বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ, ২০১৪

তিস্তা চুক্তির প্রশ্নে মনমোহন সিং


অবশেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংও পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানর্জির সঙ্গেই তাল মিলিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তার সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করা সম্ভব নয়। বিমস্টেক সম্মেলন উপলক্ষে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে অবস্থানকালে গত ৪ মার্চ অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ড. মনমোহন সিং বিষয়টিকে তার অক্ষমতা ও ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একই সাথে অজুহাত হাজির করতেও ভুল হয়নি তার। বলেছেন, ভারতের জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কারণেই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করা ‘খুব কঠিন’। দৈনিক সংগ্রামসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, তিস্তা চুক্তির প্রশ্নে অস্বীকৃতি জানালেও ‘বিভিন্ন ইস্যুতে’ বাংলাদেশকে সহযোগিতা দেয়ার জন্য ড. মনমোহন সিংকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারত ঠিক কোন ধরনের ইস্যুতে সহযোগিতা দিয়েছে এবং এখনো সহযোগিতার হাত কেবল বাড়িয়েই চলেছে সে বিষয়ে সম্ভবত কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। ২০০৮ সালের অক্টোবরে সংঘটিত লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস এবং ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া থেকে সর্বশেষ ৫ জানুয়ারির একতরফা ও ভোটারবিহীন নির্বাচনকে বৈধতা দেয়া এবং নতুন আওয়ামী সরকারের পক্ষে সমর্থন যোগাড়ের চেষ্টা চালানো পর্যন্ত অনেক ‘ইস্যু’র কথাই প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা মনে করি, বাণিজ্য, চোরাচালান, সীমান্তে হত্যা ও পানি আগ্রাসনের মতো প্রমাণিত ‘বিভিন্ন’ কারণে তো বটেই, বিশেষ করে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর থেকে ‘ইউ টার্ন’ নেয়ার কারণেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানোর কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। কেননা, পর্যালোচনায় দেখা যাবে, চুক্তি স্বাক্ষরের নামে মনমোহন সিং-এর সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে কেবল অশুভ রাজনীতিই করেনি, ন্যক্কারজনক প্রতারণাও করেছে। ফারাক্কা বাঁধ এবং গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করাসহ পানি আগ্রাসনের বিস্তারিত উল্লেখে যাওয়ার পরিবর্তে তিস্তা চুক্তির প্রশ্নে শুধু যদি ড. মনমোহন সিং-এর নিজের বক্তব্য ও ভূমিকার কথা স্মরণ করা যায় তাহলেই অশুভ রাজনীতি ও প্রতারণা সম্পর্কিত অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। কারণ, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরে আসার প্রাক্কালে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে লম্বা অনেক কথা শুনিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। শুনে মনে হয়েছিল, এতদিন না হলেও এবার তিস্তা চুক্তিটি স্বাক্ষর করা হবেই! ড. মনমোহন সিং ঢাকায় আসার আগে পর্যন্ত দৃশ্যতও সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছিল। তিনিও বাংলাদেশ সংলগ্ন রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রী ও নেতাদের বিরাট এক বহরকে সঙ্গে এনেছিলেন। কিন্তু সবই নিতান্ত অভিনয় হিসেবে পর্যবসিত হয়েছিল। কারণ, একেবারে শেষ মুহূর্তে ঘাড় বাঁকিয়ে বসেছিলেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি Ñ যাকে বাংলাদেশের বিশিষ্টজনরা ‘দিদিমণি’ বলে ডেকে থাকেন। এই ‘দিদিমণি’ পরিকল্পিত চুক্তির বিরোধিতাই শুধু করেননি, একই সঙ্গে বাংলাদেশ সফরে আসতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। বাস্তবেও ঢাকায় আসেননি তিনি। কারণ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে মমতা ব্যানার্জি  বলেছিলেন, বাংলাদেশকে কতটা পানি দেয়া হবে সে বিষয়ে তার সঙ্গে নাকি প্রতারণা করেছেন মনমোহন সিং। কথা নাকি ছিল বাংলাদেশকে ২৫ হাজার কিউসেক দেয়া হবে। কিন্তু চুক্তির খসড়ায় ৩৩ হাজার কিউসেক দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এতেই বেঁকে বসেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তৎকালীন প্রভাবশালী ‘বাঙালী’ মন্ত্রী ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি থেকে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের প্রধান নেত্রী সোনিয়া গান্ধী পর্যন্ত সবাই ‘চেষ্টা’ করে দেখেছিলেন। কিন্তু মমতা ব্যানার্জিকে রাজি করাতে পারেননি। কারণ, তিস্তা তার কাছে তাদের উত্তর বঙ্গের কৃষির জন্য ‘লাইফ লাইন’ ছিল। মমতা ব্যানার্জি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি শেখ হাসিনা নন। এজন্যই তার রাজ্যের স্বার্থের প্রশ্নে এক ইঞ্চি পরিমাণ ছাড় দেননি মমতা। একই কারণে ড. মনমোহন সিং-এর পক্ষেও ‘সদিচ্ছা’ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়নি।
কথাটা সাধারণভাবে বিশ্বাসও করা হয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে তিস্তা ও গঙ্গাসহ সব নদ-নদী দিয়েই অনেক পানি বয়ে গেছে। সত্যি ‘সদিচ্ছা’ থাকলে দেশে ফিরে যাওয়ার পর চুক্তিটির ব্যাপারে মমতা ব্যনার্জির সঙ্গে বৈঠকে বসতেন মনমোহন সিং। তাকে সম্মতও করাতেন। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ বা চেষ্টার কথা শোনা যায়নি। আরেক ‘বাঙালী’ নেতা প্রণব মুখার্জি ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তাকেও তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে সামান্য নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি। ওদিকে এগিয়ে আসছে ভারতের সংসদ লোকসভার নির্বাচন। এই নির্বাচনে বর্তমানে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটার আশঙ্কা প্রবল হয়ে ওঠেছে। অন্যদিকে সম্ভাবনা বাড়ছে চরম হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির। মমতা ব্যানার্জির দিকেও হাত বাড়িয়ে রেখেছে বিজেপি। সুতরাং ড. মনমোহন সিং-এর সত্যি ‘সদিচ্ছা’ থাকলেও এই মুহূর্তে অন্তত মমতা ব্যানার্জিকে চটিয়ে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়া তার পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। সে কথাটাই কিছুটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছেন মনমোহন সিং। সেই সাথে তিনি নিজের অক্ষমতা ও ব্যর্থতার জন্য দুঃখও প্রকাশ করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণ পর্যালোচনায় ড. মনমোহন সিং-এর এই স্বীকারোক্তিকে সরল ও সত্য বলে মনে হতে পারে। অন্যদিকে আমরা কিন্তু বিষয়টিকে এতটা সহজ-সরল মনে করতে পারি না। এর কারণ, মমতা ব্যনার্জিকে ‘হাই কোর্ট’ বানিয়ে নিজেরা তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর না করলেও ড. মনমোহন সিং শেখ হাসিনার সরকারকে দিয়ে কাঠামোগত চুক্তিসহ বাংলাদেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী সব চুক্তিই সেবার স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছিল। এটাও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, ভারতীয়দের বাংলাদেশ নীতিই আসলে এরকম। ভারত নিজেরটা বোঝে ও আদায় করে কড়ায়-গ-ায়, কিন্তু ঝামেলা পাকায় বাংলাদেশকে কিছু দেয়ার প্রশ্ন উঠলেই। উদাহরণ দেয়ার জন্য পানি আগ্রাসনের কথা স্মরণ করাই যথেষ্ট। প্রসঙ্গক্রমে তিস্তা প্রাধান্যে এলেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত পানি আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে বহুদিন ধরে। তিস্তার পানি নিয়েও ভারত কম দেখাচ্ছে না। বাংলাদেশের ওপারে তিস্তার ৪৫ কিলোমিটার উজানে দেশটি এমন এক গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করেছে যার ফলে কোনো চুক্তি হলেও বাংলাদেশ খুব একটা পানি পেতে পারবে না। ৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদীর মাত্র ৪৫ কিলোমিটারের পানি ভাগাভাগি নিয়েই এত কিছু ঘটেছে। মমতা ব্যানার্জি ঘাড় না বাঁকালেও এবং সত্যি সত্যি কোনো চুক্তি হলেও বাংলাদেশ তাই লাভবান হতে পারতো না। এর কারণ শুধু মোট পানির পরিমাণ নয়, ভারতীয়দের চাণক্য কৌশলও। সে কৌশল এবং উদ্দেশ্যের কথাটাই সর্বশেষ উপলক্ষে জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads