচনের পর সাংবাদিকেরা নতুন মুজিবকোটধারী আওয়ামী মন্ত্রী-নেতাদের জিজ্ঞেস করেছিলেনÑ জামায়াত কেন এত ভোট পেল? জবাবে ওইসব হাইব্রিড নেতা সাংবাদিকদের ওপরই ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন। জামায়াত কেন এত ভোট পেল, জনগণ কেন তাদের এমন বিপুল সংখ্যায় ভোট দিলো, এ ব্যাপারে তারা গিয়ে জনগণকেই জিজ্ঞেস করার পরামর্শ দিয়েছেন।
সবাই জানিয়েছেন, জামায়াতকে ধ্বংস করার জন্য, নির্মূল বা নিশ্চিহ্ন করার জন্য এমন কোনো অগণতান্ত্রিক পথ নেই যে পথে সরকার অগ্রসর হয়নি। এক অখ্যাত সংগঠন এক জরিপ রিপোর্টে জানিয়েছে, আলকায়েদার পর জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির হলো সবচেয়ে বড় জঙ্গি দল। আর দেশের সরকারসমর্থক পত্রিকাগুলো তা নিয়ে কী যে মাতামাতি, তা বলে শেষ করা যাবে না। অথচ এ জরিপের আগে কেউ কোনো দিন ওই সংগঠনের নামও শোনেননি। কিন্তু বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো যখন সরকারের ধারাবাহিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার, বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যখন সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বলে অভিযুক্ত করে, যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের মান নিয়ে প্রশ্ন করে, যখন সরকারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের হুমকি পর্যন্ত দেয়; তখন এসব মিডিয়া এর কারণ খতিয়ে না দেখে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। এই ভূমিকা গোটা বাংলাদেশের মিডিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষাকারী সংগঠনগুলো বাংলাদেশের মিডিয়াকে বাধ্য হয়ে বা স্বেচ্ছায় সরকারের তাল্পিবাহীহয়েছে বলে সমালোচনা করছে।
মিডিয়ার যে দুর্বলতা এখন বাংলাদেশে, তা আগে কখনো দেখা যায়নি। আগে দলমত নির্বিশেষে সাংবাদিকদের ঐক্য ছিল। সব মতপ্রকাশের জন্য সবাই একযোগে কাজও করেছেন। এখন সরকারসমর্থক নয় এমন পত্রিকা বন্ধ হলে, এমন টিভি চ্যানেল জবরদস্তিমূলকভাবে বন্ধ করে দিলে, অন্য মিডিয়াগুলো চোখ বন্ধ করে রাখে। এতটা দেউলিয়াপনা এর আগে বাংলাদেশে আর কখনো দেখা যায়নি। ফলে সরকার যখন তাদের অপছন্দের দলগুলোর ওপর হামলে পড়ে, তখন কিছু মিডিয়া যেন একেবারেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে থাকে। যেন ভাবটা এমনÑ মেরেছে, বেশ করেছে। আরো মারা উচিত। মেরে শেষ করে দেয়া উচিত।
কিন্তু দিন সব সময় এক রকম থাকে না। পরিস্থিতি যখন পরিবর্তন ঘটবে, তখন এখনকার বগল বাজানেওয়ালারাও একই পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন। সেই দিন হয়তো তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো লোক পাওয়া যাবে না। মানবাধিকার, মানবাধিকারই। এর সাথে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত-শিবির কি না, তা যোগ করলে মানবাধিকার থাকে না। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ (ন্যাপ) একবার পল্টন মোড়ে বক্তৃতা দিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, যে গণতন্ত্র চীন-পাকিস্তানেরচর মওলানা ভাসানীকে কথা বলতে দেয়, সে গণতন্ত্রের মুখে লাথি মারি। এটি তিনি বলেছিলেন শেখ মুজিব বা আওয়ামী লীগকে তোষণের জন্য। কিন্তু একই মুখে কয়েক বছর পর তাকেই বলতে শুনেছি, আসলে মওলানা ভাসানীই সঠিক ছিলেন। তখন হঠকারী রাজনীতিক ছিলাম বলে তাকে গালি দিয়েছি। এখন আমার আদর্শ ধর্ম-কর্ম-রাজনীতি। তেমনি হয়তো একদিন আমরা উপলব্ধি করব, ধর্ম রক্ষার আন্দোলন হিসেবে যা করা হচ্ছে, মূলত গোটা জাতিরক্ষার জন্য ওটাই সঠিক ছিল।


 ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads