পঞ্চম এবং শেষ পর্বের উপজেলা নির্বাচন আগামী কাল অর্থাৎ ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার দুর্ভাগ্য হলো এই যে, আমি যখনই উপজেলা ইলেকশান নিয়ে লিখতে যাই, তখন সেই দিন অথবা তার পরের দিন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সুতরাং আমি আপনাদেরকে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে পারি না এবং সেই পরিস্থিতির ওপর কোন রাজনৈতিক ভাষ্য বা কলামও লিখতে পারি না। ফলে অনেক সময় আশপাশ দিয়ে যেতে হয় এবং দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়। আজকের অবস্থাও তাই। যখন আমি এই লেখাটি লিখছি তখন ২৯ মার্চ শনিবার। লেখাটি ছাপা হবে ৩০ মার্চ রোববার। আর ইলেকশান হবে ৩১ মার্চ সোমবার। অথচ দুই একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিকে ইতোমধ্যেই খবর বেরিয়েছে যে, এবারের উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ টার্গেট করেছে ভাইস চেয়ারম্যানের পোস্টকে। গত নির্বাচন অর্থাৎ চতুর্থ দফার নির্বাচনে ভয়াবহ সহিংসতা এবং প্রকাশ্য ভোট ডাকাতির পর আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যানের পদে এগিয়ে গেছে। তবে ভাইস চেয়ারম্যানের পদে বিএনপির চেয়ে এখনো পিছিয়ে আছে। তবে বিএনপি এবং জামায়াতকে সম্মিলিতভাবে বিবেচনা করলে ভাইস চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ অনেক পিছিয়ে আছে। তাই এবার তারা ৭৪টি উপজেলা নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যানের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ পদ দখল করতে চায় এবং বিএনপিকে শুধু ইকুয়ালাইজ করাই নয়, বিএনপিকে টপকে যেতে চায়। যে ভয়াবহ শ্বেত সন্ত্রাস এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যানের মেজরিটি পদ কবজা করেছে সেই একই শ্বেত ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে এবার তারা ভাইস চেয়ারম্যানের পদগুলোর মেজরিটি দখল করতে চায়।
গতবার অর্থাৎ চতুর্থ দফার ইলেকশানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে করুণ অবস্থা দেখা গেছে তার ফলে আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা এবার দারুণভাবে জোশে এসেছে। তারা দেখেছে যে, আওয়ামী লীগ করলে সাত খুন মাফ। প্রিজাইডিং অফিসার বা সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারকে বসিয়ে রেখে ইচ্ছামত সিল ছাপ্পড় মারলেও কিছু হয় না। তারা দেখেছে যে প্রকাশ্যে বন্দুক, পিস্তল বা লাঠি উঁচিয়ে বিএনপি বা জামায়াতের পোলিং অফিসার বা পোলিং এজেন্টদেরকে তাড়িয়ে দিলেও কিছু হয় না। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে সেনাবাহিনীকে নামানো হলেও সেনাবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছিলো। এটা আমাদের কথা নয়। এটি সুশাসনের জন্য নাগরিক বা ‘সুজনের’ কথা। আর সেই কথাও তারা বলেছে প্রেস কনফারেন্স করে।
পঞ্চম দফা নির্বাচনেও ভয়াবহ সহিংসতা হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সুজন। উপজেলা নির্বাচনে অব্যাহত সহিংসতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সংগঠনটি বলেছে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুরো নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি ও সহিংসতা রোধ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ৫ম দফা নির্বাচনে সহিংসতার আশংকা রয়েছে। নেতৃবৃন্দ বলেন, কার্যবিধি ১৩১ ধারা অনুসারে সেনাবাহিনীর দৃষ্টির মধ্যে কোনো সহিংস ঘটনা ঘটলে তাদের সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হবে। কিন্তু চতুর্থ পর্যায়ের নির্বাচনে সহিংসতা রোধে তারা নতুন কোন মাত্রা যোগ করতে পারেনি। সহিংসতা রোধে সেনাবাহিনী ভূমিকা রাখেনি। উপজেলা নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন ছিল কি না সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। কি শর্তে সেনাবাহিনীকে নামানো হয়েছে, কি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাও জানি না। তবে আমরা ভেবেছিলাম সহিংসতা ঠেকাতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায়নি।
দুই
সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হয়, কার্যবিধি ১৩১ ধারা অনুসারে সেনাবাহিনীর দৃষ্টির মধ্যে কোন সহিংস ঘটনা ঘটলে তাদের সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হবে। কিন্তু চতুর্থ পর্যায়ের নির্বাচনে সহিংসতা রোধে তারা নতুন কোন মাত্রা যোগ করতে পারেনি। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছে। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সেনাবাহিনী কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচনে যে সহিংসতা হচ্ছে তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। এতে রাজনীতিবিদদের নির্বাচনে জিততে সবাইকে সহিংসতার আশ্রয় নিতে হবে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পঞ্চম পর্বে ৭৪টি উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে। এই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৩৬০, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪১৪ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৭৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে এত সব গুরুতর অভিযোগ উঠছে, অথচ সেই নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচনী কমিশনার সারা দেশব্যাপী অনুষ্ঠানরত এই বিশাল নির্বাচনী যজ্ঞে দেশে উপস্থিত নাই। ভাবতে অবাক লাগে যে এত বড় একটি ইলেকশানের আগে তিনি ছুটি নিয়ে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় অবসর বিনোদন করছেন। এইসব কথা শুনলে গা জ্বালা করে ওঠে। কিন্তু তারো আগে প্রশ্ন, চিফ ইলেকশান কমিশনারকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে এত লম্বা ছুটি দেয়া হলো কেন? এই প্রশ্ন কয়েকদিন আগেও উঠেছিলো। কিন্তু কোন মহল থেকেই কোন সদুত্তর পাওয়া যায় নি।
এই সরকার ভারতপ্রেমী সরকার। খুব ভালো কথা। ভারতের প্রেমে তারা অন্ধ হয়ে যায়। সেটাতেও আমাদের বলার কিছু নাই। ভারত প্রেমে এমন গদগদ হওয়ার পর তাদের নিকট থেকে এটিতো প্রত্যাশা ছিলো যে, তারা ভারতের নিকট থেকে ভালো জিনিস গুলো গ্রহণ করবে। সারা দুনিয়া জুড়ে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের সুনাম রয়েছে। তারা সরকারি দল বা বিরোধী দল কাউকেও খাতির করে না। এই ক্ষেত্রে আমাদের সরকারের উচিত ছিলো, কেমন করে ভারতের নির্বাচন কমিশন পূর্র্ণ স্বাধীনতা অর্জন করলো এবং কেমন করে তারা তাদের কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারছে, সেটি ভালো করে জেনে নেয়া এবং স্টাডি করা। সৎ উদ্দেশ্যে বিষয়টি জানার জন্য ভারতে যদি একটি স্টাডি টিম পাঠানো হয় তাহলেও আমাদের আপত্তির কিছু থাকবে না। কয়েকদিন আগে ভারতের প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. সাহাব উদ্দিন ইয়াকুব কুরাইশী ঢাকা সফর করেন। তার কাছ থেকে এই ব্যাপারে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়।
তিন
চতুর্থ দফা উপজেলা ইলেকশান হওয়ার পর যে মারাত্মক সহিংসতা ঘটে গেলো এবং যে প্রকাশ্য ভোট ডাকাতি হলো সেটি নিয়ে কাগজে অনেক লেখালিখি হয়েছে এবং টকশোতে অনেক কথা হয়েছে। এই ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিলো। চিফ ইলেকশান কমিশনারের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত সি ই সি বলেন যে, তাদের কাছে লিখিত কোন কমপ্লেন আসলে তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। তখন একজন সাংবাদিক তাকে বলেন যে, পত্র-পত্রিকায় জাল ভোট দেয়ার যেসব ছবি ছাপা হয়েছে এবং টেলিভিশনে যে সমস্ত ছবি সম্প্রচার করা করা হয়েছে সেগুলোর ভিডিও ফুটেজ এবং পেপার কাটিং থেকেও তো কমিশন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এই কথা শোনার পর ভারপ্রাপ্ত সি ই সি খামোশ হয়ে যান। ওই টকশোতে এক ব্যক্তি টেলিফোনে জানান যে, তিনি রাজশাহীর একটি এলাকা থেকে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। তার একাধিক কেন্দ্রে সরকারের মাস্তান বাহিনীর কয়েক জন সদস্য পেশী শক্তি প্রদর্শন করে তার পোলিং এজেন্টদেরকে বের করে দেয় এবং ইচ্ছামত সিল মারে। তিনি এস এম এস, ইমেল এবং টেলিফোন করে ইলেকশান কমিশনকে বিষয়টি জানান এবং তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। ইলেকশান কমিশন বলেন যে, বিষয়টি তাদের কাছে লিখিতভাবে জানাতে হবে। কথায় কথায় লিখিতভাবে জানানোর বিষয়ে ভারতের নির্বাচন কমিশনের প্রক্তন প্রধান শাহাব উদ্দিন কোরাইশী বলেন, কেউ যদি কোন অভিযোগ বা বক্তব্য নিয়ে আসে তার প্রতি কমিশন গুরুত্ব দেয়। এমনকি সংবাদপত্রে কিছু প্রকাশিত হলে কিংবা টেলিভিশনে কিছু দেখানো হলে কমিশন গুরুত্ব দেয়। তারা আমাদের কাজ সহজ করে দিচ্ছে। টেলিভিশন সাংবাদিকদের কাছে ভিডিও থাকে। অনেকের কাছে স্টিল ছবি থাকে। আপনার জন্য অন্য প্রমাণের তো দরকার পড়ে না। কেউ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করবে, এ জন্য অপেক্ষার দরকার নেই। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব মেকানিজমের যে কাজ, সেটা মিডিয়া করে দেয়। আমি বলব, তারা খুব ভালো কাজ করছে। এমন অনেক বিষয় রয়েছে তার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন। নির্বাচন সামনে, অথচ কমিশন অভিযোগ বিষয়ে ৬ মাস পর সিদ্ধান্ত নিল- এটা কোন কাজের কথা নয়। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর পোস্টমর্টেম হতেই পারে। কিন্তু নির্বাচনের সময় এটা নিয়ে বসে থাকলে চলে না। আগুন লাগলে নেভাতে হবে। তবে চেষ্টা করতে হবে যেন কেউ আগুন না লাগাতে পারে। ক্রিকেটে এল বি ডব্লিউর আবেদনে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিতে হয়। আপনি এজন্য অপেক্ষা করতে পারেন না। ভারতের সুবিধার দিক হচ্ছে নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত দেয় সেটা সব পক্ষ মেনে নেয়।
ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের প্রাক্তন প্রধানের জবানীতে যে দুই তিনটি পয়েন্ট এখানে উল্লেখ করা হলো সেগুলোও যদি আমাদের নির্বাচন কমিশন কার্যকরী করতে পারতো, তাহলেও তো ভোট ডাকাতি এবং কারচুপি স¤পূর্ণ বন্ধ না হলেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতো। কিন্তু এই জন্য শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনকে দোষ দিলে হবে না। সরকারকেও এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন যথার্থ অর্থে স্বাধীন হোক এবং স্বাধীনভাবে কাজ করুক, সেটা সরকারকেও চাইতে হবে। ভারত এবং পাকিস্তানের দুটি উদাহরণ দিচ্ছি। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপিতি অবসরপ্রাপ্ত ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী রায় দিয়েছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানী দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। ফলে জনাব গিলানী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বা থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। আদালতের এই রায়ের পর ইউসুফ রাজা গিলানীকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। ভারতে ইন্দিরা গান্ধী গদি হারিয়েছেন সেটিও উচ্চ আদালতের রায়ের কারণে।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক কোন প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে এই ধরনের কোন দুঃসাহসিক পদক্ষেপের প্রত্যাশা করা যায় কি?
ইনসেট
কথায় কথায় লিখিতভাবে জানানোর বিষয়ে ভারতের নির্বাচন কমিশনের প্রাক্তন প্রধান শাহাব উদ্দিন কোরাইশী বলেন, কেউ যদি কোন অভিযোগ বা বক্তব্য নিয়ে আসে তার প্রতি কমিশন গুরুত্ব দেয়। এমনকি সংবাদপত্রে কিছু প্রকাশিত হলে কিংবা টেলিভিশনে কিছু দেখানো হলে কমিশন গুরুত্ব দেয়। তারা আমাদের কাজ সহজ করে দিচ্ছে। টেলিভিশন সাংবাদিকদের কাছে ভিডিও থাকে। অনেকের কাছে স্টিল ছবি থাকে। আপনার জন্য অন্য প্রমাণের তো দরকার পড়ে না। কেউ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করবে, এ জন্য অপেক্ষার দরকার নেই। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব মেকানিজমের যে কাজ, সেটা মিডিয়া করে দেয়। আমি বলব, তারা খুব ভালো কাজ করছে। এমন অনেক বিষয় রয়েছে তার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন। নির্বাচন সামনে, অথচ কমিশন অভিযোগ বিষয়ে ৬ মাস পর সিদ্ধান্ত নিল- এটা কোন কাজের কথা নয়। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর পোস্টমর্টেম হতেই পারে। কিন্তু নির্বাচনের সময় এটা নিয়ে বসে থাকলে চলে না। আগুন লাগলে নেভাতে হবে। তবে চেষ্টা করতে হবে যেন কেউ আগুন না লাগাতে পারে। ক্রিকেটে এল বি ডব্লিউর আবেদনে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিতে হয়। আপনি এজন্য অপেক্ষা করতে পারেন না। ভারতের সুবিধার দিক হচ্ছে নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত দেয় সেটা সব পক্ষ মেনে নেয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন